বয়ঃসন্ধিকাল,তার সমস্যা ও সমাধান
ড: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়,শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ,কলকাতা,৩০ অগাস্ট ২০২০
“তের চোদ্দ বছরের ছেলেদের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না,তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথা জ্যঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা। হঠাৎ কাপড়-চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বড় হইয়া ওঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধারূপে জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্ব এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব ও যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।
সে সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিকঠাক খাপ খাইতেছে না, এই জন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময় যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না, কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া থাকে।…”
(।।ছুটি।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মানব জীবনে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার মধ্যেকার যে পর্যায়,অতি সহজ ভাষায় তাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে।এর দুটি ভাগ।বৃদ্ধি ও বিকাশ।শরীরের পরিণত হওয়া হলো বৃদ্ধি আর মনের পরিণত হওয়া ,বিকাশ।শরীরের বৃদ্ধি কেবলমাত্র আয়তনে বৃদ্ধি এমন নয়।তার বিভিন্ন তন্ত্র বা সিস্টেমগুলির বৃদ্ধিও বটে।
এই অধ্যায় মানব জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময়ে মানবকুল অতি দ্রুত গতিতে শারীরিক,মানসিক এবং আত্মিক উত্তরণের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পরিণত মানব মানবী হিসেবে সমাজের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে।সাধারণত দশ থেকে উনিশ বছর বয়সকে বিজ্ঞানীরা বয়ঃসন্ধিকাল বলে অভিহিত করে থাকেন।এর অবশ্য মতভেদও আছে।
শারীরবৃত্তীয়ভাবে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার কারণ হলো মানব শরীরে যৌন হরমোনগুলির সক্রিয়তা বৃদ্ধি।বয়ঃসন্ধিকালের শুরু থেকে মস্তিষ্কস্থিত হাইপোথ্যালামাস এবং পিট্যুইটারি নামক গ্রন্থি দুটি এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে শুরু করে।এদের উদ্দীপনার কারণে স্ত্রী হরমোন(LH, FSH, OESTROGEN, PROGESTERONE)গুলি অধিক কার্যকরী হয়ে মানবীর স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ও ঋতুস্রাব শুরু হয়। পুরুষ হরমোন TESTOSTERONE এর অধিক কার্যকারিতার ফলে মানবের লিঙ্গ ও অন্ডকোষ আকার আয়তনে ও কার্যকারিতায় বেড়ে শুক্র উৎপাদন শুরু হয়।
মানব কিডনির উপরে স্থিত এড্রিনাল গ্রন্থি থেকে অধিক মাত্রায় এন্ড্রোজেন নামক হরমোন ক্ষরিত হয়ে মানব মানবীর যৌন কেশগুচ্ছের উদ্ভব,ব্রণ এবং বাহুমূলের নীচের বিশেষ গন্ধ হয়।এই পর্যায়ে যে কোনো একটি গ্রন্থির নিষ্ক্রিয়তা অথবা রোগের ফলে সৃষ্ট স্বল্প ক্ষমতার কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
দশ থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে মানবীর মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালের সূচনা হয় স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে।এর পর তার যৌনকেশগুচ্ছ নির্গত হয়। সবশেষে শুরু হয় ঋতুস্রাব। বিজ্ঞানীদের মতে অনধিক ষোলো বছর বয়সের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হলে তা স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে।
মানবের ক্ষেত্রে প্রথমে নয় থেকে চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যে শুক্রাশয় ও অন্ডকোষের বৃদ্ধি শুরু হয়।তারপর যথাক্রমে যৌনকেশের উদ্ভব, লিঙ্গের আয়তন বৃদ্ধি ও শুক্র উৎপাদন শুরু হয়। স্বরযন্ত্রের(LARYNX)বৃদ্ধি,গলার স্বর ভেঙে শেষ পর্যন্ত পুরুষালি কন্ঠস্বরের উদ্ভব হয়।কিছু ক্ষেত্রে স্তনগ্রন্থির তাৎক্ষণিক বৃদ্ধিও বিচিত্র কিছু নয়।এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজে নিজেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
