Read Time:15 Minute, 21 Second
বাংলায় নতুন সূর্য ওঠার ডাক দিলেন কবি সম্পাদক ও দলিত-সংখ্যালঘু নেতা ফারুক আহমেদ
সংবাদদাতা, কলকাতা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দলিত ইস্যু নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর পদক্ষেপের ভূয়ষি প্রশংসা করলেন দলিত ও সংখ্যালঘু সঙ্কট উত্তরণের গবেষক ও উদার আকাশ পত্রিকা-প্রকাশনের সম্পাদক ফারুক আহমেদ। সোমবার তিনি বাংলার সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বলেন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো এক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে, বিগত দশ বছরে দলিত নির্যাতনের ঘটনা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি ১৫ মিনিটে ১টি করে অপরাধমূলক ঘটনা ঘটানো হয়েছে দলিতদের বিরুদ্ধে। দেশে দলিতদের উপর নির্যাতনের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, বঞ্চনা ও বৈষম্যের ঘটনাও চরমহারে বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতে। প্রতিদিন দলিতের ৬ জন নারী ধর্ষিতা হন। বিজেপি শাসিত রাজ্যেগুলিতে দলিত ও সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা অনেক বেশি। “লাভ জেহাদ”, “গো রক্ষা”-র নামে অসহায় সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। যা চোখে দেখা যায় না, এই সব দৃশ্য আদিভারতনিবাসীদের চোখে জল আনছে।
তিনি আরও বলেন, এসসি-এসটি আইন পরিবর্তন ও দলিত-সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিকার করতে কলকাতার রাজপথে মহামিছিল ও প্রতিবাদসভার ডাক দেওয়া হয়েছে আগামী ২৮ এপ্রিল। বিভিন্ন দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সংগঠন নেতৃত্ব দেবে এই মহামিছিল ও প্রতিবাদসভার। রেল কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রকৃত দলিত নেতা সমীর কুমার দাসের আহ্বানে ফারুক আহমেদ বড় ভূমিকা নিচ্ছেন এই আন্দোলন সফল করতে।
সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পরামর্শ দেন ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ভারতে আদিভারতীয়দের মধ্যে দলিত ও সংখ্যালঘু মুসলমানরাই সর্বদিকে সর্বাধিকভাবে বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছেন। তাঁর পরামর্শ, এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে দলিত ও মুসলমানদের।
মাদ্রাসা প্রসঙ্গে তাঁর মত, রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার বেহাল দশা কাটাতে অভিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ করা হোক। মাদ্রাসায় এখনও দলিত ও সংখ্যালঘু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই অধিক। সে জন্যই কি রাজ্য সরকার এতো অবহেলা করছে মাদ্রাসার প্রতি? শিক্ষক নিয়োগে এতো অনীহা কেন? জোরালো প্রশ্ন তুলেছেন ফারুক আহমেদ।
এরপর তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, রাজ্য সরকার অনুমোদিত ৬১৪ টি মাদ্রাসায় ৭০ শতাংশ শিক্ষক পদ এখনো শূন্য। মাদ্রাসা শিক্ষা আজ ভেঙে পড়েছে, সরকার তবুও কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বিশ বাঁও জলে তলিয়ে যাচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, কোর্টে কেস চলার অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে সরকার। রাজ্য সরকার চরম অবহেলা করছে মাদ্রাসার প্রতি, তার ফল ভুগতে হবে সরকারকে।
ফারুক আহমেদ দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু বিষয় আলোকপাত করলেন এবং বললেন, “রাজ্যে নামেই সাতজন মুসলিম মন্ত্রী কিন্তু মুসলিমদের কাজের বেলায় একজনও নেই। রাজ্যে গণতন্ত্র ফেরাতে এই সরকার পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াক্ফ সম্পত্তি উন্নয়নের জন্য আজ পর্যন্ত এই সরকার “ওয়াক্ফ উন্নয়ন করপোরেশন” তৈরি করল না। ওয়াক্ফ সম্পত্তি দিনের পর দিন বেহাত হয়ে যাচ্ছে। বেদখল সম্পত্তি ফিরিয়ে আনতে এবং বর্তমানে যে সব সম্পত্তি আছে তা রক্ষা করতে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াক্ফ বোর্ডের কাজ দেখলে মনে হবে গভীর সঙ্কটে আছে। এই সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর একটাও হাই মাদ্রাসা নতুন করে অনুমোদন দেয়নি। সবই দশ হাজারের ভাওতা। সংখ্যালঘু মুসলিম আধিকারিকদের পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনে নীতিনির্ধারণের কোনও জায়গায় রাখা হচ্ছে না।
