বিদ্যাসাগর চেতনায় শিক্ষাব্রতী রোকেয়া

0
1946
Begum Rokeya
Begum Rokeya
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:23 Minute, 7 Second

বিদ্যাসাগর চেতনায় শিক্ষাব্রতী রোকেয়া

প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়,

রোকেয়া অর্থ জ্যোতির্ময়ী। তিনি বিদ্যাসাগর চেতনার মানুষ। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ চিন্তার রূপায়ণে কেবল মুসলমান সমাজে নয়, সারা ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি সার্থক সামাজিক আন্দোলনের দিশারী, সর্বজনের সর্বকালের প্রেরণা। “লতা যেমন আপনিই আলোকের দিকে উন্মুখ হইয়া থাকে, যতই বাধা পাক তবুও সেইদিকেই তার গতি- এই নারীর জীবনে তেমনি সত্য ও সুন্দরের প্রতি একটি অনিবার্য্য প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়” তাঁর প্রসঙ্গে লিখেছেন মোহিতলাল মজুমদার।

Begum Rokeya
Begum Rokeya

স্বশিক্ষিতা রোকেয়ার জন্ম আনুমানিক ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০ সালে রংপুরে মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে শিক্ষিত জমিদার পরিবারে। সেকালের ধারায় তাঁর পরিবারও ছিল নারীশিক্ষা বিরোধী। আকুল আগ্রহে সবার অগোচরে স্বগৃহে শুভার্থীদের সহায়তায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন। সম্ভবতঃ ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে তাঁর বিবাহ হয় উচ্চশিক্ষিত, বিপত্নীক ও ডায়াবেটিক প্রৌঢ় স্বামী ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এর সাথে। বিবাহকালে সাখাওয়াত ছিলেন ওড়িশার কটকে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কণিকা রাজ এষ্টেটের কোর্ট অব ওয়ার্ডস (নাবালক রাজার অভিভাবক পদে সরকার নিযুক্ত কর্মাধ্যক্ষ)।

কটকে তখন সদ্যপ্রয়াত বিদ্যাসাগর চেতনায় ব্রাহ্মসমাজ নারীশিক্ষা প্রচলনে ব্রতী। এই যুগকে ‘ওড়িশার স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। ব্রাহ্মসমাজ সভাপতি মধুসূদন রাও এর ভাইঝি ও সম্পাদক সাধুচরণ রায়ের তরুণী স্ত্রী রেবা রায় ১৮৯২ সালে প্রথম ওড়িয়া ভাষায় মহিলা পত্রিকা ‘আশা’ প্রকাশ করেন। তাঁর আহ্বানে রোকেয়া ব্রাহ্ম মহিলা সভায় যোগ দিয়ে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রচেষ্টায় যুক্ত হন। ১৮৯৮ সালে তিনটি সন্তান সহ মাত্র বাইশ বছরে রেবা রায় বিধবা হয়েছিলেন। তবুও তিনি ১৯০৫ সালে কটকে প্রথম আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর তিনটি সন্তানই উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত হন। নারী শিক্ষা ও মানবাধিকার প্রচলনের সমাজকর্ম যোগ দিয়ে রোকেয়ার চিন্তা চেতনায় ব্যাপ্তি ঘটে। ভাগলপুরে ফিরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সমাজ কল্যাণের লক্ষ্যে রচিত প্রবন্ধে এর পরিচয়।

জমিদার তনয়.ও রাজকুমারদের শিক্ষার জন্য বৃটিশ সরকার ১৮৫৫ সালে কলকাতার মানিকতলায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রর পরিচালনায় ওয়ার্ড ইন্সটিট্যুট স্থাপন করে। উদ্দেশ্য ধনী সন্তানদের বৃটিশ সরকার অনুরাগী করা। বিদ্যাসাগর ১৮৬৩ সালে এই প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শক মনোনীত হয়ে পঠন পাঠন ও শিক্ষণ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করেন। তাঁর দুই ছাত্র শ্রীকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ও ব্রাহ্ম ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী ওড়িশায় শিক্ষক রূপে প্রেরিত হন। ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী ওড়িশায় বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শনের রূপকার। তাঁর শিক্ষায় ধনীর সন্তানের বিলাসিতা ও শিকার করা ছেড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে মনোনিবেশ করতে থাকে। তাঁর উদ্যোগে ও সাখাওয়াতের নির্দেশে কটকে রাভেন’শ কলেজের গ্রন্থাগার ‘কণিকা লাইব্রেরী’ স্থাপিত হয়। বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শন রোকেয়ার মননে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

