Read Time:7 Minute, 20 Second
আমীর খসরু আর সন্ত কবীরের দোঁহা একসাথে পড়ুন
ফারুক আহমেদ
“খান সাহেব কবীর গাইছেন, বাহার কেয়া দিখলায়ে অন্তর জপিয়ে রাম/কাহা কাজ সংসারমে তুঝে ধ্বনিসে কাম….”
“যব হি নাম হৃদয় ধারিও/ভায়ো পাপ কা নাশ/মানো চিঙ্গি অগ্নি কি পরি পুরানি ঘাস….”
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও লেখক সমৃদ্ধ দত্ত এক বিশেষ আলোকপাত তুলে আনলেন মণিমুক্ত। তাঁর লেখাটি দাগ কাটবে পাঠক মনে তাই তুলে ধরার প্রয়াস নিলাম। সমৃদ্ধ দত্ত লিখেছেন, “উস্তাদ ওয়াহিদ খান সাহেবকে সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরষ্কার দেওয়া হবে। দিল্লির অডিটোরিয়ামে রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের হাত থেকে সেই পুরষ্কার নেওয়ার সময় ওয়াহিদ খান এতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন যে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, হুজুর, আগে রাজা মহারাজারা রাতভর গান শুনতেন। বহোৎ মেহনত আর জানদারির সাথে আমরা বাজাতাম। তারপর ইনাম পাওয়া যেত।
আপ কিতনে আচ্ছে হ্যায়…আজ কিছু না শুনেই আপনি এই বিরাট পুরষ্কার দিচ্ছেন। ওয়াহিদ খান সাহেব ছিলেন কিংবদন্তী সেতারী বিলায়েত খান সাহেবের কাকা। এই সরলতা এই বিশেষ পরিবারটির অলঙ্কার। উস্তাদ বিলায়েত খান সাহেবের পিতা এনায়েত খান সাহেব সম্পর্কে উস্তাদ আমজাদ আলি খান সাহেবের পিতা হাফিজ আলি খান সাহেব বলতেন ওনার পর স্টেজে বাজানো মুশকিল। ওনার হাতে পরীরা নেমে আসে বেহেস্ত থেকে।
রবিবার দিল্লির কামানি অডিটোরিয়ামে এক অলৌকিক সন্ধ্যায় হয়তো পরীরা নেমে এলেন। এলেন গন্ধর্বলোক থেকে দেবদূতও। উস্তাদ শুজাত হুসেন খান সাহেব সেতার হাতে নিয়ে বললেন, আজ রাগ চারুকেশী বাজাবো। চারুকেশী আমার আব্বা সাহেব কখনো বাজাননি। এদিকে আমার খুব শেখার ইচ্ছে। শেষে আমীর খান সাহেবের কাছে গিয়ে পড়লাম। তিনিই শেখালেন। আব্বা সাহেবকে বললাম সেকথা যে আমি চারুকেশী শিখেছি। গম্ভীর কন্ঠে আব্বা সাহেব বললেন,গেয়ে শোনাও। এটা ওনার একটা রীতি। রাগ গেয়ে শোনাতে হবে।
তারপর দিয়েছিলেন এক অমোঘ শিক্ষা। আজ থেকে যখনই চারুকেশী বাজাবে আমীর খান সাহেবকে স্মরণ করবে। আমি তোমার গুরু হতে পারি। কিন্তু এ রাগের গুরু উনি। সেকথা সকলে যেন জানতে পারে। এই হল পিতার শিক্ষা। প্রথমে স্তব্ধ করা মুড়কি, গমক, জমজমা আর উলটা ঝালা। এরপর একটি বিলম্বিত বন্দীশ উপহার দিলেন। প্রেক্ষাগৃহকে দেড় ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার পর একটি যাদুবিদ্যার প্রয়োগ করলেন খান সাহেব।
ডেকে নিলেন এদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম শিল্পী অসামান্য বাঁশির যাদুকর পন্ডিত অজয় প্রসন্নকে। খান সাহেব বললেন, গতকাল কি হল জানেন! আমি এই সামনে অডিয়েন্সে বসে আছি। গান শুনছি। দুই মহিলা কথা বলছিলেন। পিছনে বসে।।একজন বললেন, আই হেট ঠুংরি!! আমি তো অবাক! সঙ্গীতকে আবার হেট করা যায় নাকি! হেট শব্দটাই কি আঘাত দেয় তাই না? সকলের সব ধরণের সঙ্গীতে রুচি নাই থাকতে পারে। তাই বলে হেট! আজও সেই কথা কানে বাজছে। তাই আপনাদের অনুমতি নিয়ে একটা পেশকাশ করতে চাই। দয়া করে সামান্য সময় দিন!
