বাচাল বাঙালী ও বিনামূল্যে জ্ঞানের মেলা ?
ড: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা ,১৯.০৭.২০২০
অঘোরবাবু কিছুদিন আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।জমানো কিছু এবং অবসর সময়কার এক কালীন কিছু টাকা দিয়ে সরকারি আবাসন থেকে চিনারপার্কে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে উঠেছেন এক দু কামরার ফ্ল্যাট কিনে।অঘোরবাবুর বিবাহযোগ্যা একমাত্র মেয়ে এম.এ.পাশ করে টিউশনি করে।
সময় কাটে না তাঁর।সবসময় কিছু না কিছু করেই চলেছেন খুটুরমুটুর করে।বাইরে বেরোলে প্যান্ট আর ফতুয়া।ঘরে থাকলে খালি গা আর লাল গামছা।শীতকালে বড়জোর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি।
চোখে হাই পাওয়ারের বাই-ফোকাল চশমা।
লক ডাউন চলছে।তাই সকালবেলা হাতে থলি মুখে মাস্ক দিয়ে বাজারের উদ্দেশে রওনা দিলেন অঘোরবাবু।ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তা ধরে একটু এগিয়েই
সিদ্ধার্থ ইউনাইটেড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিশনের মেন গেট।সেখানে কাজের মাসি রমলার সাথে দেখা।কারণে অকারণে কথা বলা তার স্বভাব। অঘোরবাবুকে দেখে সে বললো, ‘অ কাকাবাবু! কত মোটা হয়ে গেছ গো!রিটায়ার হয়ে শুধু খাও আর ঘুমাও নাকি? সকাল বিকাল এট্টুস খানিক হাঁটবা।শরীল ভালো থাকবে’।
অঘোরবাবু হাসলেন।কিছু বললেন না।চলার গতিও থামালেন না।
বড় রাস্তায় পরে চিনার হাইটের নীচে যেখানে পাশাপাশি স্টেট ব্যাংক আর এইচ.ডি.এফ.সি ব্যাংক আছে তার সামনের নাড়ুর চায়ের দোকান। সাতসকালে দোকান খুলে যায়।নাড়ু সেভেন ফেল।আঠারো বছর বয়স।তার দোকানের নির্দিষ্ট একটা বেঞ্চির নির্দিষ্ট কোনে বসে মুখের মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে অঘোরবাবু লেরো বিস্কুট দিয়ে এক কাপ চিনি ছাড়া চা খান রোজ।আজ চা দিতে দিতে নাড়ু তাকে বললো, ‘বড্ড রোগা লাগছে আপনাকে স্যার! শরীর ফিট আছে তো?অবশ্য বয়সও বাড়ছে।সুগার আর প্রেসারটা একটু দেখিয়ে নিয়েন।ডিম, কলা, আপেল এগুলো রোজ খাবেন একটা করে’।
অঘোরবাবু চা খাওয়া শেষ করে বিনি পয়সার জ্ঞান নিয়ে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে মাস্কটা যথাস্থানে তুলে আবার সামনের দিকে এগিয়ে চললেন।
চারণক হসপিট্যালের উল্টোদিকের সার্ভিস রোডের উপরের মুদির দোকানটা একটু দেরি করে খোলে।সামনের ধাপিটা’তে বসে ক্লাব টাউনের বয়স্ক বাঙালিরা আড্ডা মারছেন।ওদেরই একজন ধনঞ্জয় সাঁতরা একটু ফিচেল প্রকৃতির।সবকিছুতে চাটনি করার অভ্যাস।অঘোরবাবুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘কি ব্যাপার অঘোর দা? সকাল সকাল খুব চনমনে লাগছে! বৌদি ভোরবেলা থেকেই ভালোবাসতে শুরু করেছেন নাকি?মানতে হবে দাদা! আমরা তো পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের পর থেকেই সেই সংসারের বক্সিং রিং এ! আপনারা এই বয়সেও কেমন মাখো মাখো! হা হা হা’!
অঘোরবাবু এখানে চলার গতি কমালেও থামলেন না।মৃদু হেসে আবারো সামনে এগিয়ে চললেন।
তেঘরিয়া বাজার এখনো খানিকটা দূরে।রোদ চড়ছে।ছাতা আনেননি।পা চালালেন অঘোরবাবু। ভি.আই. পি.রোডের উমা নার্সিং হোমের উল্টো দিকের পুলিশ কীয়স্কে রোজ পাড়ার ছেলে সিভিক ভলান্টিয়ার পটলার সাথে দেখা হয়।আজও হলো।ছোকরা তাঁকে দেখে একগাল হেসে নিজেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘জেঠু ভালো আছেন? আজ আপনাকে এত বিমর্ষ লাগছে কেন?
বিপাশাদির বিয়েটা কি আবার ভেঙে গেল?মন খারাপ করবেন না জেঠু।যেটা হয় ভালোর জন্যই হয়।আজকাল দিনকাল বড় গোলমেলে।সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।দিদিভাইকেও বলবেন চিন্তা না করতে’!
অঘোরবাবু যা করার তাই করলেন।অর্থাৎ উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে সমানে এগিয়ে চললেন আবার।বাজারে প্রায় চলে এসেছেন। মাছের ওদিকটার মূল প্রবেশদ্বারের সামনে একসময়ের সহকর্মী নীরেণ দালালের সাথে হঠাৎ দেখা।মুখোমুখি হতেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে নীরেণ বলে উঠলেন,’তোমার সেই ইন্স্যুরেন্সের ফোর টোয়েন্টি এজেন্টটা কই?ব্যাটা ভুলভাল পলিসি গছিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল!এখন ফোন করে তার টিকির সন্ধান পাই না! তোমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের উপদেশ শুনে আমার আজ এই অবস্থা’!
এই করতে করতে অঘোরবাবু সত্যিই শেষটায় বাজার পৌঁছলেন।একটা কিলো দেড়েকের আড় মাছ কিনলেন।বউ বলে দিয়েছে।মাছটা যখন যত্ন করে থলিতে ভরছেন তখন দেখলেন হাসি হাসি মুখ করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন অর্জুনপুর হাইস্কুলের প্রবীণ অংকের টিচার জয়ন্তবাবু।সামনে এসে অঘোরবাবুর হাতটা ধরে শ্রদ্ধায় ঝাঁকিয়ে বললেন,’ধন্যবাদ অঘোরদা।আপনার কথা ও উপদেশ মতো ছেলেটা আই. এ.এস প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে কোয়ালিফাই করেছে।কালই খবর হয়েছে।আমার বুক থেকে যেন একটা পাথর নামলো।বোঝেন ই তো আজকালকার অবস্থা।সত্যিই আপনাদের মত বিচক্ষণ দায়িত্ববান মানুষেরা সমাজের গর্ব।…
…অঘোরবাবু এক ঘন্টার মধ্যে বাজার সেরে বাড়িতে ফিরে এসেছেন।রাস্তায় অন্যদিনের মতো আজও গুটিছয়েক গড়পড়তা বাঙালির সাথে দেখা হয়েছে যারা শুধু কথা বলার জন্যই কথা বলে।তাতে আরেক জন উপকৃত হলেন, আঘাত পেলেন, অবাক হলেন, মজা পেলেন,না অযাচিত অবাঞ্ছিত ভাবলেন সেসব কথা; তাদের কিচ্ছু যায় আসে না।
●●●●●●●●●●●●●●
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯.০৭.২০২০