Read Time:9 Minute, 46 Second
নতুন করে পড়ল মনে…
অশোক মজুমদার
একেকটা ছবি যেন আমাদের একেকটা মুহূর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোন ছবিতে থাকে স্বপ্ন গড়ার উচ্ছ্বাস, কোনটাতে স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা। এক নিমেষে যেন আমরা ফিরে যাই অতীতের সেই দিনটাতে। আজ সকালে পুরনো ছবির ভেতর থেকে এমন একটা ছবি পেয়ে গেলাম যা আমাকে নিয়ে গেল ৩৬ বছর পিছনে। ৯. ৮. ১৯৮২ আজকাল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও পথ প্রদর্শক গৌরকিশোর ঘোষ। এই ছবিটা সেদিন তোলা। আগামীকাল গৌরদার ৯৫তম জন্মদিনের উদযাপন হবে রোটারি সদনে। এ এক আশ্চর্য সমাপতন।
ছবিটা দেখে কত যে কথা মনে পড়ল তার ঠিক নেই। ছবিতে দেখছি গৌরদা তাঁর সম্পাদিত শেষ কাগজটা তুলে দিচ্ছেন পরবর্তী সম্পাদক, একদা সার্কুলেশন ম্যানেজার মদন মিত্রের হাতে। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছি ক্যামেরা হাতে আমি, পাশে শৌনক, বিশ্বজিৎ দা, রজত দা, সমীর রায়, অনন্ত দা, অমিত ধর(ছবিতে অমিতের মাথা কাটা গেছে), মদন দা ও রুচিরা দি বসে আছেন। আজকালে গৌরদার শেষদিন উপলক্ষে সাদামাটা অনুষ্ঠান। আমাদের সবার মনখারাপ, শৌনক গান ধরল, জানি তো দিন যাবে যাবে, দেবব্রত ঘোষ গৌরদাকে দিল নিজের আঁকা একটা ছবি, যার ক্যাপশন প্রেম নেই। এই ছবিটা আমাকে দিয়েছিলেন আলোকচিত্রী বন্ধু সুমন দত্ত।
আজকাল ছিল গৌরদার এক স্বপ্ন। আদর্শবাদী এই মানুষটি একটা আধুনিক সংবাদপত্রের চেহারা কেমন হতে পারে সেটাই আস্তে আস্তে আজকাল এ ফুটিয়ে তুলছিলেন। সেই প্রথম রাশিফল ও ক্ষতিকর বুজরুকি মার্কা বিজ্ঞাপন বর্জিত একটা বাংলা কাগজ দেখল পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র পাঠকরা। শুধু দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক দাশগুপ্ত সহ একঝাঁক তরুণ সাংবাদিকের লেখায় ভরা আজকালের ভাষাতেও ছিল এক ঝকঝকে নতুনত্ব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হামদি বের কাগজ করার অভিজ্ঞতা ও সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনার দক্ষতা।
সমীর দত্তর পরিচালনায় রবিবাসর বাংলা কাগজের সাময়িক পত্রের খোলনলচে বদলে দিয়েছিল। অশোকদার খেলার পাতাকে ফলো করত অন্য কাগজগুলিও। সাংবাদিকদের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতেই হবে এমন হাস্যকর কথা গৌরদা মানতেন না। ভাল লিখতে পারাটাই ছিল আজকালের সাংবাদিক হওয়ার একমাত্র শর্ত। দেখা গেল আনন্দবাজারও ছবি, রবিবাসর, সংস্কৃতির পাতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে আজকালের নকল করা শুরু করল। আজকালের প্রথম দিকের সাংবাদিকরা এখন গোটা দেশের নানা সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে মাথা উঁচু করে কাজ করছেন।
আজকালের ছবি প্রথম থেকেই বিষয় বৈচিত্রে অন্য কাগজের সংবাদচিত্র থেকে আলাদা। প্রতিটি ছবির ছিল এক নিজস্ব চরিত্র। সেখানে ছবিই খবর আবার খবরটাই ছবি। আজ বলতে বাধা নেই, নানা সামাজিক সমস্যা নিয়ে তদন্তধর্মী প্রতিবেদন, রবিবাসর, মেয়েদের পাতা, খেলার পাতা, টেলিভিশন, বিনোদনের পাতা সবেতেই চলতি কাগজগুলিকে টেক্কা দিয়েছিল আজকাল। আজকালে ফটোগ্রাফারদের পাকা চাকরি ছিল না। কিন্তু ছবি পিছু অনেক বেশি টাকা দেওয়া হত। ভাল ছবি হলে পাওয়া যেত দ্বিগুণ টাকা। গৌরদা আমাদের অজান্তেই আলোকচিত্রীদের মনে ভাল ছবি তোলার একটা মানসিকতা গড়ে দিয়েছিলেন। ভাল ছবি তোলাটা আমাদের কাছে ছিল একটা নেশার মত। আমরা ছবি তুলতাম ভালবেসে। আজকের বাংলা সংবাদপত্র নানা দিক থেকে আজকালের কাছে ঋণী। সেই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদককেই মালিকের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় আজকাল ছাড়তে হল। মালিকের ইচ্ছায় যাকে তাকে মাথার ওপরে বসানোর যে রেওয়াজ এখন বাংলা কাগজে চলছে তার সূচনাও হয়েছিল আজকালে।
