Read Time:7 Minute, 10 Second
অন্য গাঁয়ের আখ্যান : এক অন্যরকম কাহিনী
লালমিয়া মোল্লা
“আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গায়ের পাঁচজনে— আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।”
এমনি করে প্রতিটি গ্রামেরই একটি নাম আছে। হয়তো সে গাঁয়ের একটি নদী আছে এবং সে নদীরও একটা মানানসই নাম আছে। মাঠ আছে, ঘাট আছে। গাঁয়ে মানুষজন আছেন। রঞ্জনা বা রঙ্গিনা নামে কোনো মেয়ে আছে। নাগরিক সুখ আছে, জীবনযাপনের বিড়ম্বনা আছে। শাশ্বত এইসব রঙিন ও সাদাকালো চালচিত্রের বাইরে বা ভিতরে আছে আর একটা গাঁ, আর একটা ভুবন, যা সচরাচর আমরা ভ্রুক্ষেপ করিনা, তার কথা অতি সহজ সরল মুন্সিয়ানায় চিত্রায়িত করেছেন মোঃ আবেদ আলি তাঁর ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ নামাঙ্কিত এক অন্য ধরনের গল্পগ্রন্থে।
এই লেখক পেশায় একজন গ্রামীণ ডাক্তার ও নেশায় একজন নিষ্ঠাবান সাহিত্যানুরাগী। গ্রামের মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকার কারণে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষদের আত্মার আত্মীয় তিনি। আজীবন যাঁদের কাছ থেকে দেখেছেন সেইসব অজ পাড়া-গাঁয়ের ছোটবউ-বড়বউ, লালবাবু-সাদাবাবু, দিলদার মিঞা কিম্বা নিতান্তই সাদাসিধে গ্রাম্যবধু মাদারের মা অথবা আদেল মাস্টার, নাটু ঘটক, চতুর পাঁচু দালাল, দীলবার-কাজেম, বোকা সাতকড়ি, সহজ-সরল হোকাই চাচা, সৎ ও নিষ্ঠাবান আনার মাস্টার- এঁদেরই গায়ে খড়কুটো ও মাটি লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর গল্পের আদল। সহজ-সরল রঙের আঁচড়ে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন মাটির মূর্তির।
গ্রামের সরল গৃহবধূ স্বামী ভাসুরের নাম মুখে আনেন না। এমনকি চিকিৎসকের কাছেও না এবং এজন্য সৃষ্টি হয় এক হাস্যকর ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। ‘গ্রাম্য বধূর গল্প’র এটাই উপজীব্য।
স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন-যুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকা মাদারের মা-র প্রথম সিনেমা দেখার গল্প ‘মাদারের মা’। জীবন-সংগ্রামে পুরুষের সাহায্য ছাড়া একলা লড়তে-জানা নারীর সে-সময়ের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাও নেই। অথচ তাকে ঘরে-বাইরে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়।
এক গ্রাম্য পেশাদার ঘটকের নাম নাটু ঘটক। তাঁর ঘটকালীর গল্প ‘বায়োডাটা’। এই ঘটকালী করতে গিয়ে গ্রাম-শহরের বিচিত্র সব চরিত্রদের সঙ্গে আলাপ হয়। যা তাঁর সহজ-সরল জীবনের সঙ্গে খাপ খায়না।
গরু কেনা-বেচার এক দালালের কাহিনী ‘পাঁচু দালাল’। লোক ঠকানোই যেন তার ব্যবসার মূলধন। সে যেমন ঠকায় সহজ-সরল গরুর মালিককে তেমনি ঠকায় দুঁদে গরু বেপারিকেও। এ-যেন এক প্রতিকী গল্প। অতীতের এই দালালরাই আজকের প্রোমোটার। এই প্রোমোটার-রাজের খপ্পরে আজ বিকিয় যাচ্ছে গ্রাম-শহরের মাঠ-মাটি-মূল্যবোধ।
এমনই আর এক মূল্যবোধ হারানোর গল্প ‘দীলবার ও কাজেম’। এরা দুটি ভাই। একজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। অন্য জন তথাকথিত শিক্ষার সুযোগ-বঞ্চিত। একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চাকুরিজীবী, শহরের অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। অপর জন গ্রামের নিতান্ত শ্রমজীবী ছাঁ-পোষা মানুষ। এই দুইয়ের মূল্যবোধের টানাপোড়েন এই গল্পের উপজীব্য।
সাতকড়ি,–একজন সহজ-সরল গাঁয়ের দরিদ্র মানুষ। স্বপ্ন দেখে সন্তান সুখে ভরপুর এক সংসারের। এক পুত্র সন্তানের কামনায় খপ্পরে পড়ে এক ভন্ড সাধুবাবার। এই নিয়ে গল্প ‘সাতকড়ির স্বপ্ন ভঙ্গ’।
বাংলার শাশ্বত সন্তান স্নেহের গল্প ‘হোকাই চাচা’। হোকাই সাদাসিধে মানুষ। সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সে-কথা বোঝাতে এক কৌশল অবলম্বন করে। এই নিয়ে এক সুন্দর গল্প।
সব শেষে লেখকের স্মৃতিকথায় তাঁর বাল্যকালের পাঠশালার শিক্ষক ‘আনার মাস্টার’। পাঠশালা-যুগের নিষ্ঠাবান এক শিক্ষকের কথা উঠে এসেছে এখানে। এমন শিক্ষক আজকের দিনে বিরল।
মোঃ আবেদ আলি পেশায় একজন নিষ্ঠাবান গ্রাম্য চিকিৎসক হলেও তাঁর মনোজগতে বাস করে অন্য এক সূত্রধর, যিনি প্রতিনিয়ত নিরবে মায়াজাল বুনে চলেছেন আপন খেয়ালে, নিজের ভেতর-ঘরে। আগামী দিনে আমরা আরও নতুনতর কোনো অন্য আর এক জগতের অন্যরকম কাহিনী শুনতে পাবো– সেই প্রেক্ষাপট রচনা করে রাখলেন তাঁর ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ গল্পগ্রন্থে।
অতএব আমরা পথ চেয়ে রইলাম।
তরুণ শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদের আঁকা দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ বইটির অঙ্গসৌষ্ঠব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া প্রত্যেকটি গল্পের ইলাস্ট্রেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তাঁরই আঁকা সব ছবি।
বইটির ছাপা ও বাঁধাইয়ের মান যে-কোনো নামী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনীয়।
বইটি পাঠান্তে পাঠক মোঃ আবেদ আলিকে আবিষ্কারের আনন্দ লাভ করবেন–এ-কথা বলা যায়।
“অন্য গাঁয়ের আখ্যান” লেখক, মোঃ আবেদ আলি, প্রকাশক, উদার আকাশ, ঘটকপুকুর, ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-৭৪৩৫০২, মূল্য ৭০ টাকা।
Advertisements