Read Time:13 Minute, 15 Second
সিপিএম দলে মুসলিমরা বঞ্চিত এই অভিযোগ তুলে দল ত্যাগ করলেন মইনুল হাসান
ফারুক আহমেদ
সিপিএম দলে মুসলিমরা বঞ্চিত এই অভিযোগ তুলে দল ত্যাগ করলেন মইনুল হাসান। তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়ে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও দিদির উন্নয়ন যোজ্ঞে সামিল হয়ে সমাজকল্যাণে কাজ করতে চান তিনি। বয়সে প্রবীন এই বামপন্থী নেতা তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়ে মানুষের কল্যাণে কি দাগ কাটবেন এবং কতটুকুই বা কাজ করতে পারবেন সেটাই দেখার। কারণ এই বামপন্থী নেতা দীর্ঘকাল বামদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও মানুষের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই করতে পারেন নি। সংখ্যালঘুদের কল্যাণে প্রকৃত অর্থে কিছু উন্নয়ন ওও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন বলেই মানুষের মনে শ্রদ্ধার জায়গা অর্জন করতে পেরেছেন বামপন্থী আর এক নেতা ড. আবদুস সাত্তার। তিনিও সিপিএম দলে মুসলিমরা বঞ্চিত এই অভিযোগ তুলে কলম ধরেছেন বহু লেখায় ও তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকারে। সম্প্রতি তিনি তৃণমূল কংগ্রেসও যে সংখ্যালঘু উন্নয়ন সঠিকভাবে করছে না সেই অভিযোগ তুলে কলম ধরেছেন এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি সংখ্যালঘুদের জনপ্রিয় নেতা তথা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী ও চাষার ব্যাটা বলে মন জয় কারার চেষ্টা করতেন প্রবীন বামপন্থী নেতা আবদুর রেজ্জাক মোল্লা তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়ে বিধায়ক ও মন্ত্রী হয়েছেন। এই দুই নেতা ও মন্ত্রী মানুষের কল্যাণে কতটুকু কাজ করতে পেরেছেন বা পারছেন তা একবার ভাঙড় ও মোঙ্গলকোটের মানুষের কাছে জানলে আপনি অবাক হবেন। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলাতেও না কি লাগাম দেওয়া হয়েছে এই দুই নেতার মুখে। বহু গটনা ও সখ্যালঘুদের উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন করলে এরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকছেন এখন। তাই মানুষের মনে এদের গ্রহণীয়তা আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে।
সিপিএম দলের পার্টি কংগ্রেসে এবারও মুসলিম নেতাদের বঞ্চিত করল। সিপিএম দলের পলিটবুরোতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সদস্য নামতে নামতে এক সংখ্যায় নামল। ১৭ জন সদস্য আছে এই ১৭ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র মহঃ সেলিম ছাড়া আর কোনও মুসলমানকেই সদস্যপদে নেওয়া হয়নি। মূল কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৯৫ জনের সদস্য আছে, তার মধ্যে মহঃ সেলিম, হান্নান মোল্লা, ই করিম, এম এ গফুর, ইউসুফ তারিগামি এই পাঁচজন ছাড়া আর কেউ নেই। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন চারজন সদস্য হয়েছেন, রবীন দেব, আভাস রায়চৌধুরী, সুজন চক্রবর্তী ও অমিয় পাত্র। অথচ এই চারজনের মধ্যে একজনও মুসলমান নেতাকে নেওয়া হয়নি। সর্বমোট পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৪ জন কেন্দ্রীয় কমিটিতে একমাত্র মহঃ সেলিম পশ্চিমবাংলার মুসলিম প্রতিনিধি। মহঃ সেলিম ছাড়া আর মুসলমানদের মধ্যে কেউ নেই বাংলার প্রতিনিধি।