সাখাওয়াত ১৮৯৯ সালে ডিভিসনাল কমিশনার স্টুয়ার্ট ম্যাকফারসনের ব্যক্তিগত সহকারী রূপে ম্যাজিষ্ট্রেট পদে নিজ জন্মস্থান ভাগলপুরে বদলী হন। শৈশবে পিতৃহারা সাখাওয়াত দরিদ্র বিধবা মায়ের ইচ্ছায় ভাগলপুরে তাঁদের আত্মীয় খলিফাবাগের সৈয়দ শারাফাত হোসেনের কন্যাকে বিবাহ করেন। ঐ এলাকায় শ্বশুরের দান করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে তিনি বাস করতেন। রোকেয়াকে বিবাহ করার আগে নিজের মাতৃহীনা কন্যার বিবাহ দেন বি.এ পাশ সৈয়দপাত্রের সাথে। জামাতাটি ঘোর নারীশিক্ষা বিরোধী। সাখাওয়াত বাড়ি, জমি শ্বশুর পরিবারকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছুক হন। গৃহকর্ত্রী রসুলবাদী বেগম দান করা সম্পত্তি ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে, বাড়িটি তিনি বিবাহিতা মেয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। ভাগলপুরে রোকেয়ার শ্বশুর পরিবার শিয়া, তাঁর জন্ম সুন্নী পরিবারে। বিরূপ রক্ষণশীল পরিবেশে তাঁর সমাজকর্ম বন্ধ হয়। অসুস্থ স্বামীর নিপুণ সেবা ও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে তিনি সব বাধা জয় করেন। শ্বশুরবাড়িতে ব্যক্তিত্বময়ী রসুলবাদী বেগমের সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দুই বড় ভাই হরেন্দ্রলাল ও জ্ঞানেন্দ্রলাল তখন ভাগলপুরবাসী। তাঁদের সম্পাদিত নবপ্রভা পত্রিকায় ১৯০২ সালে রোকেয়ার লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভাগলপুর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এ হরেন্দ্রলাল প্রথম সভাপতি। নিজের কলেজে বৃত্তি সহ সাখাওয়াৎ দ্বিজেন্দ্রলালকে ইংলন্ডে কৃষিবিদ্যা পড়তে পাঠান। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল বিহারে তাঁর অধীনে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন।

১৯০৫সালে সরোজিনী নাইডুর India’s Ladies Magazine এ রোকেয়ার ইংরাজী রচনা “Sultana’s Dream” প্রকাশিত হয়। এই রচনায় সৌরশক্তি ব্যবহার করে পরিবহণের সম্ভাবনার কথা লেখা। শিক্ষিত মহলে রোকেয়া চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক পরিচিতি লাভ করেন। সেকালের শ্রেষ্ঠ পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে। তিনি ইংরাজী, ফারসী, ওড়িয়া ও উর্দুভাষা শিখলেও প্রধানতঃ বাংলাভাষায় লিখেছেন। তখন সম্মিলিত বাংলা, বিহার, উত্তর ওড়িশা ও পশ্চিম অসম নিয়ে ছিল একটিই রাজ্য ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী’। এর পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তর ছিল ভাগলপুর। এখানে শিক্ষাবিভাগের দায়িত্বে থেকে ডেভিড হেয়ারের ছাত্র ভূদেব মুখোপাধ্যায় হিন্দী, ওড়িয়া ও বাংলা মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম করেন। বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ও ওবেদীর শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে রোকেয়ার পরিচয় ছিল। রোকেয়ার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘মতিচুর’ এবং বিজ্ঞান,পরিবেশ চেতনা সমৃদ্ধ ইংরাজী রচনা “ Sultana’s Dream’ ভাগলপুর বাসকালে প্রকাশিত হয়। এসময়ে এখানে তাঁর দুটি কন্যাশিশু জন্মের মাত্র চার ও পাঁচমাস পরে মারা যায়।

