অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ ও আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক
ফারুক আহমেদ
কথা হচ্ছিল বাংলা সাংস্কৃতিক মঞ্চের কর্ণধার সামিরুল ইসলাম-এর সঙ্গে অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ ও আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক কাজ করেছে।
মে মাসের ২০ তারিখে আমাফান মাতৃভূমি বাংলায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে। দুই চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর সহ অন্যান ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, ৮৫-র ও বেশি মানুষ মারা গেছেন, এলাকার পর এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। সংবাদ সংস্থা বিস্তারিত খবর করেছে। সহ নাগরিক হিসাবে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আগের যেকোন সংকট মূহুর্তে ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’ ও ‘বেস’ যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমফানের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। আরও একাধিক সামাজিক সংগঠনের সাথে একযোগে পূর্ণশক্তি নিয়ে বিপদগ্রস্থ মানুষ গুলোর কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
যাবতীয় বাধা বিপত্তি এড়িয়ে খাদ্য, পানীয় জল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ত্রান হিসানে পৌঁছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। সবার কাছে বিনীত অনুরোধ আমাদের প্রাণের প্রিয় বাংলাকে আবারও নতুন করে গড়ে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে এবং একযোগে কাজ করতে হবে।
উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের দিকে আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক-এর যে টিমটি গেয়েছিলো, তারা রবিবার রাতে কলকাতায় ফিরেছে।
অন্য আরেকটি টিম দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবার দিকে গেয়েছিলো। তারাও ফিরেছে। রিলিফ-মেটিরিয়াল বাবদ দুটি টিম এই দফায় মোট কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করেছে।
উত্তর ২৪ পরগনার টিমটি হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে প্রথমে যায় সুন্দরবনের অন্যতম প্রত্যন্ত দ্বীপ যোগেশগঞ্জ-হেমনগরে। এই দ্বীপের সরদারপাড়া ঘাটের কাছে মাধবকাঠি অঞ্চলটিতে রায়মঙ্গলের জল ঢুকেছে ব্যাপক ভাবে। বন্যা-পরিস্থিতিতে রয়েছেন প্রায় ২৫০ টি পরিবার।
ফেরার পথে হিঙ্গলগঞ্জ-এর লাগোয়া রূপমারী এলাকা থেকেও সঙ্কটগ্রস্থ মানুষের খবর আসে। সময়ের অভাবে গ্রামের ভেতরে ঢোকা যায়নি, তবে আঞ্চলিক মানুষদের থেকে জেনে ৫০-৬০ টি পরিবারের একটি লিস্ট বানানো হয়েছে, যাঁদের পাশে দ্রুত দাঁড়ানো প্রয়োজনে অন্য সবাই এগিয়ে আসুন।
সব থেকে খারাপ অবস্থা চোখে পড়েছে চকপাটলী, মহিষপুকুর, পাটলি খানপুর অঞ্চলটিতে। মাটির ঘর-বাড়ি ভেঙেছে। বিস্তীর্ন এলাকা জলের তলায়। বহু মানুষ উঁচু রাস্তার ওপর অথবা ফ্লাড-সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। ৪০০-৫০০ পরিবারের পাশে এখুনি দাঁড়ানো প্রয়োজন বলছিলেন বাংলা সাংস্কৃতিক মঞ্চের কর্ণধার সামিরুল ইসলাম।
আঞ্চলিক মানুষদের সাথে আলোচনা করেই চাল, ডাল, চিঁড়ে, চিনি, তেল, আলু, পিঁয়াজ, বাচ্চাদের জন্য গুঁড়ো দুধ সহ ইত্যাদির একটি করে প্যাকেট পরিবারগুলির কাছে ইতিমধ্যেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই টিমের কাছে ৪৫ হাজার টাকা মতো ছিলো। ওই সেটা খরচ করা হয়েছে। ঈদ হয়েছে ২৫ মে। ২৬ মে আরও একটি টিম বাকী টাকা নিয়ে গিয়েছে সাহায্য করতে। প্রথম দফায় আনুমানিক খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা।
আমাদের দ্বিতীয় টিমটা গিয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসবায়। গোসাব ব্লকটা বেশ কয়েকটা দ্বীপ নিয়ে তৈরি। এই ব্লকের অন্ততঃ চারটে জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে হু হু করে জল ঢুকেছে। পুঁইজালি, জটিরামপুর, রানীপুর, মন্মথনগর। আমাদের টিম চুনোখালী হয়ে ভায়া সম্ভুনগর মন্মথনগর যেতে পেরেছিল। গোটা পথটা যাওয়ার জন্যে গাড়ির রাস্তা নেই। নদি পেরোতেই হয়। ফলে যাতায়াতে সময় লাগে বিস্তর। সেই কারণেই আর অন্য অঞ্চলে যেতে পারেনি আমাদের টিমটা।
