প্রেমিক বাউল অনন্তের কবি কবিরুল

0
1904
Poet Kabirul Shaheb
Poet Kabirul Shaheb
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:8 Minute, 30 Second

প্রেমিক বাউল অনন্তের কবি কবিরুল
তৈমুর খান

এক গূঢ় অভিমান আর তাচ্ছিল্যের হাসি রেখেই চলে গিয়েছেন কবিরুল ইসলাম(২৪ /৮/১৯৩২ —১৯ /৭ /২০১২)। পঞ্চাশের দশক থেকে নীরবে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য চর্চা করেছেন। বাংলা কবিতাকে তিনি গভীরভাবে ভালবেসেই প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য বাংলা সাহিত্যের কোনও নিয়ামক পর্যৎ কবিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেননি। সেই অভিমান কোনওদিন প্রকাশ না করলেও নীরব আর স্বগত সংলাপে কাব্যচর্চার মতো তিনি আশ্চর্য উদাসীনতায় এক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন ওইসব পুরস্কার আর তাঁবেদারে। গ্রামজীবন, পরিবার-পরিজন এবং বন্ধুবাৎসল্যের পরিমণ্ডলেই তিনি বসবাস করতে ভালবাসতেন। আগাগোড়া রাঙামাটি বীরভূমের বাউল পথিক হয়েই তিনি সুফি-সহজিয়া সাধনমার্গের সন্ন্যাসীপ্রতিম মানুষ। সারাজীবন তিনি আত্মখননের মধ্যে দিয়েই আত্মান্বেষণ করেছেন। নিজের সঙ্গে নিজেরই সংলাপে তুলে এনেছেন কবিতার ভাষা। নিজের রূপে নিজেকেই দেখেছেন। বহুমাত্রিক দৃশ্য, বহুমাত্রিক রূপ, বহুমাত্রিক অনুভূতির পয়গামেও একজনই রহস্যচারী সত্তার অধিকারী। তিনি কখনও নারী, কখনও অন্তরদেবতা, আসলে কবি নিজেরই পরিচয় বুঝতে চেয়েছেন।

কবিরুল ইসলাম জন্মেছিলেন নলহাটির কাছে হরিওকা গ্রামে। পিতা মহম্মদ ইয়াকুব হোসেন, মাতা মরিয়ম বেগম। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যাপক হন। ষাট দশক থেকেই লেখালেখি শুরু। “দেশ” পত্রিকাসহ ভারত ও বিদেশের বহু পত্রিকায় লিখেছেন মূলত কবিতাই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কুশলসংলাপ” প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এরপর একে একে কাব্যগুলি হল :  “তুমি রোদ্দুরের দিকে”, “বিবাহ বার্ষিকী”, “বিকল্প বাতাস”, “বিদায় কোন্নগর”, “তিনে তিনে চাপা চু”, “মাগো, আমার মা”, “দীঘার কবিতা”, “৩১ মার্চ ১৯৯২”, “অবলম্বন”, কবিতার জন্ম”, অনন্ত কুয়াশা”, অনূদিত কবিতা”, “আত্মখনন” এবং একটি গদ্যের বই “কবিতার ঘরবাড়ি” প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী উচ্চারণে তাঁর কবিতার স্বর আলাদা করে চেনা যায়। বাউলের মরমিয়া সুরে হৃদয়ের বাঁশি আপনা থেকেই বেজে ওঠে। কোনও মনীষীলোকের শান্ত স্নিগ্ধ ব্যাপ্তি আত্মকথনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। সীমাহীন অস্থিরতাকে তিনি ভাষা দিতে চান। প্রেম ও বিষাদ, স্বপ্ন ও যন্ত্রণাকে রূপান্তরের মাধুর্যে ও মিশ্রণে শিল্প করে তোলেন। সত্যসন্ধানী দার্শনিকের মতো কোনও প্রত্যয়ী শাশ্বতীর কাছে পৌছাতে চান ;  কিন্তু বারবার ফিরেও আসেন নিজের কাছে —  আত্মখননে –—

“পা বাড়ালে রাস্তা নেই চৌকাঠ পেরিয়ে
হাত বাড়ালে বন্ধু নেই রাস্তার ওপারে
রাস্তার শেষে কী আছে বন্ধুর ঠিকানা
জানি না। জানি না।”

