ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কী তার পূর্ব গরিমা হারাচ্ছে
এম রাজশেখর (১১ জুলাই ২০):- রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আশীর্বাদ ধন্য সদ্য নিহত উত্তরপ্রদেশের কুখ্যাত গুণ্ডা বিকাশ দুবে-র মর্মান্তিক মৃত্যু কাহিনী এই মুহুর্তে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা-কে ঘোরতর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কী তার পূর্ব গরিমা হারাচ্ছে ?আদৌ কি বঙ্কিমের সময়ের আক্ষেপের থেকে বর্তমান সময় কিছুমাত্র পাল্টেছে ? আজ ও কি বিচার কেঁদে ফিরছেনা ?
সাম্প্রতিক অতীতে দক্ষিণ ভারতের বুকে এক ধর্ষণ-এর মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেল বিচারব্যবস্থার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাজ্য পুলিস সাজানো এনকাউন্টার-এর মোড়কে অপরাধীদের নিকেশ করে দিয়েছে।
আবার উত্তরপ্রদেশের আট পুলিস কর্মীর হত্যার ঘটনার পর দশদিন কাটার আগেই বিকাশ দুবে-কে ধরা মাত্র গুলি চালিয়ে মেরে দিলো উত্তরপ্রদেশ পুলিস।
স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় বিরক্ত হয়েই কী কিছু পুলিসকর্মী আইন ব্যবস্থার বিবিধ ফাঁককে কাজে লাগিয়ে তাৎক্ষনিক বিচার ব্যবস্থা শুরু করছে।
নাকি, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়ে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে খোদ পুলিসরাই ?
তবে যাইহোক, একথা অবশ্যই মানতে হবে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা কেউই চাননা। রোমা রঁল্যা তো বলেই গেছেন, “জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইড”।
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা-ই এখন ঘোরতর প্রশ্নের মুখে। অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন সত্যি কী ভারতে বিচার ব্যবস্থা আছে, নাকি সবই চোখে ধুলো দেওয়ার ব্যবস্থা।
বেশ কিছু উপমা দেবার আগে একটা কথা বলতে চাই, পাঠকদের নিশ্চয়ই জানা আছে আইন ও বিচারব্যবস্থা মধ্যে সামান্যতম একটা ব্যবধান আছে।
যেমন ধরা যাক ভারতের কোনো রাজ্যে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও অন্য রাজ্যে মদ বিক্রিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
আবার, কিছু রাজ্যে বেশ্যাবৃত্তির উপর খোলাখুলি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, ভারতের অনেক রাজ্যেই আবার এই বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার বালাই নেই।
এটা হলো ভারতের এক এক রাজ্যের এক এক রকম আইনের গল্প।
সুতরাং এক রাজ্যের বিচারব্যবস্থার কাছে কোনো মদ্যপ সাজার সম্মুখীন হলেও একই দেশের অন্য রাজ্যে সেই মদ্যপ অন্য কোনো ঝামেলায় না জড়ালে একেবারেই নিরাপরাধ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, তোলাবাজী, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুন-এর মতো ঘটনার বিষয়ে ভারতের এক এক রাজ্যের পুলিস এক এক রকম ব্যবস্থা নেয় কোন অধিকারে ?
বলে রাখা ভালো, আইপিসি, সিআরপিসি-র মতো পুলিস ম্যানুয়াল-এর কোথাও পুলিসকে এভাবে ইচ্ছামতো যা খুশি কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিসের বলে বলীয়ান হয়ে পুলিস এহেন কর্মতৎপরতা দেখাবার সাহস পায়। আর বিচারব্যবস্থা এসব সহ্যই বা করে কীভাবে!
