Read Time:10 Minute, 57 Second
আমার বাবা
লেখক তৈমুর খান
আমি : দুঃখ কী বাবা?
বাবা : কিছু না, মনের রোগ।
আমি : কীভাবে দুঃখ সারে ?
বাবা : মাঠে মাঠে ঘুরলে। গাছতলায় একা একা বসে থাকলে। পাখির ডাক শুনলে। আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে।
আমি : তোমার কখনো দুঃখ পায়?
বাবা : নাঃ, আমার কোনো দুঃখ পায় না।
আমি : এই যে সারাদিন মা তোমাকে বকাবকি করে, ঘরে চাল নেই, খাবার খাওয়া একেবারে বন্ধ তবু বলো তোমার দুঃখ নেই ?
বাবা : এসব দুঃখের কারণ তোকে কে বলেছে ? খালি পেট থাকলে অভাব কেন ভাবিস? এই বাতাস খা, আকাশ খা, মাটি-জল-পাথর খা ; অন্তত মনে মনে যা-ইচ্ছা খেতে থাক্। তোর মায়ের বকাবকি একটা স্বভাব। ওটাই ওর চরিত্র।
এই হচ্ছে বাবা, যার চরিত্র আমাকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এক আশ্চর্যের আকর বলে মনে হতে থাকে। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলিতে দুর্ভিক্ষের সংসারে যেন মানুষ হচ্ছি। রেশনডিলার কন্ট্রোলের পোকাখাওয়া চাল-গম-খুদ দিচ্ছেন সস্তায়। বাবা সারাদিন মজুরি খেটে তাই কিনে আনছে। অবেলায় মাটির উনুন জ্বলে উঠছে । সন্ধ্যার পর খেতে বসছি একসঙ্গে। কোনো কোনোদিন বাঁশবাগানের মাথায় চাঁদ দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের। লম্ফুতে কেরোসিন নেই। বাবা বলছে, দেখ্ তো, চাঁদ কেমন লন্ঠন জ্বেলে বসে আছে !
ভাদ্র-আশ্বিন মাসে মাঠের কাজ শেষ। বাবা ইক্ষুক্ষেতে ইক্ষুর পাতাভাঙার কাজ করছে। আমি ভেজাভাত আমানি নিয়ে দিতে গেছি বাবাকে। কাঁচালঙ্কা আর একটি কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে তা খেতে খেতে বাবা আমার মুখেও তুলে দিচ্ছে। তখন মনে হচ্ছে এক দেবতার সামনে আমিও এক কিশোর দেবতা। দুঃখ মন্থন করা অমৃত ভাগ করে খাচ্ছি। দুনিয়া আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। ইক্ষুক্ষেত আড়াল করে আছে আমাদের সম্ভ্রম। ইক্ষুপাতায় গা কেটে লাল লাল চিরল দাগ হয়ে গেছে। চুঁইয়ে ঘাম পড়ছে সেগুলিতে। বাবা বলছে, ওসব কিছু না, পাতারা ওভাবেই আদর করে!
