বাঁশিবাদক অফিসার ইন্দ্রজিৎ বসুর কণ্ঠে সম্প্রীতির সুর

0
1027
Indrajit Bose
Indrajit Bose
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:12 Minute, 30 Second

বাঁশিবাদক অফিসার ইন্দ্রজিৎ বসুর কণ্ঠে সম্প্রীতির সুর

ফারুক আহমেদ

‘‌বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি
দেখিনা তোমায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায়
শহুরে হাওয়ায়’‌

তবে এই বাঁশুরিয়ার সুরের যাত্রাপথ একটু আলাদা। তাঁর বাঁশির মাদকতায় এক হয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে শহর। দূর করে দিচ্ছে ভাগাভাগির সীমারেখা। তাঁদের সঙ্গীত গড়ে তুলছে সম্প্রীতির মিনার। অনুষ্ঠানের নামেও সেই ছোঁয়া, ‘‌মিলে সুর মেরা তুমহারা’‌।

বছর পাঁচেক ধরে পেশাদারদের মতো অনুষ্ঠান করছেন ইন্দ্রজিৎ বসু। তিনি বাঁশিবাদক। তাঁর সঙ্গীসাথীরা হলেন সারেঙ্গিতে আল্লারাখা কলাবন্ত, গায়ক আর্শাদ আলি খান, সানাইয়ে হাসান হায়দর খান। কখনও একা কখনও বা বন্ধুদের সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠান করছেন। দিকে–দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন একতার জয়গান। এমন কাজ তো সব শিল্পীই করে থাকেন। তাঁরা সকলেই তো সুদীর্ঘকাল থেকে মানুষের ঐক্য, ভালবাসার কথা বলেন। সীমানা ভাঙার কথা বলেন। শোষণের বিরুদ্ধে হাঁটেন। তাই অনেকের মনে হতে পারে ইন্দ্রজিৎ বসুর কথা আলাদা করে বলার কী দরকার পড়ল?‌ তার দরকার রয়েছে। কারণ শিল্পীসত্ত্বার পাশে তাঁর আরও একটা পরিচয় রয়েছে। সেটি হল তিনি একজন পুলিশ আধিকারিক। বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তিনি। যত বড় পদ তত দায়–দায়িত্ব বেশি। ভুলত্রুটি হল সব দায় বর্তায় তাঁদের ওপর। বারুইপুরের মতো জনবহুল এলাকায় কাজ করাও বেশ ঝক্কির। যত ভিড়, মানুষের আনাগোনা, তত সমস্যা তৈরির আশঙ্কা। কখন কোথায় কী ঘটে যায়!‌ সারাদিনের ব্যস্ততা পেরিয়ে, ক্লান্তি সরিয়ে শিল্পচর্চা করার জন্য শিল্পের প্রতি কতটা দরদ থাকা দরকার তারই যেন একটা উদাহরণ তিনি। শিল্পের প্রতি শুধু ভালবাসা, টান থাকলে হয় না। নিয়মিত তা চর্চা করে যেতে হয়। সে কাজই তিনি করে আসছেন দীর্ঘদিন। এই অধ্যবসায়, পরিশ্রম তারিফযোগ্য, সন্দেহ নেই।

২০০৮ সালে তিনি ডব্লুবিপিএস–এ সফল হন। তবে তার অনেক আগেই ২০০৪ সালে এক্সাইজ বিভাগে চাকরি পেয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল পুলিশে কাজ করবেন। তাই আবার প্রস্তুতি নেওয়া এবং পরীক্ষায় বসা। এবং পেয়েও যান। বাঁশির সঙ্গে তাঁর প্রেম স্নাতক স্তরের লেখাপড়া করার সময়। সেটা ১৯৯৮ সালের ঘটনা। তখন তিনি গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্সের ছাত্র। এর আগে যে বাঁশি বাজাননি তেমনটা নয়। ছোট থেকেই ওই বাদ্যযন্ত্র তাকে ডাকত। ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে বাঁশি কেনা। ছেলের সব চেষ্টাতেই মা দিতেন অফুরান উৎসাহ। বাঁশির প্রতি ভালোবাসা মায়ের হাত ধরেই। তবে সময়–সুযোগ হয়নি। তবে ছাড়তে পারলেন কই!‌ অবচেতনে জড়িয়ে ছিল। কলেজে পড়ার সময় বাঁশিপ্রীতি নাড়িয়ে দিল। এবার আর কিছু করার নেই। এতদিন ছিল সময় বের না–করতে পারার অভিযোগ। বাঁশিপ্রীতি সেসব চুরমার করে দিল। শেখার সময় পাওয়া গেল। নাকি বাঁশি নিজেই তা খুঁজে দিল!‌

