কবীর পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা মহ. ইয়াসিন পাঠান
আজকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় মাননীয় রাষ্ট্রপতি শ্রী শংকর দয়াল শর্মা মহাশয় প্রদত্ত কবীর পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কিছু সংবাদ প্রকাশ হয়েছে , আমি এই ব্যাপারে আমার বক্তব্য তুলে ধরতে চাই।
আমি গত ৪৮ বছর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কংসাবতী নদীর তীরে পাথরা গ্রামের ৩৪ টি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দির সংরক্ষণের কাজে যুক্ত আছি। বাস্তবিক ভাবে যখন গ্রামের মন্দিরগুলি সংরক্ষণ করাতে আমি আগ্রহী হই আমার মূল চিন্তা ভাবনা টা এই ছিল যে আমাদের দেশের ঐতিহ্য আমাদেরকেই সংরক্ষণ করতে হবে এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের অতীত ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। ১৯৭২ সালে আমি মন্দির সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একজন মুসলমান হয়েও এগিয়ে এসেছিলাম তার কারণ হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারটা আদৌ আমার কাছে বিবেচ্য ছিল না অন্যদিকে ছিল প্রবাদ প্রতিম পুরাতত্ত্ব পরিব্রাজক প্রয়াত শ্রী তারাপদ সাঁতরার ভালোবাসা ও উৎসাহ। অল্পবয়সে আমার কাছে তখন ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং তার মাধ্যমে কিছু মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করাই ছিল মূল ব্যাপার। কিন্তু গত ৪৮ বছর ধরে এই বিষয়ে কাজ করে আজ আমি আমার জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি, শরীর ভেঙে পড়ছে, হৃদযন্ত্র , কিডনি প্রায় অকেজো। আবার অন্যদিকে আমি এই পাথরা গ্রামের একজন অসুর বা ভিলেনে পরিণত হয়েছি।
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, এমন হলো কেন ? আসলে আমি এই গ্রামের মন্দিরগুলি সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করি। তাদের কাছে এই অঞ্চলটির কিভাবে উন্নতি করা যায় সেই বিষয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনা জমা করি। উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসাররা গ্রামে আসেন, তাদের মনে হয়েছিল যে হ্যাঁ এটি বাস্তবে সম্ভব। পরবর্তীকালে, মন্দির সংরক্ষণ ও গ্রাম এর সামগ্রিক উন্নতির জন্য সরকারি মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। জমির জন্য চাষিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেটি আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগেকার কথা (১৬ই জুলাই ২০০৩)। এই ১৬ বছরে কংসাবতী নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে ।কিন্তু চাষীরা তাদের প্রাপ্য অর্থ আজও পায়নি অন্যদিকে জমির অধিকারও হারিয়েছে।
আজ অবধি আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে সমস্ত রকম দল ও দপ্তরের কাছে। চাষীদের বিরক্তি রাগ ও ক্ষোভ ক্রমেই বেড়েছে। আসলে গরিব চাষীরা সরকার নয়, হাত এর সামনে আমাকে পেয়ে তাদের বিরক্তি জানায়। ধীরে ধীরে তাদের মনে হয়েছে যে আমি তাদের ভুল বুঝিয়ে জমি অধিগ্রহণ করিয়েছি। চাষীদের চাষের জায়গা কমে আসায় তারা ক্ষতিপূরণের উপর ভরসা করেছিল। অথচ গত ১৬ বছরে তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ এনে দিতে পারিনি। আমি বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে আবেদন-নিবেদন করেছি, বিভিন্ন দলের কাছে বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়েছি কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারিনি এই গরিব মানুষগুলোর জন্য। আজ আমি কারো কাছে ভিলেন, কারো কাছেকাফের।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে যে জীবনের প্রায় পঞ্চাশটা বছর আমি কারোর ভালো কিছু করে উঠতে পারি নি, না পেরেছি কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে। বর্তমান প্রজন্ম আমাকে দেখে হাসাহাসি করে, এটা জানায় যে আমি না নিজের, না বাড়ির,না গ্রামের কিছু ভালো করেছি অথচ সকলের ভালো হবে এই উদ্দেশ্য নিয়েই তো গত পঞ্চাশটা বছর কাজ করলাম।
কোন রকম রাজনৈতিক দলের সাথে নিজেকে যুক্ত করিনি। কোনো রকম মানুষের ধামাধরা কাজ করিনি। আমি সোজা কাজ সোজাভাবে করতে চেয়েছি কিন্তু তার পরিণতিতে মনে হল যে আমার জীবনটা বৃথা এবং তার সাথে এটাও মনে হচ্ছে যে ভারত সরকার আমাকে কবীর পুরস্কারদিয়ে উৎসাহ দেওয়ার মাধমে ভরসা করেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দূত হিসেবে আমি কাজ করবো এবং ভবিষৎ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে তুলবো। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছে চাষীদের মুখে হাসি ফোটানো বা পাথরাকে একটি ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা কোনো ভাবেই আর আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সেই কারণে, আমি দেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করব তিনি যেন আমায় দেওয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বীকৃতি সম্মান ফিরিয়ে নেন।
আবার বলছি আমি কাউকেই ছোট করতে চাইছি না, শুধু মনে হয়েছে যেপথে এই পঞ্চাশটা বছর আমি হেঁটেছি সেই পথ ভুল ছিল। ভাল করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এসে আমি আসলে কারোর ভালো করতে পারিনি। সবার কাছে ছোট ও অপদস্থ হয়েছি।
সবশেষে আরেকবার অনুরোধ করবো, যারাই এই বিষয়ের সাথে যুক্ত আছেন দয়া করে এই গরিব চাষিদের জমি অধিগ্রহণের অর্থ তাদেরকে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে দেখে যেতে চাই যে, আমার কথায় যে চাষীভাইরা তাদের জমি সরকার এর হাতে তুলে দিয়েছিলো তারা তাদের প্রাপ্য পেয়েছে। তাদের ম্লান মুখে হাসি ফুটুক সেটাই আমার শেষ ইচ্ছে ।আপনারা সবাই ভালো থাকুন। নমস্কার। মহ.ইয়াসিন পাঠান। ২৩.০৯.২০১৯।