Read Time:12 Minute, 45 Second
সুব্রত বক্সি
সন্ত্রাসমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, উন্নয়নমুখী বাংলা গড়ার লক্ষ্যে আমরা প্রথম থেকে রাজ্যের মানুষের কাছে বদ্ধপরিকর। একের পর এক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মানুষ আমাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। বাংলার উন্নয়নের অবিচল লক্ষ্যে আমাদের সরকারও এগিয়ে চলেছে। নানা প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে নিরন্তর পরিষেবা। গোটা বাংলায় আজ শান্তির পরিবেশ। কিন্তু এই পরিবেশ একদিনে তৈরি হয়নি। অবশ্যম্ভাবী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একদিন কংরেসের পতাকা হাতে নিয়ে পথে নেমেছিলেন জননেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু সেই দলে থেকে লড়াই যে দীর্ঘস্থায়ী হবে না, অচিরেই তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। দূরদর্শী দলনেত্রী আজ থেকে কুড়ি বছর আগেই বলে দিয়েছিলেন, এই বাংলায় সিপিএমের ঘরে কংগ্রেস তার পতাকাটা বন্ধক রেখেছে। বাম জমানায় অনুন্নয়নের সেই অভিশাপ থেকে বাংলাকে মুক্তি দিতেই ১৯৯৮ সালের ১ লা জানুয়ারি শকলকে একজোট করে নেত্রী তৈরি করলেন নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই শুরু।
তবে কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে আজকের এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়েছে, তা প্রতি পদক্ষেপেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে। একঝাঁক মনীষীর আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়। তার পর ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষে ডঃ বি আর আম্বেদকরের হাতে গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান তৈরি হওয়ার পর ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল। একের পর এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে শুরু করল ধর্মনিরপেক্ষ এক রাষ্ট্র। তার পর ১৯৮৪ সালের নির্বাচন। ৪১৪ টি আসনের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সেবার দেশের দখল করে কংগ্রেস। তার পর ১৬তম নির্বাচন হয়ে গেল ২০১৪ সালে। কংগ্রেস নেমে এল ৪৪টি আসন।
অন্যদিকে, ২৮২ আসন নিয়ে ক্ষমতায় এল এক সাম্প্রদায়িক সরকার। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ততদিনে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। বহু চাপান-উতোর পার করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সংঘবদ্ধ করে ২০১১ –র ২০ মে বাংলার ক্ষমতায় এলেন তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী। সেই ঐতিহাসিক বিধানসভা নির্বাচনে ২৭ দিনে ১৮৭টি জনসভার মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বাংলায় সঠিক পরিস্থিতির বাতাবরণকে সামনে রেখে মানুষের কাছে আবেদন করেছিলেন বাংলার পরিবর্তনের। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, অরাজকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের বাংলা গড়ে তোলার সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ মমতা বন্দোপাধ্যায়কে বাংলার কান্ডারি হিসাবে চিহ্নিত করলেন।
বাংলার মানুষের কাছে আশ্বাস পেয়ে উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়ে রাজ্যজুড়ে একাধিক জনমুখী কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করলেন নেত্রী। সরকারে ক্ষমতায় আসার ১৯ দিনের মাথায় জঙ্গলমহল পৌঁছলেন। সেখানকার মানুষকে সঙ্গে নিয়েই মাওবাদী সমস্যার সমাধান করে শুরু করলেন উন্নয়ন। অন্যদিকে, ৪৬ দিনের মাথায় পাহাড়ে গিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হলেন। কিন্তু সেই প্রচেষতাই বাঁধা দিতে চক্রান্ত করে কেন্দ্রের সরকারি দল দার্জিলিংকে বাংলা থেকে বিছিন্ন করার কাজ শুরু করল। বিচক্ষণ তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী সময় দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান ক্করে মানুষের পাশে দাঁড়ালেন।আটমাস পর সেখানকার মানুষই বুঝল, উন্নয়ন একমাত্র মমতা বন্দোপাধ্যায়ই করতে পারবেন। কারণ তিনি শান্তির পক্ষে। অবিলম্বে দেশের মানুষও বুঝতে পারল বাংলা থেকে বিছিন্ন হয়ে নয়, বাংলায়, থেকে তারই অঙ্গ হয়ে দার্জিলিং শুধু এ রাজ্যেরই নয়, একদিন গোটা দেশের পর্যটন মানচিত্রে শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে নেবে।