সংবিধান বাঁচাও সমিতির ডাকে ২৮ এপ্রিল মহামিছিল ও সমাবেশে কিছু প্রশ্ন রাখব। সংখ্যালঘু উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু ভাতা, ‘শ্রী’ যুক্ত প্রকল্প ছাড়া এই সরকার কিছুই করেনি। অথচ এই সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিল তারা ক্ষমতায় এলে সাচার কমিটির সুপারিশ রাজ্যে রূপায়িত করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। বাস্তবিক গুরুত্বপূর্ণ রাজেন্দ্র সাচারের সুপারিশকৃত পরামর্শ আজও প্রয়োগ করতে এই সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল “সমসুযোগ কমিশন” গঠন করতে হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাঙ্ক থেকে বেশি বেশি সংখ্যালঘুদের ঋণ দিতে হবে। রাজ্যস্তরে সংখ্যালঘুরা উপকৃত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য রাজ্যস্তরে তথ্যপঞ্জী ব্যাঙ্ক গঠন করতে হবে যাতে অন্যান্য অংশের মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে সংখ্যালঘু উন্নয়নকে তুলনামূলক ভাবে বিচার করা যায়। রাজ্য সরকারের প্রশাসনে সংখ্যালঘু মুসলমিদের প্রতিনিধিত্ব বাড়েনি। সাংসদ প্রতিনিধি বিশেষ করে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে সংখ্যা বাড়লেও সংখ্যালঘু প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়েনি, তা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। পৌরসভা ও পঞ্চায়েত এলাকাতে ওবিসি ক্যাটাগরি “এ” এবং “বি” করে সংখ্যালঘু মুসলিম প্রতিনিধিত্ব কমিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে এবং বিষয়টি গুলিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয়েছে। ১২ টি এমন বিধানসভা কেন্দ্র আছে যেখানে সংখ্যালঘুরা ৫০ শতাংশের অধিক অথচ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সংরক্ষিত আসন করে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজ্যসরকার আজ পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এসসি-এসটি-ওবিসি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য এই সরকার অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছে। একেই গরিব পিছিয়ে পড়া, তার উপর অনলাইন? এই সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে টাকা নিয়ে শহরে ছুটতে হচ্ছে অনলাইন ফর্ম ফিলাপ করতে। আবার সবাই সার্টিফিকেটও পাচ্ছে না, যার ফলে চাকরি, ভর্তি সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। ওবিসি সংরক্ষণের নামে বঞ্চনা চলছে। ওবিসি সার্টিফিকেট থাকলে চাকরিপ্রার্থীদের আর সাধারণ ক্যাটাগরিতে চাকরিই দেওয়া হচ্ছে না। এখন ওবিসি সার্টিফিকেট আছে তেমন চাকরি প্রার্থীদের মধ্যেই লড়াই করে দু’একটা কোথায়ও চাকরি হচ্ছে। এবছর মুর্শিদাবাদ জেলায় সামান্য প্রাইমারি চাকরি পরীক্ষায় বহু যোগ্য সংখ্যালঘুদের সুপরিকল্পিত ছকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বহু টেট পাশরা আজও চাকরি পায়নি। রাজ্যসরকারের চাকরিতে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সহ বিভিন্ন বিভাগে সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করা হয়েছে, যার ফলে এই সব জায়গায় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব বাড়েনি। জনসংখ্যার অনুপাতে বহু বেশি পরিমাণে মুসলিমরা শুধুমাত্র কারাগারে রয়েছে। ভাবুন পরিবর্তনের জন্য সংখ্যালঘুরা এই সরকারকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল। বাস্তবিক তাঁদের কল্যাণে এই সরকার কিছুই করছে না কিন্তু মুখে বলছে ৯৯ শতাংশ কাজ করে দিলাম। রাজ্যের যে-কোনও রাজনৈতিক দলের দিকে চোখ রাখলে দেখত পাই শহীদের তালিকায় মুসলমান ও দলিতরাই আছে। বাস্তবিক সব রাজনৈতিক দল সুপরিকল্পিতভাবে দলিত ও মুসলমানদের লড়িয়ে দেয়, ফলে