গৌরদাকে আমি চিনতাম স্কটিশে পড়ার সময় থেকে। গৌরদার দুই মেয়ে সাহানা, সোহিনী ছিল আমার কলেজের বন্ধু। আর সেই সূত্রেই তাদের ভাই আপ্পুও আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। কলেজের পাঠ চুকিয়ে আমি তখন দিশেহারা। অতিবাম রাজনীতিও ভাল লাগছেনা। কলেজের বন্ধু রঞ্জনের সঙ্গে অন্তঃশীলা নামে একটা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গড়ে এদিক ওদিক গান বাজনা, পথ নাটক করে বেড়াতাম। সেই সময় নদী পরিকল্পনাবিদ কপিল ভট্টাচার্যের এক সেমিনারে গৌরদাকে প্রথম দেখি। তখন আমি কিছুই করছি না। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তখন নানা কাগজে লিখছে। তাদের লেখার সঙ্গে কিছু ছবি দিলেই আমার ৪০০টাকা মাস খরচা জোগাড় হয়ে যেত। সেই ছবিও তুলতাম বন্ধুদের ক্যামেরায়। তখন আমার অন্যান্য ফটোগ্রাফার বন্ধু সন্তোষ দেবদাস, অশোক চন্দ, দিলীপ ব্যানার্জি, অমিত ধর, সোমনাথ পাকড়াশি, দেবাশিস রায়রা নিয়মিত ছবি তুলছে। ভাস্কর পাল এসেছিল আরেকটু পরে। আমি তখন আজকালে বিভিন্ন লেখার সঙ্গে বাইরে থেকে ছবি দিয়ে চলে আসতাম। আজকালে আমার প্রথম ছবি ছাপা হয় রবিবাসরে রঞ্জন সেনের লেখার সঙ্গে। একদিন গৌরদার ঘরে ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে ছোকরা বিপ্লবী অশোক, তোকে নিয়মিত আজকালে আসতে হবে। তোর চোখ আছে, তোর ছবি আরও ভাল হবে, তুই আয়। গৌরদার এই ডাকেই শুরু হল আমার নিয়মিত ছবি তোলার অভিযান। এই ডাক না পেলে আমি হয়তো চিত্র সাংবাদিকতায় আসতামই না।
গৌরকিশোর ঘোষ থাকতেন, ভি আই পি হাডকোর মোড়ের কাছে বিধান আবাসনে। সেখানে বহুবার আমি গিয়েছি, নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে গৌরদার চিন্তার স্বচ্ছতা ও যুক্তির দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন আমি আজকালে। বুকের ব্যাথা ওঠায় উনি মেডিকেল কলেজের জেনারেল বেডে ভর্তি হয়েছিলেন। কাগজের মালিক অভীক ঘোষ, অশোক ঘোষেরা তাঁকে বড় নার্সিংহোমে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গৌরদা বলেছিলেন সরকারি হাসপাতালের মত চিকিৎসা আর কোথাও হয় নাকি? একা কেবিনে না থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকলে আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাবো।

গৌরদা ছিলেন নিজের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একজন প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষ। বাংলা সাংবাদিকতায় দাদা ঠাকুর কিংবা হরিশ মুখার্জির মত মানুষরা যে নির্ভীক নিরপেক্ষতার ধারার প্রবর্তন করেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ তার শেষ প্রতিনিধি। আনন্দবাজার ছেড়ে আজকালে এসেছিলেন গৌরদা। নিজের মত করে সত্যিকারের একটা ভাল কাগজ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ অব্দি নিজের সৃষ্টিকেই পরিত্যাগ করে আনন্দবাজারে ফিরে আসতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। কাগজ যে আদতে মালিকদের একটা নির্ভেজাল ব্যবসার জায়গা হয়ে উঠবে, মালিকের ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত হবে সম্পাদকীয় নীতি গৌরদার বিদায়ে তার ইঙ্গিত ছিল। এখন তা একদম খুল্লম খুল্লা! ৯৫তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন পুরনো ছবিটা এই কষ্টটাকে আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিল।
সৌজন্যে : ফারুক আহমেদ
Advertisements