এর মধ্যে, শুধু প্রকল্প ঘোষণা করেই নয়, বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় সেই প্রকল্প কতটা সুফল এনে দিচ্ছে, নিজে রাস্তায় নেমে তা প্রত্যক্ষ করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম পর্যায়ে তাঁর শাসনকালে ১১৬টি প্রশাসনিক বৈঠক করে সচিবালয়ের মন্ত্রিবর্গ থেকে শুরু করে আধিকারিকদের নিয়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেলেন। এবং সর্বস্তরে মানুষকে তার পাওনা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাঁর সেই কর্মকান্ড মানুষ উপলব্ধি করলেন বলেই ২০১৬-র নির্বাচনে যথাযজ্ঞ মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে বিরোধী দলগুলি একদিকে মুখ্যমন্ত্রীকে হেয় করা ও তাঁর কর্মসূচিগুলিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টায় আকসুরে সরব হয়েছিল। মানুষের উন্নয়নের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করে যার পটভূমী তৈরি করেছিল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু সাত দফা নির্বাচনে বাংলার সর্বত্র ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি উষ্ণতা উপেক্ষা করে বাংলার মানুষ মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আবারও দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করল। যার জেরে ১৮৭টি আসন সংখ্যা গিয়ে পৌঁছল ২১১ তে। প্রতিদান হিসাবে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের সভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, বাংলার মানুষের জন্য যত প্রকল্প তিনি ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রাণ থাকতে তার একটিও বন্ধ হবে না। বাংলার ন’কোটি মানুষ কোনও পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হবেন না।
এই পরিস্থিতিতেই আমাদের তৈরি হতে হবে ২০১৯ সালের লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতবর্ষের মানুষ বিজেপির নানা প্রতিশ্রুতিতে ভুলে তাদের দেশের ক্ষমতায় অসীন করে। কিন্তু ভারতের মানুষের দুর্ভাগ্য। তারা উপলব্ধি করেছে এই সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলিকে বিপর্যস্ত করা। একদিকে মানুষের ন্যায্য পাওনা থেকে তাদের বঞ্চিত করে নোটবন্দি, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার হ্রাস, ব্যাঙ্কে নানা বাধ্যবাধকতা তৈরির মতো নানা জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে গোটা দেশকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চলেছে। ধর্মের সুড়সুড়ি জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ বাধিয়ে সামাজিক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যা সংবিধান বহির্ভূত বহির্ভূত। একেবারে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে এই রাজনৈতিক দল। সার্বিক এই অত্যাচার থেকে কৃষক, শ্রমিক, তপসিলি জাতি-উপজাতি, সংখ্যালঘু কেউ বাদ যাচ্ছে না।
উদ্ভূত এমন রাজনৈতিক সংকটকালে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার ডাক দিয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সব ক’টি বিরোধী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে একজোট করে যুব ও ছাত্রসমাজকে প্রবল লড়াইয়ে নামার আহ্বান জানালেন তিনি। জননেত্রীর সেই আহ্বানেই সাড়া দিয়ে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে এক ছাতার তলায় একজোট হওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে দেশের সব ক’টি কেন্দ্র-বিরোধী দল। তাদেরই ফল আমরা হাতেনাতে পেয়েছি দেশজুড়ে একের পর এক লোকসভার উপনির্বাচনে। সেখানে সামপ্রদায়িক শক্তিকে কোণঠাসা করে চরম বার্তা দিয়েছেন মানুষ। একের পর এক আসন হাতছাড়া হতে শুরু করেছে কেন্দ্রের দলের। অন্যদিকে, কর্নাটকের মতো সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনেও জনমত প্রতিফলিত হয়েছে গণতন্ত্রের পক্ষে। আঞ্চলিক শক্তিগুলিও জোট বেঁধেছে। অর্থাৎ সামনে জোর লড়াই। গত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে সেই লড়াইয়ের দিকনির্দেশ করে দিয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সব ক’টি গণতান্ত্রিক দলকে একজোট করে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে, কোথাও যদি খামতি থাকে তার মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে, তার সমস্ত রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন নেত্রী। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই বার্তা। নির্যাতন যত বেশি হবে, আওয়াজ তত তীব্র হবে।
সাম্প্রদায়িকতা ভারত ছাড়ো– বাংলার আন্দোলনের মাটি থেকে এই আওয়াজ তুলে ইতিমধ্যে তাকে ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন জননেত্রী। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৯ –এর লোকসভার লড়াইকে সামনে রেখে সর্বস্তরের, সর্বজাতের, সর্বপেশার মানুষ সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। এই শক্তির একটাই উদ্দেশ্য, সাম্প্রদায়িকতাকে হঠিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা। সেই লড়াইয়ের নেতৃত্বে অবশ্যই মমতা বন্দোপাধ্যায়। আমাদের ভূমিকা তাই আরও কঠিন। লড়াই শক্ত মনে হলেও পথ প্রশস্ত। আগামিদিনে ব্রিগেড সমাবেশের মধ্যে দিয়েই সর্বশক্তির মধ্যে দিয়েই সর্বশক্তির একজোট হওয়ার বলা যেতে পারে মহারণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সেরে নেবেন দলনেত্রী। তার পর মূল লড়াই। সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের পাশে থেকে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের সেই লড়াইয়ে নামতে হবে। নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে কর্তব্যপালন। তোইরি হতে হবে সাম্প্রদায়িকতাকে হঠিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের মহান ব্রত নিয়ে।
Source : Courtesy AITC Website
Advertisements