অবশ্য হান্নান মোল্লা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হয়ে আছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে নেই।
অথচ আমরা দেখি সব রাজনৈতিক দলের হয়ে বেশিরভাগ শহীদ হন এই মুসলমানরাই। এবার পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক হিংসায় ইতিমধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে তারমধ্যে ১৬ জন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ভাবুন একবার? মুসলমানরা দলের জন্য মাঠে ময়দানে প্রাণ দিয়ে দল করেও মানুষের কল্যাণে বড় নেতা হতে পারেন না। তারা সব দলে চরম উপেক্ষার পাত্র হয়েই রয়ে যায়। আর অন্যদিকে দেখা যায় ঠান্ডা ঘরে বসে চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা বড় নেতা হয়ে নির্দেশ দেন নিচু তলায়, আর তা মেনেই চলতে হয় দলিত ও মুসলমানদের। যারা মানতে পারে না তাদের আমছালা সবই যায়। এই বঞ্চনার অবসান ঘটাতে অভিলম্বে দলিত ও সংখ্যালঘু জাগরণ জরুরি বলে মনে করি।
সিপিএম দলের চরম বৈষম্য ও মুসলিম বঞ্চনার প্রতিকার করতে না পেরে নীরবে সিপিএম থেকে দূরে সরে এলেন তিনবারের সাংসদ নেতা মইনুল হাসান ও প্রাক্তন মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু মন্ত্রী ড. আবদুস সাত্তার। এই দুজন সিপিএম দলের সংখ্যালঘু নেতা হয়েও দলের সদস্যপদ ছেড়ে দিলেন।
মইনুল হাসানের মতো নেতাকে বাদ বাঙালি মুসলমান নেতৃত্বকে দুর্বল করল। ১৯৬৯ সালে বিপিএসএফ এর সদস্য হন মইনুল হাসান। ১৯৭৯ সালে এসএফআই এর মুর্শিদাবাদ জেলার সভাপতি হন। ১৯৭৬ সালে পার্টি সদস্য হন তিনি। ১৯৮০ সালে পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সদস্য হন। ১৯৯৫ সালে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন। দুবার লোকসভার সদস্য এবং একবার রাজ্যসভার সদস্য হন।
তিনি দুটি বিষয়ে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। বিএড ও এমএড, ডিগ্রীলাভ করেন প্রথম বিভাগে। তাঁর ০৩/০১/২০১৮ তে ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হয়। তাঁর জন্ম হয় মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার কুমারপুর গ্রামে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতি করছেন। ১৯৭৯ সাল থেকেই পার্টিরর সর্বক্ষনের কর্মী। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ ডিওয়াইএফআই এর রাজ্য সভাপতি ছিলেন। মূলত: তাঁর উদ্যোগেই মুর্শিদাবাদ জেলায় আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়েছে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট সদস্য ছিলেন।
সিপিএম সুকৌশলে মইনুল হাসানের মতো শিক্ষিত নেতাকে সরাল। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, দীর্ঘ দিনের পার্টি মেম্বার, সাংসদও হয়েছিলেন তিনবার। সমাজ সংস্কৃতি চর্চা করে থাকেন তাঁর মেধাবী মননশীলতায়। মুসলমান সমাজ নিয়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন তিনি। এবছর বইমেলাতে “উদার আকাশ” প্রকাশন থেকে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছি। বইমেলাতে প্রেস কর্নারে “উদার আকাশ” প্রকাশনের পক্ষে আয়োজন করেছিলাম তাঁর রচিত গ্রন্থ সহ আরও কয়েকটি বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান। ওই গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি আসেন এবং মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। এতে নাকি দলের একটা অংশ বেজায় চটেছেন এবং তাঁকে চরম অন্যায় ভাবে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার কলকাঠি নেড়েছেন সংখ্যালঘু আর এক বামপন্থী নেতা।
