Read Time:4 Minute, 46 Second
আজও মানুষ হতে পারিনি
তৈমুর আলি খান
আমার প্রকৃত নাম যে তৈমুর আলি খান তা যাঁরা আমার স্কুল সার্টিফিকেট না দেখেছেন তাঁরা জানেন না। আমি লেখার ক্ষেত্রে শুধু তৈমুর খান নামটিই ব্যবহার করি। আজ বিখ্যাত ফিল্ম স্টারের সন্তানের নাম নিয়ে কত হইচই শুরু হয়েছে। তৈমুর লঙ্ নাকি খুনি নিষ্ঠুর সন্ত্রাসী ছিলেন। এই হিসেবে ইতিহাসে একটা মিথও সৃষ্টি হয়েছে। তৈমুর নাম নিয়ে আমার ক্ষেত্রেও কম অপমান জোটেনি। আমার নাম শুনে খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা মুখ বেঁকাননি। আমার নাম নিয়ে একবার চাকুরির ইন্টারভিউ বোর্ডে খুব হাসাহাসিও হয়েছিল। তারপর ওঁরা জানতে চেয়েছিলেন, আমার আদি বাসস্থান কোথায়। আমার মাতৃভাষা যে বাংলা তা বিশ্বাসই করতে চাননি।
বাবাকে আমার এই নামকরণের জন্য একবার জিজ্ঞেসও করেছিলাম। বাবা বলেছিলেন ” ইতিহাস পড়তে পড়তে নামটি পাই। নামটিতে আমাদের মনোবল বাড়ে। ছেলেকে কোনো দুর্ধর্ষ মানুষের নামে ডাকব আর আমাদের চারপাশের দুঃখগুলি ঝন্ঝন্ করে ঝরে পড়বে এটাই তো চাই। ” আমার জীবনের সংঘাতময় দিকটির কথা যখন ভাবতে বসি তখন মনে হয় আমার এই নামটিই সার্থক। ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ১৬ বছর বয়সেই কপর্দকশূন্য জীবনে একাই মুম্বই পালিয়ে যেতে হয় রোজগারের জন্য। সেখানে মোট বয়ে বয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে হয়। রাস্তার টাইমকলে জল খেয়ে রাত্রে রাস্তায় চট পেড়ে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়।
বি এ বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়ার সময় ” স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো ” গল্প লিখে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে প্রহার খেতে হয়। ২০০০ সালের বন্যায় চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সাঁইথিয়া পার হয়ে আহমদপুরে তিনদিন প্রায় অনাহারে কাটাতে হয়। তবু নিজেকে নিজের কাছে বসাই।
মুম্বই এর রাস্তায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম —
কত পাখি আর পাখিদের চিৎকার
আমাকে সংকেত দেয় অন্য জীবনের
আলোরা স্তন হয়ে ঝুলে আছে
ছায়ারা আঁধারে করে লুটোপুটি
নির্বিকার পথের সম্রাট…..
আমি তো পথের সম্রাট। আমার চারিপাশে কত কত নারী পুরুষও শুয়ে থাকে। অনেক রাতে তাদের প্রকাশ্য মৈথুন দেখি। আবার অনেক রাতে নিঃশব্দে দামী দামী গাড়ি এসে মাথার কাছে দাঁড়ায়। কত কত যুবতীদের গাড়িতে তুলে নেয়। আবার ভোরবেলা তারা ফিরেও আসে। মাঝে মাঝে বলতে শুনি ” লে তোরা যত পারিস লে ! শরীলটোই তো লিবি! হামি টাকা পেলেই হলো! ” সেই টাকা তারা গ্রামের ঠিকানায়ও পাঠাত। আমি এম ও ফর্ম পূরণ করে দিতাম।
আজ তৈমুর নামটি নিয়ে নবাব পরিবারের সন্তান জন্ম নিল। আমি রাস্তার তৈমুর। আমি সারাজীবন অসহ্যের সাথে সহবাস করে চলেছি। না বংশ গরিমা, না অর্থ গরিমা। ভাঙাগড়া জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মানুষ। এই গত ১৯ /১২ /২০১৬ তারিখে ফেসবুকে এক তরুণ প্রজন্মের কবি আমাকে লিখেছে ” বিদেশী নাম নিয়ে তুই আঞ্চলিক ভাষার কবিতাকে অবমাননা করছিস ! তুই কি আঞ্চলিক ভাষা বুঝিস? তোর মতো লোকের এই অকবি সুলভ আচরণ আমরা বরদাস্ত করব না। নিজে তো মানুষ হলি না তাই অন্য কেউকে মানুষ ভাবতে পারলি না।”
এই কথা শুনে মনে হল, আমি শুধু তৈমুর হয়েই আছি, আজও মানুষ হতে পারিনি।
Advertisements