Read Time:9 Minute, 32 Second
সফল অলরাউন্ডার রজতশুভ্র
রজতশুভ্র মজুমদারকে ইদানীং কালের সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য নক্ষত্র হিসেবে উল্লেখ করাই যায়। কবিত ও কথাসাহিত্যে বেশ কিছু স্মরণযোগ্য কাজ করে সকলের নজর কেড়েছেন তিনি। তাঁর রচিত বহু প্রশংসিত কবিতা ‘কাদম্বরী’ অবলম্বনে তৈরি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘কথাছবি কাদম্বরী’ আজ আলোড়ন তুলেছে নেট দুনিয়ায়। আবির্ভাবেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই কবিতা-ছবি। কবির ভাবনাকে কথাছবিতে রূপ দিয়েছেন দোয়েল বড়ুয়া; আর কাদম্বরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মনিকা দে। শুক্তি সরকারের নিখুঁত ইংরেজি অনুবাদে রজতশুভ্রের কবিতা সারা পৃথিবীতে সমাদৃত হয়েছে। কবির সঙ্গে কথা বললেন ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত।
আলাপচারিতায় জানা গেল, রজতশুভ্র মজুমদারের লেখা বেশ কিছু গল্প-কবিতার চলচ্চিত্রায়ন শুরু হয়েছে। তবে তাঁর যে-লেখাগুলি সিনেমাকারদের পছন্দ হয়েছে, বা ছবি করা নিয়ে কথা চলছে, কবি অকপটেই জানালেন, সেগুলি তাঁর নিজের কাছে ততটা তৃপ্তিদায়ক লেখা বলে মনে হয়নি, যতটা তৃপ্তি তিনি পেয়েছেন সেই লেখাগুলি লিখে যেগুলি ছবির জন্য বিবেচিত হয়নি। বেশ কিছু গল্প যে অন্য ভাষায় অনুবাদের কথাও চলছে, সেটাও জানা গেল কথা প্রসঙ্গে। তবে ‘কাদম্বরী’র অভিনব রূপদানে তিনি যে অত্যন্ত খুশি, এবং এই পরিশ্রমী প্রয়াসের এতখানি সাফল্যে তিনি নিজেও যে হতবাক, প্রসঙ্গ তুলতেই লাজুক হেসে তা জানিয়ে দেন রজতশুভ্র।
রজতশুভ্রর কবিতা নিয়ে অজস্র অডিও অ্যালবাম আগেই প্রকাশিত হয়েছে। জয় গোস্বামী কিংবা শুভ দাশগুপ্তকে বাদ দিলে এখনও পর্যন্ত আর কোনও কবির এত কবিতা নিয়ে অডিও অ্যালবাম প্রকাশ পায়নি এটা বলাই যায়। কবির নিজের এ নিয়ে বক্তব্য হল, “হাটেবাজারে বা রাস্তাঘাটে প্রায়শই শোনা যায় যে, অ্যালবামের কোনো বিক্রি নেই। কিন্তু এটা যদি সত্যি হত তাহলে কি ফি-বছর ক্যাসেট কোম্পানিগুলো এমনি এমনি এত কবিতা আর গানের অ্যালবাম বের করত? হার্ড কপির বিক্রি কমছে এটা ঠিক। মিউজিক ওয়ার্ল্ডও উঠে গিয়েছে। কিন্তু অ্যালবামের প্রোডাকশন তো অনেক বেড়ে গিয়েছে! অনলাইন সেল বা ডাউনলোডিংয়ের সূত্রে আর্টিস্টদের বাজার ধরে রাখাটা বজায় থাকছে। আর হ্যাঁ, ইউটিউব একটা সাঙ্ঘাতিক মাধ্যম। মিউজিক ওয়ার্ল্ডের থেকে এর ভূমিকা একটুও কম নয়।” রজতের মতে, ‘অহল্যা’ এই ইউটিউবেরই সন্তান।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, রজতশুভ্রর লেখা কবিতা নিয়ে বর্ষীয়ান ও বরেণ্য অভিনেতা সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি অ্যালবাম ‘তবু মনে রেখো’র বহুল প্রচার ও প্রসারও ঘটেছে এই ইউটিউবের মাধ্যমেই। পাশাপাশি এ-সময়ের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী রূপঙ্করের প্রথম আবৃত্তির অ্যালবামটিও কবি রজতশুভ্রর। এর জন্য কসমিক হারমনির কর্ণধার সুমনের ঊর্বর মস্তিষ্কের প্রশংসাও করলেন তিনি। এই অ্যালবামে গান গেয়েছেন শ্রাবণী সেনের মতো প্রথিতযশা শিল্পী। আবার অন্য একটি টুইন অ্যালবামে রজতের কবিতা পাঠ করেছেন বাংলা থিয়েটারের গুরু-শিষ্য রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও দেবশঙ্কর হালদার। সাগরিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল গান ও পাঠের এক মনোজ্ঞ অ্যালবাম ‘এই যাওয়া তো নয় যাওয়া’। এটিতে রজতের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে আছে শ্রীকান্ত আচার্যের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা এই অ্যালবামের বিষয়বস্তুকে শ্রোতাদের কাছে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। এই অডিও বইয়ের বিষয়বস্তু খুব সুললিত ভাষায় ব্যাখ্যা করলেন রজত, “যাওয়া তো অনেক রকমের হয়, কিন্তু সত্যি সত্যিই আমাদের যাওয়া হয় কি? কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘যাই যাই বললেও সবটা যায় না/কিছু থাকে /তারই নাম জীবন।’ তো ‘চলে যাওয়া’র অভিঘাতে এই ‘থেকে যাওয়া’ জীবনেরই শ্রাব্য ছবি এই অ্যালবামটি। এই কবিতাগুলোয় আমি তিন ধরনের যাওয়াকে দেখাতে চেয়েছি। ভাড়াটিয়ার এক ভাড়াবাড়ি থেকে আরেক ভাড়াবাড়িতে যাওয়া, বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ‘মায়ের মেয়ে’ কিংবা ‘বোনের দিদি’র এক সংসার থেকে আরেক সংসারে যাওয়া এবং, সবশেষে, আমাদের মৃত্যুর কাছে যাওয়া। অবশ্য শেষ বিচারে কোনও যাওয়াটাই প্রকৃত অর্থে যাওয়া নয়। মৃত্যুত্তীর্ণতাই এই কবিতাগুলোর বিষয়বস্ত।”
‘দেশ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক রজতশুভ্রর ৮টি কবিতার বই আর ৩টি গদ্যের বই ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এ বাদেও আছে বেশ কিছু সম্পাদিত গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘পুনশ্চ’ থেকে প্রকাশিত ‘বিশ্বভারতী ও তার ভবিষ্যৎ’, ‘দূরের মাটি কাছের কণ্ঠস্বর’, ‘দীপ’ থেকে প্রকাশিত ‘অভীপ্সিত রবীন্দ্রনাথ’ ‘দে’জ’ থেকে ‘স্বামী বিবেকানন্দ: সার্ধশতবর্ষের আলোয়’ এবং ‘প্রোগ্রেসিভ’ থেকে প্রকাশিত ‘মোহে-নির্মোহে স্বামীজি’। এগুলির মধ্যে কয়েকটি তো বেস্টসেলারও হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের কবি ও লেখক রজতশুভ্র মজুমদার তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর অবক্ষয় নিয়ে প্রচণ্ড ব্যথিত যা তিনি তাঁর ১৭ পর্বের ধারাবাহিক রচনা ‘স্বপ্নভঙ্গের বিশ্বভারতী’তে লিখেছেন। এই ধারাবাহিকটি প্রকাশিত হয়েছে ‘বসুমতী’ পত্রিকায়। সম্প্রতি আরেকটি বাণিজ্যিক পত্রিকায় তাঁর আরেকটি ধারাবাহিক রচনা ‘শান্তিনিকেতন: নানা ভাবনায়’-তেও শান্তিনিকেতনের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। এবিপি গ্ৰুপের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘সানন্দা’য় সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর প্রেমের উপন্যাস ‘ভালোবাসায় ভোলাব’ সিনেমাকারদের নজরে এসেছে। শেষ পর্যন্ত কোন ব্যানারে এই ছবির মুক্তি আমরা দেখব, সে-প্রসঙ্গ সতর্কভাবে এড়িয়ে গেলেন লেখক। তাঁর বেস্টসেললার গল্পসংগ্রহ ‘নতুন গল্প ২৫’-এর বেশ কয়েকটি গল্প নিয়েও ছবির কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, পুজোয় আসছে রজতের আরও একটি কবিতা-ছবি। এই ছবিতে অভিনয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশে আমরা পাব স্বয়ং কবিকেও।
এভাবে নিজের নানাবিধ গদ্যে, প্রবন্ধে কিংবা ছড়া-কবিতায় দুরন্ত গতিতে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলেছেন এই সময়ের শক্তিমান কবি ও গদ্যকার রজতশুভ্র। আসলে রজতশুভ্র মানেই একটা আলাদা গ্ল্যামার, একটা অন্যরকম ক্যারিশমা। সোশ্যাল সাইটে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা, নিজস্ব ফ্যান ক্লাব, উত্তমকুমারের সঙ্গে মিল নিয়ে টকমিষ্টি কথার ফুলঝুরি… সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম ব্যাপার, বাঙালি কবির তথাকথিত ইমেজকে ভেঙে চুরমার করে রজতশুভ্র নিজেই আজ একটি ব্র্যান্ড।
Advertisements