ডায়াবেটিস রোগে সাখাওয়াৎ ক্রমশঃ শয্যাশায়ী ও অন্ধ হয়ে গেলে রোকেয়ার লেখালেখি বন্ধ হয়। বঙ্গবাসী কলেজ প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র বসু ইংলন্ডে সাখাওয়াৎ এর একই কলেজে বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা পড়েন। তাঁর পরামর্শে চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় আনা হয়। চিকিৎসা ও রোকেয়ার প্রাণপন সেবা ব্যর্থ করে ১৯০৯ সালে ৩রা মে ৩০ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের বাড়িতে সাখাওয়াতের জীবনাবসান হয়। সেদিন তাঁর শবদেহ ভাগলপুরে নিতে শোকার্ত রোকেয়ার সঙ্গী ছিলেন অন্তঃস্বত্ত্বা ছোটবোন হোমায়েরা। পরদিন খলিফাবাগে পারবারিক সমাধিস্থলে দুই শিশুকন্যার কবরের পাশে তাঁর সমাধি হয়।

খলিফাবাগের বাড়িতেই ৩রা সেপ্টেম্বর হোমায়েরার একমাত্র পুত্র আমীর হোসেন চৌধুরীর জন্ম। পরে নজরুল গবেষক ও দাঙ্গাশহিদ হিসাবে তিনি সর্বজনবরেণ্য হয়েছেন। ১লা অক্টোবর থেকে ঐ বাড়িতেই রোকেয়া প্রাথমিক স্কুল শুরু করেন। কন্যা জামাতার প্রবল আপত্তিতে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়।

সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের বন্ধু ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সৈয়দ আবদুল মালিক নিজ সরকারী বাসভবন ‘গোলকুঠি’তে রোকেয়া ও তাঁর সাথীদের বসবাস এবং স্কুলের ব্যবস্থা করে ডিভিসনাল কমিশনার স্টুয়ার্ট ম্যাকফারসনের সম্মতি সংগ্রহ করেন। স্টুয়ার্ট স্বয়ং এসে ঐ কোয়ার্টারের একটি অংশ ব্যাবহারের লিখিত অনুমতি পত্র রোকেয়াকে দিয়ে যান। তিনি Sultana’s Dream পড়ে রোকেয়ার প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলেন।শিক্ষানুরাগী এই উচ্চপদস্থ আমলা ১৯১১ সালে নবগঠিত বিহার-ওড়িশা রাজ্যের শিক্ষাসচিব ও ১৯২৯ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন।

গোলকুঠিতে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে স্কুল শুরু করেও তাঁর স্বস্তি ছিলনা। জামাতার অপপ্রচারে নতুন কোন ছাত্রী ভরতি হয়নি। সৈয়দ আবদুল মালিকের পরামর্শে তিনি শিক্ষাপ্রসরের মাধ্যমে আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ভাগলপুর ত্যাগ করে ৩রা ডিসেম্বর ১৯১০ সালে স্বল্পপরিচিত কলকাতায় এলেন। সঙ্গে শিশু আমীর হোসেন চৌধুরীকে কোলে নিয়ে ছোটবোন হোমায়েরা। তারপর নব ইতিহাস। লোকবল,অর্থবলছাড়া কিভাবে আদর্শ আর অটুট মনোবল সম্বল করে এক শিক্ষাবঞ্চিত স্বামীহারা, সন্তানহারা মহিলা সর্বজন সহ সমাজমঙ্গল করেন, তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত রোকেয়ার সংগ্রাম।

১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ তালতলা অঞ্চলে দুটি ঘর নিয়ে তাঁর স্কুলের যাত্রা শুরু। ১৪ নং রয়েড স্ট্রিট ব্যারিষ্টার আবদুর রসুলের বাড়িতে ২রা এপ্রিল স্কুলের পরিচালন সমিতি গড়ে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল নামকরণ হয়। সম্পাদক হন মৌলভী আহমদ আলি। তিনি রোকেয়ার বড়ভাই ইব্রাহিম সাবের ও সাখাওয়াৎ উভয়েরই পরিচিত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই রোকেয়ার এই বিবাহ হয়েছিল।পরিচালনসমিতির সিদ্ধান্তে অভিজাত মুসলমান কন্যাদের জন্যই স্কুলটি হয়। সরকারী সাহায্য লাভের পড়ে, অমুসলমান উর্দুভাষী সরকারীকর্মীর কন্যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