মারে ও মরে এই উভয় সম্প্রদায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ ও রাজ্য সরকারের ৮২ টির মতো স্বশাসিত সংস্থার চেয়ারপার্সন বা কর্ণধার ও কমান্ডিং পদে কোনও দলিত ও মুসলমানকে বসানো হয় না। ব্যতিক্রম হয়েছিল পিএসসিতে তবে তাঁকে দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়ে নিতে না পারায় তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ না হতেই চেয়ারম্যান (নুরুল হক) পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত কোনও মুসলমানকে পিএসসিতে সামান্য সদস্যও করা হয়নি। যা ভারতের অন্য রাজ্যে ভাবাই যায় না। এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কোনও মুসলিম পুলিশ আধিকারিককে ডিজি করা হয়নি। আমরা দেখেছি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে মুসলমান এবং দলিত নেতাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই থাকে না। ৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজ্যবাসী খুব একটা বড় ধরনের দাঙ্গার মুখোমুখি হয়নি। এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে হালিশহর, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, আসানসোল প্রভৃতি এলাকার দাঙ্গার ভয়াবহতাকে। ধর্মের নামে অস্ত্রের ঝনঝনানি আজ বাড়বাড়ন্ত, যেন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য এ রাজ্য যে সম্প্রীতির নিরাপত্তা ছিল তাও আজ সঙ্কটের মুখে। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা রোধে ও দাঙ্গা-পীড়িতদের ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণের স্বার্থে কংগ্রেসের ইউপিএ সরকার যে আইন তৈরি করেছিল তা আজও বিজেপি সরকার আইনে পরিণত করেনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে আইন তৈরি করছে না কেন? উন্নয়নের নামে সব জায়গায় দলিত ও মুসলমানদের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে কিন্তু উন্নয়নের অংশে তাদেরকে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে। রাজ্যে মুসলমান ও দলিতদের জমি নিয়ে বসবাসের জন্য যত উপনগরী তৈরি হয়েছে সেখানে মুসলমানদের ঠাঁই হয়নি। অল্প জায়গায় ঘেটোবাসী হয়ে বসবাস করাটাই তাদের এখন ভবিতব্য হয়ে উঠেছে।”
ফারুক আহমেদ তাঁর আরও বক্তব্যে বলেন, কোনোরূপ অজুহাত রাজ্যের মানুষ আর শুনতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমস্ত চাকরির পরীক্ষাগুলিতে সঠিকভাবে রোস্টার মানা হচ্ছে না। তাঁর দাবি, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে এসসি-এসটি-ওবিসি-“এ” এবং ওবিসি-“বি” চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি সুনিশ্চিত করতে রোস্টার মেনে চাকরি দিতে বাধ্য করতে হবে। তিনি বলেন, রাজ্যে যোগ্য সংখ্যালঘু ও দলিত আধিকারিকদের গ্যারেজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, এই বৈষম্য দূর করতে হবে অবিলম্বে। ২৩টি জেলায় চোখ রাখলে কোনও ডিএম ও এসপি বা কমান্ডিং পোস্টে যোগ্য ও সৎ আধিকারক কাউকে দেখছি না। কেন? চাকরিরত যোগ্য সংখ্যালঘু ও দলিতদের কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে? এই বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হবে। তার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামতে হবে, আন্দোলন করতে হবে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ ও শিক্ষাকেন্দ্র থেকে ইসলামি থিয়োলজী বিভাগ তুলে দেওয়ার চক্রান্ত রুখতে হবে। ছয় মাস পেরিয়ে গেল রাজ্যসরকার আজও স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে পারল না।
২৮ এপ্রিল কলকাতায় দলিত ও সংখ্যালঘুদের কল্যাণে প্রতিবাদ মিছিলে সক্রিয়ভাবে যোগদান করে প্রতিবাদসভা সফল করতে সামিল হওয়ার ডাক দিয়েছেন ফারুক আহমেদ-সহ বহু সংখ্যালঘু ও দলিত নেতা। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের টনক নড়াতে তারা বদ্ধপরিকর হয়েছেন।
এবারও যদি সরকারের সুমতি না ফেরে তাহলে বাংলায় নতুন সূর্য ওঠার ডাক দিলেন কবি, সম্পাদক ও দলিত-সংখ্যালঘু নেতা ফারুক আহমেদ।
Advertisements