চরম অস্তিত্ব শঙ্কটে ভুগছে সুন্দরবন
হীরক মুখোপাধ্যায় (২৩ নভেম্বর ‘২০):- সরকার ও স্থানীয় কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ ও বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ চরম শঙ্কটের মুখে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বলে চিহ্নিত ‘সুন্দরবন’-এর অস্তিত্ব।যতদিন যাচ্ছে প্রাকৃতিক কারণেই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে রূপসী সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য ও তার চরিত্র। বনরক্ষকদের ইন্ধন ও অসহযোগিতায় একদিকে যেমন সুন্দরবন তার ঘণত্ব হারাচ্ছে, বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে তেমনই হারাচ্ছে তার গুরুত্ব।
সুন্দরবন ভারত ও বাংলাদেশের এক মিলিত বনজসম্পদের নাম। এর এক অংশ রয়েছে বাংলাদেশে, অন্য অংশ রয়েছে ভারতের এক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়।একসময় এই সুন্দরবন প্রসিদ্ধ ছিল তার বনজসম্পদ ও বন্যপ্রাণীর জন্য। লবনাম্বু উদ্ভিদের প্রাচুর্যের পাশাপাশি এখানকার ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ এই অঞ্চলকে বিশ্বের দরবারে খ্যাতি এনে দিয়েছে।সুন্দরবনের গহন অরণ্যের মধ্যে যেমন ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এর আস্তানা তেমনই রয়েছে ‘এপিস ইণ্ডিকা’, ‘এপিস ডরসাটা’ প্রজাতির মৌমাছিদের বসতি। ফলতঃ এখনো মধুঋতুতে এখান থেকে যে পরিমাণ বনজমধু আহরিত হয় তা সত্যি ঈর্ষণীয়।সমুদ্র সংলগ্ন এই বদ্বীপের ভেতর শিরা ও উপশিরার মতো বয়ে চলেছে কত না নদী, এই নদীতে রয়েছে হিংস্র কুমির। ভয়াল ভয়ঙ্কর এই সুন্দরবন অঞ্চল প্রাকৃতিক দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও, কিছু মানুষের বেহিসেবি লোভের ফলে এই অঞ্চল আজ কার্যত তার গরিমা হারাতে চলেছে।
গতকাল ‘সাইয়ার্ড’ এবং ‘ভূগোল ও পরিবেশ’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘সুন্দরবন : লাইভলিহুড এণ্ড সাসটেনেবিলিটি’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বারে বারে উঠে এলো এরকমই কিছু বিষয়।অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের অধ্যাপক আশিসকুমার পাল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের তরুণ অধ্যাপক দেবজিৎ দত্ত সহ সাইয়ার্ড-এর কর্ণধার ডঃ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকা ধ্বংসের বিষয়গুলো। আইলা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া, আমফান ভেঙে দিয়ে গেছে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা।আয়লা পরবর্তী সময়ে সরকার থেকে বলা হয়েছিল, “লোভের বশে লবনাম্বু শ্রেণীর উদ্ভিদের ইচ্ছাকৃত বিলোপসাধনের ফলেই সুন্দরবন অঞ্চলে আয়লার তাণ্ডব লীলা এত ধ্বংসাত্মক হয়েছিল।”
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে ইছামতী নদীর বুকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ সাজিয়ে তুলেছিল মাছরাঙা দ্বীপ। সেই সময় লবনাম্বু উদ্ভিদ দিয়ে ওই দ্বীপ ঘিরতে খরচ হয়েছিল কয়েক লাখ টাকা। উদ্বোধনের দিন মঞ্চে একাধিক মন্ত্রীকে সাক্ষী রেখে এই কথাটাই জানিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার তৎকালীন জেলা সভাধিপতি নন্দদুলাল ভট্টাচার্য। এঁনারই ভাই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন জলসম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। উদ্বোধনী মঞ্চে জেলা সভাধিপতি জানিয়েছিলেন “এই দ্বীপে একবছর আগে লাগানো হয়েছে লক্ষাধিক টাকার লবনাম্বু উদ্ভিদ..”, কিন্তু লঞ্চ থেকে খালি পায়ে জলে নেমে মঞ্চ পর্যন্ত হেঁটে যেতে গিয়ে একটাও লবনাম্বু উদ্ভিদ দেখতে না পাওয়ার কারণে আমার মতো কয়েকজন কলমচি এই বিষয়ে জানতে চাইলে আমাদের বলা হয়েছিল, “চারাগুলো পাঁকে বসানো হয়েছিল, ভাঁটার সময় ভেসে গেছে।”