স্কুল ছাত্রীনিবাস গড়ে দু’ তলা বড় বাড়ি ৮৬ এ লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে ১৯১৬ সালে রোকেয়া ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বাংলা বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলমান মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থার কর্মধারা যুগান্তর আনে। প্রথম সভানেত্রী শ্রীহট্টের শিক্ষাবিদ মৌলবী আবদুল করিমের স্ত্রী আয়েষা খাতুন, রোকেয়া স্বয়ং সম্পাদক। সভা, সমিতি গড়ার কাজে রক্ষণশীল মুসলমান মহিলারা যুক্ত হন। তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে সোৎসাহে দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার উন্নয়নে ব্রতী হলেন। মরা গাঙে, নিস্তরঙ্গ নদীতে জোয়ার এল।

১৯১৭ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে সভানেত্রী মনোনীত হলেন অ্যানী বেসান্ত। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ উদ্যোগে মহিলাদের পৃথক সভা হল। কলেজ স্কোয়ারে থিওসফিক্যাল সোসাইটি হলে আয়োজিত এই রাজনৈতিক সভায় সভা পরিচালনায় ছিলেন অ্যানী বেসান্ত ও সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে বি. আম্মা, আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের মা। বি. আম্মা থাকায় মুসলমান মহিলাদের সভায় যোগ দিতে সুবিধা হয়। সেখানে মুসলমান মহিলা সমিতি’ স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায়। মূল কংগ্রেস অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি বৈকুন্ঠনাথ সেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ এর ভূমিকার প্রশংসা করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দ্বার খোলা শুরু হল। সভা সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান অমলা দাস গাইলেন ‘তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি’।
রোকেয়ার নিখিলবঙ্গ মুসলমান মহিলা সমিতির কর্মধারার অভিমুখ ছিল বস্তীতে বস্তীতে মহিলা ও শিশুদের জন্য স্কুল স্থাপন। মুসলমান মেয়ে, প্রথাবঞ্চিত স্বশিক্ষিতদের জন্যও প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের দাবী তিনি নিরন্তর করেছেন। প্রেসিডেন্সী ও বর্ধমান ডিভিশনের স্কুল ইন্সপেকট্রেস হৃদয়বালা বসু (হামিদা মোমিন) তাঁর দাবীর সমর্থনে সরকারকে নিত্য সচেতন করতেন। বিদ্যাসাগর শতবর্ষে বৈকুন্ঠনাথ সেন এর সহায়তায় রাজাবাজারে রাণী স্বর্ণময়ী রোডে রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দানে দ্বিতল বাড়িতে মুসলমান মহিলাদের আবাসিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল হল। মিস চৌধুরী, মিস মাধুরী ম্যামগাইন অধ্যক্ষা এবং উমরাতন বিবি, এম, ফাতেমা খানম, সুফিয়া কামাল, নুরুন্নেসা সাত্তার, এতিমা খাতুন প্রমুখ প্রখ্যাত শিক্ষিকা এখানে পড়ে শিক্ষাব্রতী হয়ে জাতিগঠন করেন।