মন্মথনগরে বাঁধ ভেঙেছে এক কিলোমিটার জুড়ে। জোড়াতালি দিয়ে বানানো বাঁধ। ভাঙার পর তার কঙ্কালসার চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে ছেলেখেলা করা হয়েছিলো। প্রায় ৬ হাজার বিঘে জমি জলমগ্ন। মানে নোনাজলের তলায়। ফসল নষ্ট হয়েছে, আগামী কয়েকবছর ফসল হবে না। গরু বাছুর মারা গেছে। পুকুর খালের মাছ মরে ভেসে উঠছে ব্যাপকহারে। আনুমানিক ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখানে। সংখ্যাটা আরো বেশি হতে পারে। নদীর ঠিক পাড়েই যাদের বাস তাদের সর্বস্ব গেছে। সে সংখ্যাটাই ৫০-৬০ জনের আশপাশে হবে। যেহেতু ওই এলাকায় কোনো ফ্লাড সেন্টার নেই, তাই তাদের যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই। ঝড়ের রাতে একটা সরকারী ফার্ম হাউসে তারা সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিল। রাতে খিচুড়ি খাইয়েছিল পঞ্চায়েত। ব্যাস এটুকুই। এখনই ত্রাণ নিয়ে হাজির হোক সরকারপক্ষের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়াও যাদের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়নি তাদের অন্যান্য ক্ষতিও কম নয়। গাছ পড়েছে, চাল উড়ে গেছে, নৌকো ডুবে গেছে, দোকানের জিনিস নষ্ট হয়েছে। কারো কারো ক্ষতি হয়েছে লক্ষাধিক টাকারও বেশি।
গোসবার স্থানীয় পরিচিত কিছু মানুষের হাতে আপাতত কাজ চালানোর জন্য সঙ্গে থাকা ৬০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছে আমাদের টিম। ক্ষতিগ্রস্তদের লিস্ট বানিয়ে নিয়ে কাল থেকেই শুরু হয়েছে রিলিফের কাজ। আশপাশের দ্বীপগুলোতেও যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে, ফলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের গোসবায় বেশ কয়েকবার যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকবে।
ওপরের দুটি টিম সহ আরও দুটি টিম রবিবার সারাদিন ধরে সঙ্কটগ্রস্থ এলাকাগুলিতে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন।
আমফান রিলিফ নেটওয়ার্কের অংশ হিসাবে ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’-এর একটি টিম পৌঁছেছিলো দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিনাখা ও হরিনুল্লা অঞ্চলে। প্রায় ৩০০০ মানুষ এই এলাকায় বসবাস করেন। গ্রামের প্রায় সবাই দিনমজুর শ্রেণির। এখানকার প্রায় ৯৫% বাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। খাবার, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, ওষুধ কিছুই নেই। এই এলাকাটিতে দ্রুত একটি বড় আকারের ‘কমিউনিটি কিচেন’ চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আলো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ও বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের উদ্যোগে অন্য একটি টিম যায় হাসনাবাদ ব্লকের পাটলি-খানপুর এলাকায়। এই এলাকার পরিস্থিতি আগেই জানানো হয়েছে। জলমগ্ন এলাকাগুলির ২৫০ জন মানুষের জন্য রান্না করা কিছু খাবার এই টিমটি সঙ্গে করে নিয়ে যায়। অতি দ্রুত এখানে আরও খাদ্যসামগ্রী, ত্রিপল ইত্যাদি নিয়ে পরবর্তী টিমকে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আপনারা আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন :
Bangla Sanskriti Mancha
Bank A/C No: 401020110000667 (Current Account)
IFSC Code: BKID0004010
Bank OF India(Jodhpur Park Branch)
‘আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক’-এর তিনটি টিম উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় কাজ করেছে।
প্রথম টিমটি হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের রূপমারী গ্রামপঞ্চায়েতের কুমীরমারী গ্রামে চাল-ডাল, শুকনো খাবার এবং ত্রিপল পৌঁছে দেয়। অঞ্চলটি ব্যাপক ভাবে জলমগ্ন হওয়ায় পৌঁছতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। জোয়ার-ভাটার কারনে গতকাল ত্রাণ পৌঁছে গেলেও ডিস্ট্রিবিউট করা অসুবিধে হচ্ছে।
দ্বিতীয় টিমটি যায় হাসনাবাদ ব্লকের পাটলি খানপুর অঞ্চলের ভেরিপাড়া ও খলিশাখালি গ্রামে। নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের ভলেন্টিয়াররা এখানে ৩০০-র মতো পরিবারের কাছে শুকনো খাবার, পানীয় জলের পাউচ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি পৌঁছে দিয়েছে।
তৃতীয় টিমটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিনাখা অঞ্চলের হারিনুল্লাহ্ গ্রামে একটি ‘কম্যুনিটি কিচেন’ চালু করেছেন। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের ভলেন্টিয়াররা এখানে কাজ করছেন।
সঙ্গের ছবিগুলির কুমীরমারী অঞ্চলের, খানপুর অঞ্চলের ভেরিপাড়া ও খলিশাখালি গ্রামের এবং হারিনুল্লাহ্ গ্রামের ‘কম্যুনিটি কিচেন’-এর।
বাংলার অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পতকা ও জিডি কর্ণধার মোস্তাক হোসেন, শিস্-এর ডিরেক্টর এম এ ওহাব, বেস-এর আবু সালে, উদার আকাশ ও সর্বভারতীয় নবচেতনার সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ, চলোপাল্টাই-এর ডিরেক্টর সুমন দাস-রাও লকডাউন ও আমফানে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। প্রতিনিয়ত মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। লকডাউনে ও আমফানে সমাজসেবায় এগিয়ে এলেন অন্যদের সঙ্গে কবি লিটন রাকিব, আই আই টির গবেষক আশিফ আকরামরাও।