প্রতিবাদ না পৃষ্ঠপ্রদর্শন…
অশোক মজুমদার
অপশাসন ও মানুষের দুর্ভোগের বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য মানুষের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন মোদী-অমিত শাহরা। এমনকি রাজনীতির সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কবর্জিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকেও ছাড় দিচ্ছে না তাদের অনুচররা। শনিবার শিলচরে বাংলার বিশিষ্ট কবি শ্রীজাত-র একটি অনুষ্ঠানে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীদের হামলা এই প্রবণতার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। গেরুয়াপন্থীরা সর্বক্ষণ যার নাম উচ্চারণ করেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে শিলচরে ‘এসো বলি’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিকচর্চা কেন্দ্রের উদ্বোধনের জন্য গিয়েছিলেন শ্রীজাত। সেখানেই এই হামলা হয়। শ্রীজাত-র অপরাধ তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে গেরুয়া সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। দুবছর আগে লেখা কবিতায় অজ্ঞতা-ধর্মান্ধতা বিভাজনের যে ত্রিশূলে গেরুয়াপন্থীরা দেশের মানুষকে বিদ্ধ করছেন একটি উপমার সাহায্যে তার সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
মানুষের ভাবনাচিন্তার এলাকায় ধর্মান্ধদের জারি করা কারফিউর বিরুদ্ধে সচল হয়েছিল তার কলম। মোদী-অমিতদের বিভাজনের রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বরাবর প্রতিবাদী – শ্রীজাতর ওপর গেরুয়াপন্থীদের সে রাগ এখনও যায়নি। তার বিরুদ্ধে রে রে করে মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীরাই এখন দেশে কে কী বলবে, লিখবে এবং পড়বে তা ঠিক করে দিচ্ছে। এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। কবির কণ্ঠরোধ করার জন্যই তার অনুষ্ঠানে ঢুকে গেরুয়া গুণ্ডারা শ্রীজাতকে নিগ্রহ করতে চায়, কেড়ে নেয় মাইক, বন্ধ করে দিতে চায় অনুষ্ঠান। এতে না দমে গিয়ে খালি গলায় কবিতা পাঠ করে অনুষ্ঠান শেষ করেন শ্রীজাত। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় তারা নিস্ফল আক্রোশে সভাস্থলে ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনা আমাকে কার্জন পার্কে বাদল সরকারের নাটক বন্ধ করে দেওয়া থেকে শুরু করে বাম আমলের একেবারে অন্তিম পর্বে ব্রাত্য-অর্পিতাদের নাটকের ওপর হামলার ঘটনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে হামলাকারীদের পরিণাম মানুষ দেখেছে। একই অবস্থা যে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীদেরও হবে তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
মনে পড়ছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার একটা কবিতায় লিখেছিলেন – পুলিশ, ওরে পুলিশ, কবির সামনে টুপিটা তুই খুলিস। স্মৃতি থেকে বললাম, ভুল হলে কবি বন্ধুরা শুধরে দেবেন। আমি যেটা বলতে চাইছি তা হল, ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে শিল্পসংস্কৃতির স্বঘোষিত পুলিশরা সবসময় সংস্কৃতি ও কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতাদের গলা টিপে ধরতে চায়, এমনকি তাকে চিরতরে শেষ করে দিতে চায়। কখনও তারা সাময়িকভাবে সফল হলেও কিন্তু শেষরক্ষা হয়না। ক্ষমতা থেকে সরে চিরবিদায় নিতে হয় তাদের। সেই লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা কিন্তু মানুষের মনেই থেকে যান। বছর কয়েক আগে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীরা খুন করেছিল লেখিকা ও সমাজকর্মী গৌরী লঙ্কেশকে। তাকে কিন্তু আমরা এখনও মনে রেখেছি।
সাবাস শ্রীজাত, তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এ হামলায় ভয় পেয়ে তিনি তার কলম থামাবেন না। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও উপস্থিত দর্শকরা এ হামলা রুখেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খবরটা শোনার পরই তৎপর হয়ে শ্রীজাত-র সুরক্ষা ও তাকে নিরাপদে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। এব্যাপারে আসাম সরকারের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। যে কোন দায়িত্বশীল সরকারের প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী সঠিক কাজই করেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এখন থেকেই যদি আমরা সবাই দলমত নির্বিশেষে একসঙ্গে মিলে এধরণের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি তাহলে কিন্তু এই হামলাবাজদের আক্রমণ আরও বাড়বে। বিপর্যস্ত হবে আমাদের স্বাধীন চিন্তা, বাক্ স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের ক্ষমতা। তাই এর বিরুদ্ধে সরব হতেই হবে। মনে রাখবেন গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ ক্ষমতায় আবার ফিরলে এই আক্রমণ হবে লাগামছাড়া। ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান এমনকি স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি গুলিয়ে দেওয়া এই শাসকরা আর শত্রুর শেষ রাখতে চাইবে না। মতান্ধ শাসকদের হাতে আমরা ফিরে যাবো এক অন্ধকার যুগে।
এই আক্রমণ শুধু শ্রীজাত-র ওপর আক্রমণ নয়, এটা আমাদের বোধবুদ্ধির ওপর একশ্রেনির বর্বরদের আক্রমণ। মোদী-অমিতরা হলেন বর্বরদের মূল পৃষ্ঠপোষক। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। প্রতি আক্রমণই এখন একমাত্র রাস্তা। আমরা সবাই মিলে রুখে না দাঁড়ালে এই পৃষ্ঠপোষকতা আরও বাড়বে। বাংলার কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, অভিনেতা, চিত্র পরিচালকরা এবার ঠিক করুন কোনটা করবেন তারা, প্রতিবাদ না পৃষ্ঠপ্রদর্শন।
Collected by Faruque Ahamed