মুসলমান নারী শিক্ষিকা প্রশিক্ষণের এই স্কুলের পাঠক্রম রচনা করেন হামিদা মোমিন। ফজলুল হকের অনুরোধে সেটি পরিমার্জনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। নারী শিক্ষিকা মিলতেই সারা বাংলায় মুসলমান পরিবারের উদ্যোগে স্কুল স্থাপন হতে থাকে। অধিকাংশের ভিত্তি স্থাপন করেন ফজলুল হক।
থিওসফিষ্ট মারগারেট কাজিন্সের আহ্বানে নারী ভোটাধিকার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি ৮ নম্বর রিপন স্ট্রিটে রোকেয়ার উদ্যোগে সারা ভারত মুসলমান মহিলা সম্মেলন হয়। প্রায় ছয়শ’ মুসলমান মহিলার উপস্থিতিতে তাঁর আহ্বানে স্কুল স্থাপন ও নারী ভোটাধিকারের সমর্থনে মুসলমান সমাজে সাড়া জাগে। তখন ইংলন্ডেও মহিলাদের ভোটাধিকার ছিলনা। নারী ভোটাধিকার দাবীতে কবি কামিনী রায় সভানেত্রী,যুগ্ম সম্পাদিকা রোকেয়া অনুগামিনী সাকিনা সুলতানা মুয়ায়েদজাদাফারুকী M.A,B.L,কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম মুসলমান মহিলা আইনজীবী। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে অনেক নবাব, রাজা, জমিদারের বিরোধিতায় দাবী অগ্রাহ্য হয়। রোকেয়া ক্ষুব্ধ হয়ে বিখ্যাত ব্যঙ্গ কবিতা “আপীল” লেখেন। মুসলিম সদস্যদের মধ্যে ফজলুল হক,
গজনভী প্রমুখ সমর্থন করলেও সুহারাওয়ার্দি দুই মামাভাগ্নে বিরুদ্ধে মত দেন।আইনবিদ সাকিনা সুলতানা হাইকোর্টে ব্যরিষ্টার সুহারাওয়ার্দির কাছে কৈফিয়ৎ দাবী করেন। তাঁর লঘু মন্তব্য “নারীরা কি এমন করেছে যে ভোটাধিকার দাবী করে”। ক্ষুব্ধ সাকিনা সুলতানা প্রত্যুত্তর দেন, “নারীদের সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত রেখে তোমরা কি করে আশা কর যে তাঁরা সমাজে অবদান রাখবে? আমরা তো সাখাওয়াত স্কুল ছাড়াও বস্তীতে স্কুল করেছি। তোমরা নারীদের শিক্ষাবঞ্চিত রেখে কোন যুক্তিতে নিজেদের মুসলমান বল, মুসলমান পরিচয়ে ভোট দাও?” বস্তী স্কুলের কথা শুনে আইনজীবী মহল বিস্মিত হন। কর্পোরেশন মেয়র চিত্তরঞ্জন দাস, ডেপুটি মেয়র সুহারাওয়ার্দি নির্বাচিত হতে কর্মাধ্যক্ষ হন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁরা বিদ্যাসাগরের প্রদৌহিত্র ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে এডুকেশন অফিসার নিযুক্ত করেন। তিনি ক্রমশঃ ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ পরিচালিত স্কুল অধিগ্রহণ করে কর্পোরেশন স্কুলের যাত্রার সূচনা করেন।

রোকেয়া সকল সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে মানবাধিকার আর পরিবেশ রক্ষার শুভকর্ম প্রসারে মিলিত হতে পারে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাঙালির যা কিছু সুন্দর প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর কল্যাণস্পর্শ অনুভব করা যায়। তাঁর সম্পর্কে গবেষণা করার আকাঙ্খায় ২০১৮ সালে রোকেয়া দিবসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলকাতার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে ‘রোকেয়া গবেষণা কেন্দ্র’ ও তাঁর প্রিয় ছাত্রী আনোয়ারা বাহার চৌধুরীর শতবর্ষে তাঁর অবদানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আনোয়ারা নামাঙ্কিত হল হয়েছে। গবেষণা কেন্দ্রটি যথাযথ ভাবে রূপায়িত হলে মঙ্গল।

সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের শতবর্ষে ইংলন্ডের আন্তর্জাতিক খ্যাত নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান “রোজ ব্রাফোর্ড কলেজ অব থিয়েটার এ্যন্ড পারফরমেন্স” তাঁদের ‘রোকেয়া’জ ড্রীম’ প্রকল্প নিয়ে স্কুলে, রবীন্দ্রভারতী,বিশ্বভারতীও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য কর্মশালা ও আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। বিদেশী ছাত্রীরা গভীর বিশ্বাসে ঘোষণা করেছেন, “The best voices of peace from South Asia are Buddha, Gandhi, Rabindranath and Roquiah”.
রোকেয়াকে জানা আমাদের ফুরাবে না।

লেখক : প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়,
সাধারণ সম্পাদক-রিভার-রোকেয়া ইন্সটিট্যুট অব ভ্যালু এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চ। যতীন্দ্রমোহন এ্যাভেন্যু. সোদপুর ৭০০১২৮
আহ্বায়ক, বিদ্যাসাগর- রোকেয়া গবেষণা ও চর্চা কেন্দ্র, ফেডারেশন হল (মিলন মন্দির)
২৪৩/২/১ আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, কলকাতা ৭০০০০৯

Collected by :Faruque Ahamed

About Post Author

Antara Tripathy

Chief Editor & CEO of IBG NEWS (09/Aug/2018-Present), Secretary of All Indian Reporter's Association,West Bengal State Committee. Earlier Vice President of IBG NEWS (01/Jan/ 2013-08/Aug/2018). She took over the charge from the Founder Editor of the Channel.
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here