এই বিষয়ে আমার সন্দেহ হওয়ায় একদিন সাক্ষাৎকার নেবো বলে বিরাটির খলিসাকোটায় জেলা সভাধিপতির বাড়িতে ঢোকার পথে দেখি ওখানে দাঁড়িয়ে বিরাট এক লবনাম্বু উদ্ভিদ। ওঁনার বাড়ির পাশে সমুদ্র বা নদীপথ নেই, আছে রেলপথ ও সড়কপথ। ওই পথ ধরে কীভাবে যে চারাটা ওঁনার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে শেকড় গেঁড়েছিল সেটা আজও আমার কাছে এক রহস্য।সুন্দরবন ও তার ভবিষ্যত, সরকারী উদ্যোগ, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রয়াস এই সমস্ত বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায় জানান, “আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সরকারী বিভাগকে নিয়ে ‘সাইয়ার্ড’ যেভাবে কাজ করছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই সংস্থা যেভাবে এগিয়ে চলেছে তা ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রকে নতুন করে উজ্জীবিত করবে।”বলে রাখা ভালো, বাস্তববাদী বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের আগ্রহী পড়ুয়াদের নতুন করে পথ দেখাচ্ছে ‘সাইয়ার্ড’।
সংস্থার প্রাণপুরুষ ডঃ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর কথা অনুযায়ী, “ছাত্রছাত্রীদের ভেতর শুধু মেধা আর উদ্যম থাকলেই কাজ হবেনা, ওদের সামনে রোজগার ও অগ্রগতির সঠিক দিশা দেখাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ভেঙেপড়া অর্থনৈতিক অবস্থা অতি সহজে বদলে দেওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো সময়োচিত সঠিক শিক্ষাদান।”বক্তাদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র, বাস্তুতন্ত্র, জীবন ও জীবিকার বিষয়। এখানকার পানীয় জলের সমস্যার কথা, মাটি ও চাষের জমি অত্যধিক লবনাক্ত হয়ে গিয়ে কৃষিকার্য চৌপাঠে ওঠার করুণ কাহিনী। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদের খাদ্য শঙ্কটের কথা, জলজ সম্পদ বিশেষতঃ ক্ষয়িষ্ণু মৎস্য সম্পদের কথা।বিভিন্ন প্রকল্পে সরকার ও উর্ধতন আমলাদের দীর্ঘসূত্রিতা এই অঞ্চলকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।আয়লার পর সুন্দরবন লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমায় এখনো বেশ কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে এখনো সেভাবে নদীবাঁধ মেরামত করা হয়নি। এরপর সুন্দরবনের উপর দিয়ে আবার তাণ্ডব চালিয়ে গেলো আমফান।
এই প্রাকৃতিক তাণ্ডবেও বিনষ্ট হয়েছে সুন্দরবনের ভেতর ও সুন্দরবন লাগোয়া ভারতীয় গ্রামগুলোর পারিপাশ্বির্ক পরিবেশ। সম্প্রতি গোদের উপর বিষফোড়া রূপে বিশ্বের বেশ কয়েকটা অগ্রণী দেশের বৈজ্ঞানিকগণ জানিয়ে দিয়েছেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই জলের তলায় চলে যেতে পারে বিশ্বের বেশ কয়েকটা দেশের সমুদ্র উপকূল, আর এই উপকূল ও তটভূমির মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলের নামটাও। তাই ঘোরতর শঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ভারতের সুন্দরবন উপকূল অঞ্চল, এখন থেকে যদি এই অঞ্চলের দিকে বিশেষ নজর না দেওয়া হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ভারত প্রাকৃতিকভাবেই হারাতে পারে সুন্দরবন।#Sundarban#RoyalBengalTiger#MangroveForest#Honey#Wood#FishAndPhysiculture#MerinProduct#Salainwater#Livlihood#Sustainability#RiverDam#Biodiversity#Ecology#MachrangaDeep#ZillaParishadNorth24Parganas#DepartmentOfForrest#DepartmentOfSundarbanAffairs#GovtOfWestBengal#Saiard
Photo By Suman Munshi