বয়ঃসন্ধিকালীন মানবীর দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ২৮ সেমি পর্যন্ত এবং মানবের দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ৩০ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।এ বৃদ্ধির হার এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। এর বেশিটাই জিনগত এবং কিছুটা পরিবেশগত।মানবীর ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের আগে এবং মানবের ক্ষেত্রে যৌনকেশ নির্গত হওয়ার সময়কালে দৈর্ঘ্যবৃদ্ধির হার সর্বাধিক।প্রথম পর্যায়ে হাত ও পায়ের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি বেশি হয়,পরবর্তীতে শরীরের অন্য অংশগুলির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়। এইসময় মানব অস্থি, পেশী, রক্তের পরিমান ও বিভিন্ন শারীরিক সিস্টেম বা তন্ত্র প্রয়োজনীয় এবং আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।এই সব ব্যাপার গুলিতেই যৌন হরমোনসমূহের প্রত্যক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। যেহেতু এই সময়কাল মানব বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন- ফলত এই সময় সুষম খাদ্যেরও পরিমাণগত চাহিদা সমধিক।
ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবনা এবং সমাজ চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রেও বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়।বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম ভাগে মানব মানবী ব্যবহারের দিক থেকে খুব আবেগপ্রবণ হয়।হঠকারী হয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আবেগ তাদের নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে নানারকম বিপত্তি ঘটতে পারে। সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এই পর্যায়ের এক বিশেষ বৈশিষ্ট।যৌনতা নিয়ে কৌতূহলের উন্মেষও এই পর্যায় থেকেই শুরু হয়।পারস্পরিক যৌনাঙ্গের আকার এবং আয়তনের তুলনা সংক্রান্ত কৌতূহলের শুরু এই পর্যায় থেকে।
বয়ঃসন্ধির দ্বিতীয় ভাগে মানব মানবী তুলনায় স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখায়।ব্যবহারের দিক থেকে উদ্ধত ও দুর্বিনীত হয়।বড়রা যে পথে চলেন তার উল্টো পথে চলা অর্থাৎ নেগেটিভিসম এর মানসিকতা তৈরি হয় তাদের মধ্যে।ভাবনা চিন্তার মধ্যে যুক্তির উন্মেষ ঘটার ফলে সব খুঁটিনাটি বিষয়েই তারা কার্য-কারণ ব্যাখ্যা চায়।ফলে বড়দের সঙ্গে ,পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে,বিরোধিতা বাড়ে।বন্ধু বা সমবয়স্কদের সঙ্গে নৈকট্য তৈরি হয়। হস্তমৈথুন জাতীয় যৌন রোমাঞ্চের সূচনা বিকাশের এই পর্যায় থেকেই শুরু হয়। হস্তমৈথুন কিন্তু কোনো বিকৃতি নয়,যৌনতার ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক একটি স্তর।আজকাল বাবা মায়ের স্বপ্নপূরণের চাপ আর পড়াশোনার ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর ইঁদুরদৌড়ের যাঁতাকল এই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই পর্যায়ে পরিবারের পরিণতদের অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে ,সহনশীল হয়ে,যুক্তি দিয়ে,অনেকক্ষেত্রে আপাত পরাজয় স্বীকার করেও সমস্যার সমাধান করতে হবে।আজকাল নগরায়ন ও বিশ্বায়নের যুগ।এখন ‘কাউন্সেলিং’ বলে একটা গালভরা নাম এসেছে সমাজে।অভিবাবকেরা সহনশীল ও মননশীল হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োজন হয় না। কড়ামিঠে স্নেহ দিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অতি সহজে এদের আপাত উদ্ধত মনোভাবকে বশে আনা যায়।অভিভাবকদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে তাঁদের সন্তানকে।উপর উপর কিছু হবে না।
বয়ঃসন্ধির তৃতীয় ও অন্তিম পর্যায়ে নীতিশিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ এই গুণগুলি সাধারণত আয়ত্তে আসে। এই পর্যায়ে তারা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।পারিপার্শ্বিক ও পরিস্থিতির চাপে ভেঙে পড়ে না।বিপরীত লিঙ্গের প্ৰতি আকর্ষণ জন্মায়।যৌনতা ও যৌনক্রিয়ার উন্মেষ এই পর্যায় থেকেই শুরু হয়।পেশা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার শুরুও এই পর্যায় থেকেই। বাড়ির সঙ্গে আবার সুস্থ্য সম্পর্ক রচিত হয়।এই সময় কালের আগেই বাড়িতে এবং স্কুলে তাদের মধ্যে গর্ভনিয়ন্ত্রন,অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চাররোধ এবং যৌনরোগ সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি অতি আবশ্যক ও গুরুত্বপূর্ণ।পশ্চিমি দুনিয়া আমাদের থেকে এ ব্যাপারে অনেকখানি এগিয়ে আছে।সব ব্যাপারে তাদের যদি আমরা অন্ধ অনুসরণ করতে পারি,তাহলে এটাই বা পারবো না কেন?
