রামকৃষ্ণ ও তাঁর সাধিত ৬৪ তন্ত্র
এম রাজশেখর (১৭ অক্টোবর ‘২০):- উনবিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালী ধর্মগুরু রূপে বিশ্বন্দিত গদাধর চট্টোপাধ্যায় ওরফে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস।
১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার কামারপুকুরে তাঁর জন্ম হয়।
মহাকালের কালস্রোতে অগ্রজ রামকুমারের সাথে তিনি কোলকাতায় এসে ঝামাপুকুর অঞ্চলে মিত্রবাড়ি-তে গৃহদেবতার নিত্যপূজারী রূপে নিয়োজিত হন। পরে অগ্রজের মৃত্যু হলে রামকৃষ্ণ অবিবাহিত অবস্থায় দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত ভবতারিণী কালী মা’য়ের মন্দিরে দেবীপুজোর ভার গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিবাহ সমাপনান্তে কোলকাতায় ফিরে আসার পর তিনি যে যে সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল তন্ত্র সাধনা।
যোগেশ্বরী ভৈরবী-র সান্নিধ্যে এবং নির্দেশে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে রামকৃষ্ণ বিষ্ণুক্রান্তায় প্রচলিত ৬৪ টা পৃথক তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো ভারতকে তিনটে পৃথক খণ্ডে ভাগ করে বহুপূর্ব থেকেই এখানে তন্ত্রশাস্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
ভারতের পূর্ব, উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের শিক্ষা তথা শিক্ষণ অধিবিভাগ ‘বিষ্ণুক্রান্তা’ রূপে পরিচিত।
এই অধিক্ষেত্রের মধ্যেই রয়েছে শ্রীক্ষেত্র (পুরী), কালীঘাট, তারাপীঠ, কামাক্ষা-র মতো জাগ্রত শক্তিপীঠ। রয়েছে তারকেশ্বর, বক্রেশ্বর, বৈদ্যনাথ-এর মতো শৈবতীর্থ।
অনেকেই আলোচনার সময় বিভিন্নভাবে বলে থাকেন রামকৃষ্ণ তাঁর জীবদ্দশায় ৬৪ তন্ত্রের সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছিলেন।
কিন্তু রামকৃষ্ণ ঠিক কী কী তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন তা অনেকেই জানেননা।
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে দেওয়া উচিত ভৈরবী যোগেশ্বরী-র কাছ থেকে রামকৃষ্ণ ‘বিষ্ণুক্রান্তা’-য় প্রচলিত ৬৪ টা নির্দিষ্ট তন্ত্রেরই সাধনা করেছিলেন।
ভৈরবী যোগেশ্বরী-র সহায়তায় রামকৃষ্ণ উত্তর, কামধেনু, কামাক্ষা, কালীতন্ত্র, কালীবিলাস, কুব্জিকা, কুমারী, কুলচূড়ামণি, কুলদ্দীশ, কুলপ্রকাশক, কুলার্ণব, কুলামৃত, ক্রিয়াসার, গণেশবিমর্ষিনী, গন্ধর্ব, গবাক্ষ, চামুণ্ডা, জ্ঞানার্ণব, তন্ত্রচিন্তামণি, তন্ত্ররাজ, তন্ত্রান্তর, দেবপ্রকাশ, দেবাগ্যম, দেবীকল্প, দেবীপ্রকাশ, নবরত্নেশ্বর, নিত্যতন্ত্র, নিবন্ধ, নিরুত্তর, নীলতন্ত্র, ফেৎকারী, বারাহী, বিশুদ্ধেশ্বর, বিশ্বসার, বৃহৎ শ্রীক্রম, ব্রহ্মযামল, ভাবচূড়ামণি, ভূতডামর, ভৈরব, ভৈরবী, মহাকাল, মৎসসুক্ত, মায়াতন্ত্র, মালিনীবিজয়, মুণ্ডমালা, যামল, যোগিনী, যোগিনীহৃদয়, যোনী, রাধা, রুদ্রযামল, ললিতা, শিবাগম, শ্রীক্রম, সনৎকুমার, সময়াচার, সম্মোহন, সুকুমুদিনী, সিদ্ধসার, সিদ্ধিযামল, সিদ্ধিশ্বর, সিদ্ধিসারস্বত, স্বতন্ত্র, হংস মহেশ্বর নামের আলাদা আলাদা ৬৪ টা তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেন।
যদিও কিছু কিছু গবেষকদের মতে ‘তন্ত্রান্তর’-এর বদলে ‘যোগার্ণব’ হবে।
আজ এই ৬৪ টা তন্ত্রগ্রন্থের মধ্যে অনেকগুলোই আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়না বা বাজারে অমিল।
এর পেছনে একদিকে যেমন রয়েছে তন্ত্রশাস্ত্রর উপর সাধারণ মানুষের অমূলক ভয়, তেমনই রয়েছে কিছু বিরূপ প্রচার। আর এই দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক পীঠস্থান কোলকাতাতেও আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এই ৬৪ টা তন্ত্র পুস্তক।
রামকৃষ্ণ নিজে ৬৪ তন্ত্রে পারঙ্গম হয়েও বিভিন্ন সময় তাঁর দর্শনার্থী ভক্ত ও শিষ্যদের বলতেন “তন্ত্রের পথ ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল..”। এই ধরণের কিছু বক্তব্যও শিক্ষিত মানুষকে কিছুটা হলেও তন্ত্রবিমুখ করেছে।
যেকোনো শাস্ত্র ততদিন সমাজে প্রচলিত থাকে যতদিন তার উপযুক্ত চর্চা হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগের সীমাহীন ঔদাসীন্যর কারণে দেশে পঞ্চম বেদ রূপে পরিগণিত তন্ত্রশাস্ত্রটাই আজ এই অঞ্চল থেকে লোপাট হবার জায়গায় চলে এসেছে।
তবে চারদিকে ঘণীভূত গাঢ় অন্ধকারের মাঝে আশার আলো এটাই যে আসাম সরকার স্নাতকোত্তর স্তরে তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কিত গবেষণা করার সুযোগ প্রদান করেছেন।