যাহোক, সেই শুরু। ইন্দ্রজিৎ বসুর কথায়,‘‌শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হল গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর তালিম ছাড়া এখানে এগোনো যায় না।’‌ তিনি গুরু হিসেবে পেলেন প্রয়াত শিল্পী পন্ডিত নিখিলেশ রায়কে।

রোজ চর্চা করাটা জরুরি। আর সেটা করতে না পারলে বড্ড অস্বস্তি হয়। মনে হয় কী যেন বাদ যাচ্ছে। জানাচ্ছেন তিনি। আর তাই তো কাঁথির এসডিপিও থাকার সময় দিনে আর রানাঘাটের এসডিপিওর দায়িত্ব সামলানোর সময় রাতের দিকে বাঁশি বাজাতেন। এটা ঘটনা সময় বের করা কঠিন। কিন্তু এখানে সেই পুরনো প্রবাদটা মনে আসে। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর তাই তো চাকরি, পরিবারকে সময় দিয়েও বাঁশির জন্য খানিকটা সময় হাতে রয়ে যায়।

রাজ্যের বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বুঝেছেন সুর ভাল হলে তা মানুষের মনে জায়গা করে নেবে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হলেও মানুষ তা শুনবেন, মনে রাখবেন এবং বারবার তা শোনানোর জন্য অনুরোধ করবেন। এমনই অভিজ্ঞান তাঁর। আরও একটা জিনিস বুঝেছেন সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে খুব অনায়াসে যোগাযোগ তৈরি করা যেতে পারে। কখন যে তাঁদের আপনজন হয়ে ওঠা যায়, তা বোঝাই যায় না। এসডিপিও, অতিরিক্তি পুলিশ সুপার, খাকি উর্দি হয়ে ওঠে ‌বাঁশুরিয়া। তিনি বলেন, ‘‌লাইভ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যেন সরাসরি যোগাযোগ হয়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকেন। তাঁরা নিজেদের কথা বলতে পারেন। আমাদের অনেকের ধারণা মানুষ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পছন্দ করেন না। আমার অভিজ্ঞতা পুরো উল্টো। তাঁরা দিব্যি শোনেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুষ্ঠান চলে। পরে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কথা হয়। অনেক কিছুই জানতে পারি, শিখতে পারি। এগুলো পরবর্তী সময়ে কাজে লাগে। অর্থ, খ্যাতির থেকে এটাও কম বড় পাওনা নয়।’‌ মঞ্চে উঠে প্রথম অনুষ্ঠান রানাঘাটে। মাঝে কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন নিয়মিত চলছে। একক অনুষ্ঠান যেমন করেছেন, তেমনই দল বেঁধে অনুষ্ঠানও করেছেন। তাঁদের অনুষ্ঠানের নাম ‘‌মিলে সুর মেরা তুমহারা’‌। দেশ, কাল, সীমানার গন্ডি ভেঙে সুর সবাইকে জড়িয়ে ধরে রাখছে। বাঁশি, সারেঙ্গি, সানাই বলছে আমরা সবাই এক।

অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একটা ভয় থেকেই যায়। কোথায় কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি তো?‌ তা হলেই তো সব ছেড়েছুড়ে ছুট দিতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপাতত তেমন মনে খারাপের কোনও ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়নি। অনুষ্ঠান করার জন্য সব সময় সাহায্য পেয়েছেন সিনিয়রদের। তাঁরা তাঁকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘‌অনুষ্ঠান করা না করা কপালের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কখন কী ঘটনা ঘটে সেই নিয়ন্ত্রণ তো আমার হাতে তো কিছু নেই। তবে কিছু হলে তা দ্রুত সামলানো আমাদের কাজ। সেই কাজ মন দিয়ে করি। আর চর্চা করাটা নিজের ওপর। তাই সেটাও মন দিয়ে করে যাচ্ছি।’‌

বাড়ীতে বাবা অসম্ভবরকম গানবাজনা শুনতেন। শাস্ত্রীয়, উপশাস্ত্রীয়, পপ, বিটলস..সব। ছোটবেলাতে এই গান শোনার পরিবেশে থেকে, বাঁশি বেছে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে ইন্দ্রজিৎ বসুর পছন্দ কিন্তু সবচেয়ে বেশী ছিলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিই সেই ছোটবেলা থেকে।

সম্প্রতি রবিবার ৭ জুলাই কল‍্যাণী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের এ পি জে আবদুল কালাম অডিটোরিয়ামে ইতিহাস বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবে বাঁশি বাজিয়ে সকলকে মুগ্ধ করলেন পুলিশ আধিকারিক ইন্দ্রজিৎ বসু।

রবিবার অনুষ্ঠিত হল কল‍্যাণী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৩০ তম পুনর্মিলন উৎসব। ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের পরিচালনায় এটি অনুষ্ঠিত হয়।

বিভিন্ন ঘরানার গান, নৃত‍্য, আবৃত্তিসহ একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের উদ্যোগে।

এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বনামধন্য অধ‍্যাপক রাখাল চন্দ্র নাথ, অনিল কুমার সরকার, সুতপা সেনগুপ্ত, সুভাষ বিশ্বাস, তুষারবরণ হালদার, পার্থ দত্ত, বিভাগীয় প্রধান সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাস বিভাগের গবেষক ফারুক আহমেদ, অজিত রবি দাস, সুকল্যাণ গাইন, শত্রুঘ্ন কাহার প্রমুখ।

ইতিহাস বিভাগের ৩০ তম পুনর্মিলন উৎসবে কল‍্যাণী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের এ পি জে আবদুল কালাম অডিটোরিয়ামে বাঁশি বাজিয়ে সকলকে মুগ্ধ করলেন বিশিষ্ট পুলিশ আধিকারিক দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সহ পুলিশ সুপার ইন্দ্রজিৎ বসু। তাঁকে তবলায় যোগ্য সংগত করলেন উজ্জ্বল ভারতী।

সমগ্র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফল করতে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায় মৌমিতা ঘোষ, রাহুল দেবনাথ, অর্ঘ্য বিশ্বাস।

ইতিহাস বিভাগীয় প্রধান সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বললেন, “এবারের পুনর্মিলন উৎসব সঙ্গীতি সার্থক। প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের এই মিলনমেলায় ইতিহাস বিভাগের সকলের মধ্যে মেলবন্ধনের সুর অনুভব করা গেল। আর ছাত্রদের চমৎকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এক বড় প্রাপ্তি।”

ইন্দ্রজিৎ বসু বললেন, ‘সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে
ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত 
জ্ঞানের আলোয়, উচ্চতরশিক্ষা অর্জনের 
ক্ষেত্রে আলোকিত 
মুখ-রাই দেশের গৌরব হয়ে উঠুক।’

এদিন কল্যাণীর সেন্ট্রাল পার্কে ইসকন আয়োজিত রথ যাত্রা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চে বাঁশি বাজিয়ে সকল জগন্নাথ ভক্তকেও মোহিত করলেন ইন্দ্রজিৎ বসু।

বিভেদকামী শক্তির অবসান ঘটাতে বিভেদ মুছে অসহিষ্ণুতা রুখে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েই সমাজকে আলোকিত করাই মূলত উদ্দেশ্য বাঁশির সুরকার ইন্দ্রজিৎ বসুর।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here