যেহেতু তারা এই সময়টিতে না বড় না ছোট, বয়ঃসন্ধিকালে মানব মানবীর পারিপার্শ্বিক, পরিস্থিতিগত এবং মানসিক চাপ সব থেকে বেশি। লড়াইয়ের মাধ্যমে সমাজে নিজের অবস্থান বুঝে নেওয়ার এই বয়সে তাদের সমস্যাও বিস্তর।
এই বয়সের শারীরিক সমস্যাগুলি হলো খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত,ঘুম সংক্রান্ত, সংক্রমন ও যৌনরোগ সংক্রান্ত এবং জীবনযাত্রা প্রণালী সংক্রান্ত।
জীবনের এই পর্যায়ে খাদ্য এবং পুষ্টির চাহিদা সবথেকে বেশি। প্রয়োজনীয় পরিমানে ও আনুপাতিক হারে খাদ্যে প্রোটিন,ফ্যাট,শর্করা ভিটামিন,খনিজ এবং ফাইবারের যোগান না পেলে এদের রক্তাল্পতা ,ভিটামিন ও খনিজের অভাব সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
এই পর্যায়েই বড়দের সঙ্গে এবং সমবয়স্কদের সঙ্গে মনান্তর এবং মতান্তরের কারণে হতাশা, দুশ্চিন্তা, আত্মঘাতী প্রবণতা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি,হিংস্রতা,ভীরুতা, এইসব বিষয়গুলি দেখা যায়।
এ পর্যায়ে শরীর সতেজ রাখতে অন্ততঃ আট ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়না। তার সবথেকে বড় কারণ হলো পড়াশোনার চাপ। অনিদ্রা এবং স্বল্প নিদ্রার কারণে দিনের বেলা ঝিমুনি ভাব, বদহজম,পড়াশোনায় মনযোগ কম, খিটখিটে ভাব,হতাশা, ছটফটানি ভাব,এইসব বিষয়গুলি পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় অনেকে দিনের বেলায় অবাঞ্ছিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে(MICRO SLEEP). তাতে দুর্ঘটনার মতো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়।
রোগব্যাধির সংক্রমণ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত বিপজ্জনক।অধিক সময় বাইরে কাজে থাকা এবং কাটানোর জন্য এই বয়সে বিভিন্ন ত্বকের সংক্রমণ, অপরিশ্রুত জলের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা, অবাধ ও অবৈধ যৌনতার কারণে যৌনরোগ এসবের সম্ভাবনা বাড়ে।কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা এত তীব্র হয় যে আক্রান্তকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়।
স্থূলত্বের মতো অতিপুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যাও এই বয়সের একটি চ্যালেঞ্জ।এখনকার বাচ্চাদের শৈশব নেই,খেলার মাঠ নেই,খেলার সময় নেই,জীবনযাত্রায় শরীরচর্চার কোনো স্থান নেই। এর সঙ্গে জুটেছে দ্রুতগতির জীবনযাত্রা এবং নগরায়নের কুফল।ফলত বাড়ছে বয়ঃসন্ধির স্থূলত্বের হার।সঙ্গে তার কারণে পাল্লা দিয়ে এই বয়সেও বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস ,হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা। মানবীর স্থূলত্বের কারণে ‘পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম'(POLYCYSTIC OVARIAN SYNDROME) নামক রোগে অনিয়মিত ঋতুস্রাব,শরীরে অবাঞ্ছিত স্থানে কেশের বৃদ্ধি ইত্যাদি হয়।
এই বয়সেই নিষিদ্ধ ড্রাগ সেবন,মাদক দ্রব্য সেবনের কারণে বয়ঃসন্ধির মানব মানবী প্রবল শারীরিক এবং মানসিক সংকটে টানাপোড়েনে পড়ে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের আরও কিছু অবাঞ্ছিত সমস্যা আছে অথবা তার উদ্ভব হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের এ অঞ্চলে মানবী অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য, উৎপীড়ন, এবং এমন কি নিকট আত্মীয়ের দ্বারাও যৌন নিপীড়নের শিকার। এই বয়সেই পথ দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া এবং বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর হার বেশি।