আমরা উপস্থিত শ্রোতারা অনুষ্ঠান শেষ ধরে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম একটু আগে। আবার বসে পড়লাম অধীর আগ্রহে।
উত্তরপ্রদেশের এটাওয়া জেলার আদি বাসিন্দা উস্তাদ শুজাত হুসেন খান একটি সন্ত কবীরের দোঁহা ধরলেন সেতারের সঙ্গে। দোঁহার প্রথমাংশ সমাপ্ত হলে শুরু করলেন আমীর খসরু। একবার কবীর তারপরই আমীর খসরু। এভাবে চলছে। খান সাহেব কবীর গাইছেন, বাহার কেয়া দিখলায়ে অন্তর জপিয়ে রাম/কাহা কাজ সংসারমে তুঝে ধ্বনিসে কাম…. আর পাশে বসা বেনারসের হিন্দু ব্রাহ্মণ পন্ডিত অজয় প্রসন্ন আড়বাঁশিতে সেই সুরই ধরছেন।
যব হি নাম হৃদয় ধারিও/ভায়ো পাপ কা নাশ/মানো চিঙ্গি অগ্নি কি পরি পুরানি ঘাস….খান সাহেব বললেন আপনাদের বিনীত অনুরোধ সময় পেলে একা আমীর খসরু আর সন্ত কবীরের দোঁহা একসাথে পড়ুন, শুনুন। দেখবেন জগতে হেট নামক শব্দটি নেই আসলে। সেটা আমরা অবশ্য চোখের সামনে দেখেছি একটু আগে। বাঁশিতে হাত দেওয়ার আগে পন্ডিত অজয় প্রসন্ন খান সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে নিলেন। তবলায় একদিকে শাহিদ মুস্তাফা আর অন্যদিক অমিত চৌবে। একে অন্যকে সারাক্ষণ তারিফ করে গেলেন।
একটু আগে অনেক আসন ফাঁকা ছিল। আলোছায়ায় খুঁজছিলাম এই দৈব কনসার্টে পিছনের দিকে লুকিয়ে চুপ করে এসে বসেননি তো আমীর খসরু-সন্ত কবীর? এই সুরের আকাশে শ্রীরামচন্দ্র আর পরওয়ারদিগারও কোথাও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্মিত হাসছেন নিশ্চয় !
দু ঘন্টার সম্মোহন নিয়ে সকলে যখন ফিরছেন পার্কিং কিংবা মেট্রো স্টেশনের দিকে তখন দিল্লির বাতাসে লু ছিল না।বেশ স্নিগ্ধ চরাচর। ও হ্যাঁ, উস্তাদ শুজাত হুসেন খানের পিতার নাম বলা হল না! কেই বা হতে পারেন!! উস্তাদ বিলায়েত খান সাহেব!
তারপর সন্ত কবীর আর আমীর খসরু একসাথে বোধহয় মেট্রোয় উঠলেন। এবার যাবেন বোধগয়া। সাতদিন পর বুদ্ধপূর্ণিমা যে!”
মনের আকাশ সমৃদ্ধ করতে এই লেখার জুড়ি মেলা ভার।
Advertisements