Read Time:6 Minute, 6 Second
যাত্রাপথের আনন্দ গান…..।।
অশোক মজুমদার
আমি একটা সিগন্যাল। যানবাহন সামলানোর পাশাপাশি কয়েকবছর হল আমি আপনাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করেছি। লোকে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, গান শোনেন, তারপর রাস্তা পার হয়ে যায়। এইতো কিছুক্ষণ আগে ‘আমি চিনি গো চিনি’ গানটার সঙ্গে আপনিও গুনগুনিয়ে উঠছিলেন। পাশের বাড়ির শ্যামল বাবুকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেলেন। কি ঠিক বললাম তো? না না লজ্জা পাবেন না, লজ্জার কিছু নেই। আপনি তো গান গাইতে ভালবাসেন, আমি শুধু আপনি নয় আপনার মত আরও অনেকের গান শোনার ইচ্ছেটা উস্কে দিয়েছি।
এইতো রাত পোহালেই পঁচিশে বৈশাখ, বাঙালির সবচাইতে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব, কাল তো আমি সারাদিন তাঁর গানই গাইবো। যেমন নজরুলের জন্মদিনে করি নজরুল গীতি। শুধু জন্মদিন কেন, আপনাদের বিশেষ কোন উৎসবের দিনেও বদলে যায় আমার গান,বড়দিন এগিয়ে এলেই আমার শুনতে পাবেন ‘জিঙ্গল বেল জিঙ্গল বেল’ আবার কালী পুজোর মুখেই শুনবেন ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা’-র মত শ্যামা সঙ্গীত।
আমার রক্ত চক্ষু দেখে আগে সবাই ভয় পেত। পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে যান শাসন করাই ছিল আমার কাজ। আমার মনে সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছেন দিদি। তার উদ্যোগে শহরের রাস্তার প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে গান বাজানো শুরু হতেই কতরকম সমালোচনা, এখন কিন্তু সবাই বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমার মত একটা সামান্য সিগন্যাল যেন হয়ে উঠেছে রাস্তার পাশে একটা বটগাছের ছায়া। এখানেই দু দণ্ড গান শুনে একটু হালকা হয়ে নিচ্ছেন ক্লান্ত ড্রাইভার, পথ পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গানের তালে তালে পা নাচাচ্ছেন কোন তরুণ, কোন পথবাসী কিশোর দোলাচ্ছে কোমর। আমি যেন কলকাতার একটা কালচারাল ক্যালেন্ডার। যেমন এখন রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে আপনার মনে পরে গেল কাল পঁচিশে বৈশাখ। দিদির চেষ্টার সুবাদেই শহরে ফিরে এসেছে নিয়মিত বাংলা গান শোনার অভ্যাস। দিদি ক্ষমতায় আসার পরপরই ট্রাফিক সিগন্যাল সংগীতময় হয়ে ওঠার সূচনা।
আমার মনে পড়ছে সরকার বাড়ির ‘পিছিয়ে পড়তে হয়’ কাগজের বর্তমান কর্ণধারও দিদির এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ, খুব ভাল। ভাল যে হয়েছে তা আমি নিজেও বুঝি। যান সামলানোর পাশাপাশি আমি এখন গানে গানে শহরের একটা সাংস্কৃতিক পরিচয়ও তুলে ধরি। কথায় কথায় সংস্কৃতি কপচানো বামেরা এব্যাপারটা ভাবতেও পারেন নি। আমার এই গান বাড়ির বারান্দা বা অফিসের সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোনা যায়। আমার মত কখনো লাল কখনো সবুজ আবার কখনো বা হলুদ হয়ে ওঠা সামান্য সিগন্যাল মানুষের যে একটা রিলিফ হয়ে উঠবে তা আমি নিজেও ভাবিনি।
দিদি আমাকে শিখিয়েছে কাজ মানে শুধু গম্ভীর মুখে কোন দিকে না তাকিয়ে কলম পেষা নয় বরং তা হাসি মুখে চারপাশের দিকে তাকাতে তাকাতে চলা। তাহলেই কাজটা হয়ে ওঠে আনন্দময়। আমি দেখি যে ড্রাইভাররা আমার সামনে এসে থামছেন বা অনুমতি দিলে বেরিয়ে যাচ্ছেন তাদের সবাই গানটাকে উপভোগ করেন। চলার পথে এমনিতেই গান তাদের একমাত্র বিনোদন। এখন ট্রাফিক সিগন্যালেও সংগীত ভেসে আসায় তারাও খুব খুশি। আমার কাছেই কর্মরত পুলিশ এবং সিভিক ভলান্টিয়াররাও অত্যন্ত ব্যস্ত সময়ে এই গানের মধ্যে দিয়েই একটু হালকা হতে চান। এই গানই আমাকে শহরকে চিনতে শিখিয়েছে। আমি দেখি পথের পাশে ঝুপড়িবাসী শিশুরা একমনে শুনছে ট্রাফিক সিগন্যালের গান। কোন মা কোলের বাচ্চাকে গানের তালে তালে ঘুম পারাচ্ছে। শহরের জীবন সঙ্গীতকে নতুন করে আবিস্কার করি আমি।
কাল পঁচিশে বৈশাখ। দিনভোর রবীন্দ্র সদন কিংবা জোড়াসাঁকোর দিকে ধাবমান রবীন্দ্র অনুরাগীদের চোখ মুখ আমার কাছে এসেই গানে গানে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। প্রেমিক তাকাবে প্রেমিকার দিকে, বন্ধু তাকাবে বন্ধুর দিকে, বৃদ্ধ তাকাবে তরুণের দিকে। ভালবাসার শহরকে এই সামান্য সিগন্যাল গানের সুবাদে নতুন করে আবিষ্কার করবে। আর যাদের এসব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হবেনা তারা আমার কাছে অন্তত কিছু রবীন্দ্রগান শুনে নেবেন।
অশোক মজুমদার
সংগ্রাহক : ফারুক আহমেদ
Advertisements