সুকৌশলে রাজ্য কমিটি থেকে তাঁকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ দলের অনেক সদস্যই করেছেন। তবু দলের একতরফা সিদ্ধান্তে তিনি বাদ পড়লেন। প্রসঙ্গে তাঁর রচিত বইটি একটি মহা-মূল্যবান গ্রন্থ। বইটির নাম “ইসলামী আইন : বিবাহ তালাক উত্তরাধিকার”।
বেশ কিছুদিন ধরে উচ্চ নেতৃত্ব তাঁকে কোণঠাসা করে, কমিটি থেকে বাদ দেওয়া একটা অপকৌশল মাত্র। হঠকারী সিদ্ধান্ত।
সিপিএম ওঁকে বাদ দিয়ে দলের যে সর্বনাশ করছে, এটা বোঝার ক্ষমতাও কি সেই দলের নেতৃত্বের নেই…বলে অনেক নেতাই মুখ খুলছেন দলের অন্দরে।
সিপিএম দলটিকে এই নেতৃত্ব কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এই প্রশ্নও উঠছে।
মইনুল হাসানকে রাজ্য কমিটি থেকে সরানো সিপিএমের হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেছেন, দলের বহুকর্মীবৃন্দ।
এই সিদ্ধান্ত সৈফুদ্দিন চৌধুরী, আবু আয়েশ মণ্ডল, আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, সাত্তার মোল্লা, আবদুল মুজিদ মাস্টার, আইনুল হক, মাফুজা খাতুন ও মইনুল হাসানকে সরিয়ে রাজ্যে বাঙালি মুসলিমদের এই বার্তাই দিল সিপিএম যে বাঙালি মুসলমান কোনও নেতাকেই তারা নেতৃত্বে উঠতে দেবে না। কমরেড মুজফফর আহমদ ও কমরেড আবদুল হালিম এর তৈরী করা পার্টির আজ এই হাল! মুসলমানদের মধ্যে যারা এখনও এই পার্টির কাজে ও নেতৃত্বে যুক্ত রয়েছেন এই পরিনাম তাদেরও একদিন আসবে। ভেবে দেখেছেন কি?
মইনুল হাসানের মতো নেতাকে বাদ বাঙালি মুসলমান নেতৃত্বকে দুর্বল করল।
আগামীতে সেলিমরাই কি একাই রাজত্ব করবে উঠছে প্রশ্ন? না কি তাঁরও এমন দশা হবে একূিন। তবে উর্দু ভাষীদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সিপিএম দল আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে তাদের কাজকে সহজ করল বলে মনে হয়। বহু বামপন্থী মুসলিম নেতার মুখে শুনেছি মহঃ সেলিম না কি কখনও বাঙালি মুসলিম নেতাদেরকে গুরুত্ব দিতে চাইতেন না এবং কৌশলে বহু নেতাকে দল থেকে বার করা হয়েছে।
নতুন যে ৮০ জনের রাজ্য কমিটি হয়েছে তাতে মাত্র ৮ জন মুসলিম নেতাকে সদস্য রাখা হয়েছে। সিপিএম দলের কর্তারা আসলে মুসলিমদের যোগ্য নেতাকে দলে বরাবর জায়গা দিতে চায় না এটাই তার বড় প্রমাণ।
যেখানে এই রাজ্যে জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলমান। আরও উল্লেখ্যও যে ২২টি জেলার মধ্যে কোথাও একজনও সংখ্যালঘু মুসলমান সম্পাদক নেই। পশ্চিমবঙ্গে একজন মুসলিম মিহিলা কমরেড পাওয়া গেল না যাকে রাজ্য কমিটির সদস্যা করা যেত? অথচ তপশীলী জাতি ও তপশীলী উপজাতি সম্প্রদায়েরও মহিলা কমরেডকে সিপিএম দলের রাজ্য কমিটিতে রাখা হয়েছে।
অথচ তিনটি জেলার জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি মুসলমান বসবাস করেন। মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুর। এই বঞ্চনার অবসান ঘটবে কবে? সব রাজনৈতিক দল কৌশলে মুসলমানদের ৩০ শতাংশ ও দলিতদের একটা বড় অংশ ভোট নিতে সংখ্যালঘু ও দলিত দরদী সাজেন। বাস্তবিক তাদের প্রকৃত উন্নয়নের সময় বেপাত্তা হয়ে যায়। এইসব রাজনৈতিক দল যে বার্তা দেয় তা এখন মুসলমানরা ও দলিতরা বুঝতে শিখছেন, তাই আগামী দিন দলিত ও সংখ্যালঘু মহাজোট বাংলা ও ভারতের উন্নয়নে এগিয়ে আসবে। মূলভারতবাসীর জাগরণ ঘটছে এটাই এখন আশার আলো ।
Advertisements