সারাদিন পরিশ্রমের পর বাবার কাছে বই খুলে বসি। পাটিগণিত থেকে বাংলা ব্যাকরণ শিখে নিই। পঞ্চাশের দশকে বাবা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। আর সেই পড়াতেই আমিও আলো পেতে থাকি। আলো পেয়ে বড়ো হই। গ্রীষ্মকালে ফাঁকা উঠোনে চাটাই পেতে লন্ঠনের আলোয় বাবা সুর করে পড়তে থাকে “হাতেমতাই” :
“এলাহী আলামিন আল্লা জগতের সার।
চৌদা ভুবন মাঝে যার অধিকার ॥
একেলা আছিল যবে সেই নিরঞ্জন।
আপনার নূরে নূরী করিল সৃজন ॥
মোহাম্মদ নামে নবী সৃজন করিয়া।
আপনার নূরে তারে রাখে ছুপাইয়া ॥
দুনিয়া করিল পয়দা তাহার কারণ।
আসমানে জমিনে আদি চৌদা ভুবন ॥”
শুধু “হাতেমতাই”ই নয় “শাহনামা” থেকে “রোজ হাছর”, “আলিফলাইলা” থেকে “আরব্যরজনী”, “রামায়ণ” থেকে “মহাভারত”, “কসসুল আম্বিয়া” থেকে “সচিত্র কিশোর পুরাণ সমগ্র” এবং “উপনিষদ”, “বেদান্ত” কিছুই বাদ যায় না। “শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাস ও নারদের উপদেশে যুধিষ্ঠিরাদির হস্তিনায় গমন” স্ত্রীপর্বের সেই অংশটি পড়তে পড়তে বাবা দার্শনিক হয়ে যেত। আমি শুধু বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম :
“পিতা-মাতা আর দেখ যত পরিবার।
বিচারিয়া দেখ মনে, কেহ নয় কার ॥
কার পুত্র কোন্ জন, কেবা কার পিতা ।
কে কার জননী, কেবা কাহার বনিতা ॥
কত জন্ম কত মৃত্যু স্থির নাহি জানি।
জননী রমণী হয়, রমণী জননী ॥
পুত্র হৈয়া পিতা হয়, পিতা হয় পুত্র।
অপূর্ব ঈশ্বর-লীলা কর্মমাত্র সূত্র ॥”
কৈশোরেই এক উদাসীনতা পেয়ে বসে আমাকে। এই মায়ার জগৎটাকে বাবার কাছেই বুঝতে শিখি। গরিব এক দিনমজুরের ঘরে এরকম দার্শনিকতার চাষ কেউই ভালো চোখে দেখেনি। পরিবারের অন্যান্যদের কাছে ; বিশেষ করে মায়ের কাছে বাবাকে বারবার তিরস্কৃত হতে হত। একবার কিছু টাকা জমিয়ে বাবা মা-কে না জানিয়ে বিভূতিভূষণ রচনাবলী এবং তারাশঙ্করের রচনাসমগ্র কিনে ঘরে আনে। মা জানতে পেরে তুলকালাম কাণ্ড করে বসে।
“সংসারে এক পয়সা দিতে পারো না, গাদাগুচ্ছের বই কিনে ঘরে এনেছ! যাও বই নিয়েই থাকো। তোমার খাবার বন্ধ আজ থেকে।” মায়ের কথা ঠিক ফলেছিল বেশ কিছুদিন। বাবা উদাসীন হাসি হেসে একটা উত্তরও করেনি। অম্লান মুখে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। সংসার শুধু অর্থ চায়, দার্শনিক চায় না। সংসার শুধু আনুগত্য চায়, উদাসীনতা চায় না। বাবা সংসারের উপযোগী ছিল না কোনোদিনই। সমস্ত অভিযোগকে, অভাবকে তাচ্ছিল্য করেই জীবন কাটাত। আমি খিদের জ্বালা উপেক্ষা করতে পারতাম বাবার মুখ চেয়েই।
একবার গ্রামের এক মোড়লের কাছে বাবা দুই কুইন্টাল ধান ধার নিয়েছিল। সেই ধান আর পরিশোধ করতে পারেনি। একদিন মোড়ল এসে বললেন, ধান ধার নেওয়া দু-বছর হল। সুদ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ। এখন কী ভাবছ ?