পেশা এবং শিক্ষার কারণে গ্রাম থেকে শহরে আসা বয়ঃসন্ধির মানব মানবী অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে অসৎ সংসর্গে পড়ে ভিক্ষাবৃত্তি,চাকরবৃত্তি,দাসীবৃত্তি ও পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়। অনেকক্ষেত্রেই অবাঞ্ছিত গর্ভের সঞ্চার, যৌনরোগ ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখা যায়। শিক্ষাদীক্ষাহীন সমাজে বাল্যবিবাহের কারণে গর্ভধারণকালীন অসংখ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়,সেক্ষেত্রে নবজাতক বা মা যে কোনো কারোরই মৃত্যু ঘটতে পারে।
দূষণের কারণে এস্থ্মার প্রাদুর্ভাব ইদানীং অনেক বেশি। যথেচ্ছ মোবাইল,কম্পিউটার,ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশনের স্বাস্থ্য বিভ্রাট হিসেবে লিউকিমিয়া,ব্রেন টিউমার ইত্যাদির হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে,বেড়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহজলভ্যতা এবং রমরমার কারণে ও পশ্চিমী ভ্রান্ত জৌলুসের চাকচিক্যে ও রোমাঞ্চকর যৌনতার হাতছানিতে বয়ঃসন্ধি নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে বিভ্রান্তির পথে এগোচ্ছে।এর সঙ্গে দারিদ্র্য,বড়দের উপেক্ষা পরিস্থিতিকে জটিলতর এবং দুর্বিষহ করে তুলছে।
সব মিলে মানবজাতির বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যাগুলির জটিলতা ও গভীরতা বেশ ভীতিপ্রদ।তার সুষ্ঠু এবং ফলপ্রসূ সমাধানের জন্য শুধু মাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সচেতনতা নয়,চাই রাষ্ট্রীয় সচেতনতা এবং উদ্যোগও।
প্রথমে ঝুঁকির বিষয়গুলি ঠিকঠাক পেশাদারিত্বের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। যারা আক্রান্ত বা বিভ্রান্ত তাদের সঙ্গে মিশে তাদের ভরসা অর্জন করতে হবে। তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
১২ বছরের নীচে শারীরিক বা মানসিক পরীক্ষার জন্য অভিভাবকের এবং ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সে ব্যক্তি বিশেষের সম্মতি নিতে হবে। তাদের পুষ্টির সঠিক যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে।স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।সঠিক টিকাকরণের বিষয়টি দেখতে হবে, প্রয়োজনে সমস্যা সংক্রান্ত সঠিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে।মানসিক ভাবে তাদের ভরসার জায়গায় থাকতে হবে। অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চার রোধে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এডস,হেপাটাইটিস বি ইত্যাদি মারণ রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। জন্মনিরোধক পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের সম্যক অবহিত করতে হবে। তাদের আবেগের যথাযথ মূল্য দিতে হবে।পরিণত মানুষ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে।
মানবের পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্রে প্রতিটি বয়সেরই ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব আছে। সুস্থ, স্বাভাবিক ও সতেজ মানব মানবীর মিলনে উৎপন্ন হয় সুস্থ স্বাভাবিক ও সতেজ উত্তরপুরুষ। অবিভাবকদের দায়িত্বপূর্ণ ও সঠিক পরিচালনায় তারাই তৈরি করে দেশের জন্য শক্তিশালী যুব সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম,যাদের
হাতেই নিহিত থাকে দেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সোপান। খেদের বিষয় হলো এই যে, আমরা কেউই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। দায়িত্ব এড়িয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করে আলস্যে জীবন কাটিয়ে আমরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারি। চাই দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা,রাজনৈতিক পরিকাঠামো এবং আইনের প্রণয়ন।অন্যথায় যাবতীয় সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কেবলমাত্র আলোচনার টেবিলেই শেষ হয়ে যাবে,কাজের কাজ কিছু হবে না।
।।তথ্যসূত্র:GHAI. ESSENTIAL PEDIATRICS।।
।।EIGHTH EDITION।।