এক অবিমিশ্র সংশয় কবিকে তাড়া করেছে। মানবিক শুশ্রূষা আর আত্মিক শুশ্রূষা চেয়েছেন কবি। সংসারের অসংখ্য বন্ধন মাঝেও নিজেকে বাউল করে সহজিয়া আয়নায় মুখ দেখেছেন। বহুমাত্রিক জটিল প্রেক্ষিত থেকে জীবনের সৌন্দর্য খুঁজেছেন। টান টান পয়ার, মাত্রা নির্ণয়, ভাঙা-গড়ায় ছন্দ সচেতন কবি দক্ষ নাবিকের মতো তাঁর কাব্যতরণি ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। অসম্ভব দরদি আর নরম মনের মানুষ বলেই কবিতার সঙ্গে তাঁর অন্তরের একটা যোগ ঘটেছে। মাটি-অন্ন-আকাশকে আপনার বিচরণের সীমানায় বেঁধেছেন। বীরভূম ও কবিরুল নামটি তাই আজ একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।

প্রকৃত কবির পথ চলা তো মৃত্যুর পরই শুরু হয়। সুতরাং বেঁচে থাকাও মৃত্যুর পরেই। জীবনের প্রতিধ্বনি সীমাহীন। মাটির কায়া একদিন এই মাটিতেই বিলীন হয়ে যায়। বাউল সাধকরা বারবার একথা বলেছেন। কবিরুল যে চাবি খুঁজেছেন তা জীবনের চাবি। প্রথম জীবনের কাব্যগুলিতে জীবনরসের ভাঁড়ারের উৎসমুখে কবি পৌঁছাতে চেয়েছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে সংশয় ও আত্মিক সংলাপে অগ্রসর হবার প্রেরণা। কিন্তু পরবর্তীতে এই জীবনরসায়নকে তিনি বাউল ও দর্শনে পরিমার্জন করতে চেয়েছেন। তখন এক সর্বব্যাপী নির্জনতা, আক্মবোধের সীমাহীন ক্ষেত্র কবিকে টেনে নিয়ে গেছে। অনুভূতির শব্দবাহী পর্যটনকে কবি স্বাগত জানিয়ে লিখেছেন :

“মুখের ভাষা বন্ধ যদি
হৃদয় জেগে ওঠো।”

আত্মখননে হৃদয় তো জাগবেই। রক্ত-মাংস কাম-কলা আর শিরা-উপশিরা নয়, বাউলের দেহতত্ত্ব তো আত্মদর্শনেরই নানা রূপ। সেখানে মান-অভিমানের সঙ্গে থাকে শূন্যতা ও আকুলতা। মনের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এই মনের মানুষ যে কবির ভেতরেই বাস করে, দূরে কোথাও নয়, কবির রূপেই তাঁর রূপ, কবির হাতেই তাঁর হাত, কবির কণ্ঠেই তাঁর কণ্ঠ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। “আত্মখননে” এই দর্শনই বারবার উঠে এল। কবি লিখলেন :

“গাঁইতি-শাবলে
নিজেকে খনন করি শুধু
হয়তো তোমাকে তা স্পর্শও করে না কিন্তু
আমি হাতে-নাতে ধরা পড়ি
জলের গভীর থেকে হঠাৎ যেমন মায়াবী বঁড়শিতে
মাছ উঠে আসে
সে-সময় তোমার অস্তিত্ব আমি এক জেদে উপেক্ষা করি
ভুলে যাই
কিন্তু কী আশ্চর্য তুমি হাঁটুমুড়ে
আমার ভিতরে ঢুকে পড়ো।”

ঘরের মধ্যে পড়শি বসতের মতনই কবির দ্বৈত সত্তা, আলাদা হয়েও একই শরীরে ধরা দেয়। কবি কথা বললেও বুঝতে পারেন :

“আমার গলার স্বরে তোমার আওয়াজ”

এভাবেই বাউল সাধনায় যেমন এক আশ্চর্য যোগ ঘটে নিজের সঙ্গে অন্যের, মানুষের সঙ্গে মানবেরও সেই যোগ। তখনই তো Manও Human হয়ে যায়। অন্ত হয়ে যায় অনন্ত। টি এস এলিয়ট হয়তো এই কারণেই সময়কে খণ্ডিত করেননি। অতীত বা ভবিষ্যৎ বলেই তাঁর কাছে কিছু ছিল না। প্রবহমান বা শাশ্বত বর্তমান বলেই তিনি ভেবেছিলেন : “Measures time not our time, rung by the unhurried.” আর এই কারণেই কবিরুল হৃদয়কে জাগিয়ে দিয়ে লিখলেন :

“মৃত্যুর এ ঘেরাটোপ, এসো পার হই —
এসো আমরা জীবনের দিকে হাঁটি।”

এই অবিরাম, অফুরান হাঁটা । বোধে বোধান্তরে হাঁটা । আমরা আমাদের মধ্যেও এই হাঁটার শব্দ উপলব্ধি করতে পারি।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here