বাবা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করেছিল, যা বলবেন তা-ই করব।
মোড়ল বাবার সর্বসাকুল্যে একবিঘে জমিটিই লিখে নিয়েছিলেন ধানের পরিবর্তে। বাবা সেদিন মন খুলে রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘে জমি” র দুটি পংক্তি উচ্চস্বরে পাঠ করল :
“মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু-বিঘার পরিবর্তে।”
জমিহারা নিঃস্ব বাবা ঘাস কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কখনো কখনো তালগাছের রস (তাড়ি) পেড়েও বিক্রি করত। কখনো উৎসব উপলক্ষে গ্রামের মোড়লদের কাটা ছাগল-খাসির চামড়াও শহরে বিক্রি করতে আসত। আমিও বাবাকে একাজে সাহায্য করতাম। দু-পয়সা আয় হলে মনে ফুর্তি বাড়ত। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত চলত বাবার পড়াশুনো।
একবার কতকগুলো ধর্মজীবী বাবাকে এসে পাকড়াও করেছিল। দুইহাত চেপে ধরে বলেছিল, তুমি ধর্মকর্ম করো না কেন ?
বাবা বলেছিল, ধর্ম কাকে বলে জানো? শুধু টুপি আর দাড়ি রাখলেই ধার্মিক হওয়া যায় না। মানুষ হতে হয়।
ধর্মজীবীরা বলেছিল, আমরা কি মানুষ নই ?
বাবা বলেছিল, তোমরা কটা লোকের উপকার করেছ?
অভাবে দুঃখে কটা লোকের পাশে দাঁড়িয়েছ ? মন্দির-মসজিদেই শুধু ধর্মের চাষ হয় না, মানুষকে ভালবাসতে না পারলে ধর্ম হয় ?
কোনো ধর্মজীবীই নিছক মানুষকে ভালবাসার বিধান দিতে পারে না। তারাও পারেনি। বাবাকে তাই অধার্মিক, ভণ্ড বলেই তারা চলে গিয়েছিল। বাবা দাড়ির বদলে বড়ো বড়ো গোঁফ রেখেছে। হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনো করে, এটা অনেকেই সহ্য করে না। দরিদ্র মানুষের এত বেয়াদপি সহ্য হয় ? কিন্তু মনে মনে আমি বাবাকে সমর্থন করি। বাবা বলে, মানুষ হতে গেলে আকাশের মতো হতে হয়।
এই আকাশ হওয়ার সাধনাটিই আজ আমার জীবনের ব্রত। চারিপাশে এত আঁধারের সাম্রাজ্য, এত আঘাত-প্রত্যাঘাত চলছে যে দু-দণ্ড স্থির হয়ে ভাববার অবকাশ পাচ্ছি না। তবু নীরবে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, দেখি বাবার মুখ ভেসে উঠছে। কয়েকদিনের দাড়ি না কাটা মুখমণ্ডল, করুণ চাউনিতে আমাকে অভয় দিচ্ছে। ক্লাসে ক্লাসে ব্যাকরণ পড়াচ্ছি। কারক-বিভক্তি-সমাস-প্রত্যয়। দেখি বাবা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গতানুগতিক ধর্মচর্চায় সবাই যখন ব্যস্ত, তখন ছায়াচ্ছন্ন কোনো বৃক্ষতলে পাখিদের কলকাকলি বোঝার চেষ্টা করছি। দেখি বাবাও মাটির সঙ্গে মিশে আছে এক শাশ্বতকালের অনুভূতির আকর হয়ে। সূর্য উঠছে, চাঁদ উঠছে, রাত্রি নামছে, আমি দৃশ্যমান বৃহৎ “হাতেমতাই” আর “মহাভারত” খুলে পাঠ করছি। স্ত্রীর তিরস্কার কানে ঢোকে না। বাজার গেলে নিজের মতোই ফিরতে দেরি হয়। ছেলের জ্বরের ওষুধ আনতে গিয়ে ভুলে যাই। ধর্মগুরুদের বকুনি শুনে বাড়ি ফিরতে হয়। এভাবে সংসার চলে? চলে না । বাবার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। নিজেকে আয়নায় দেখে চিনতে পারি, এতো বাবাই ! আমিই আমার বাবা হয়ে উঠি। বাবার মতোই ডানপায়ের শিরাটিও ফুলে ওঠে আমার।….
সংগ্রাহক : ফারুক আহমেদ
Advertisements