এবার পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া কতগুলো ঘটনার বিবরণ দিচ্ছি, যে ঘটনাগুলো ধীরগামী বিচারব্যবস্থার প্রমাণ দিতে অনবদ্য তো বটেই।
১৯৮৪ সালের ঘটনা, কোলকাতা পুলিস-এর ডেপুটি কমিশনার (বন্দর) পদে সবে যোগদান করেছেন বিনোদকুমার দুবে (আইপিএস)। দায়িত্ব নেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই বন্দর এলাকার মাফিয়াদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন এই অসমসাহসী অফিসার৷
১৮ মার্চ বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে নিজের অঙ্গরক্ষী মোক্তার আলী-কে নিয়ে বিনোদকুমার বেলা ১২ টা নাগাদ আচমকা হানা দিয়েছিলেন গার্ডেনরিচ থানার রামানাজন লেনে দুষ্কৃতীদের ডেরায়।
মুহূর্তে মস্তান বাহিনীর কাছে সেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল৷ গলির মধ্যেই বোমা,পিস্তল নিয়ে পুলিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুষ্কৃতীরা৷ আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে প্রতি আক্রমণের যাওয়ার সুযোগই পাননি বিনোদকুমার৷ তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় এক মসজিদে৷ দুষ্কৃতীরা সেখানেও হামলা চালায়৷ বিনোদই ছিলেন তাদের টার্গেট৷ তাঁর অঙ্গরক্ষী মোক্তার নিজের জীবন বাজি রেখে বিনোদকুমার-কে রক্ষা করার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়৷ দুষ্কৃতীরা বিনোদকুমার-এর একটা চোখ উপড়ে, তার একটি পা কেটে দেহ নালায় ফেলে দেয়। মোক্তার আলিও ছাড় পায়না, ওঁকে মেরে আগুনে ফেলে দেওয়া হয়।
ওই ঘটনা নিয়ে পরে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিচারটা আর হয়নি।
সাল ২০১৩, ১২ ফেব্রুয়ারী গার্ডেনরিচ থানা এলাকার এক কলেজ ভোটে ডিউটি দিতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন কোলকাতা পুলিস-এর সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরী।
টিভি’র পর্দায় বারবার দেখানো হয়েছে শাসকদলের স্থানীয় নেতা ইকবাল ওরফে মুন্নার পাশে দাঁড়িয়ে শেখ সুভান-এর গুলি চালানো এবং সেই গুলিতে তাপসবাবুর লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য। তার খুনীরা আজও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
৭ জুন ২০১৩, উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনি গ্রামে ঘটে গেল এক গণধর্ষণের কাণ্ড।
পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে ২০ বছরের এক কলেজ ছাত্রীকে ফাঁকা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে ৯ দুষ্কৃতী।
হ্যাঁ এই ঘটনার একটা নাম কা ওয়াস্তে বিচার হয়েছে। আনসার আলী, আমিন আলী সইফুল, আলী মোল্লা এই তিন জনকে মৃত্যু দণ্ড এবং আমিনুল ইসলাম, শেখ ইমানুল ইসলাম ও ভোলানাথ নস্কর-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।
৩ জুন ২০১৬, যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের বোমাবাজির মুখে পড়ে যান বীরভূম জেলার দুবরাজপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর অমিত চক্রবর্তী।
দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া বোমের স্পিলন্টার পেটে লেগে দুমাস একটা বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৮ জুলাই মারা যান।
এই মামলাতেও কোনো বিচার পায়নি মৃতের পরিবার।
১৩ জানুয়ারী ২০১৬, কোলকাতার রেড রোড-এ সকাল ৬ টার সময় জনৈক বিধায়ক মোহম্মদ সোরাব-এর ছেলে সাম্বিয়া প্রকাশ্য দিবালোকে গাড়ী চাপা দিয়ে মারে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্পোরাল পদমর্যাদার কর্মী অভিমন্যু গোড়-কে।
যতদূর শোনা গেছে, মামলা এখনো অমীমাংসিত।
১৩ অক্টোবর ২০১৭, দার্জিলিং-এর তৎকালীন অবিসংবাদিত নেতা বিমল গুরুং-এর নেতৃত্বাধীন মোর্চার দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া গুলিতে মৃত্যু হয় সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিক (৩০)-এর।
আজও এই অপরাধের কিনারা তথা বিচার হয়নি।
একদিকে দক্ষিণ ভারতের ঘটনা, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের ঘটনা পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা-ই এখন ঘোরতর প্রশ্নের মুখে। অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন সত্যি কী ভারতে বিচার ব্যবস্থা আছে, নাকি সবই চোখে ধুলো দেওয়ার ব্যবস্থা।