তদন্তে উচ্চশিক্ষা দফতর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শঙ্করকুমার ঘোষের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ও অনিয়মের অভিযোগ
বিশেষ প্রতিবেদন
তদন্ত কমিটি করে উচ্চশিক্ষা দফতর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শঙ্করকুমার ঘোষের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ও অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। বারকয়েক তদন্ত কমিটি কল্যাণী বিশব্বিদ্যালয়ে এসেছেন। ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক, শিক্ষক, আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীরা তাদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছেন। মূলত অভিযোগ জমা পড়েছে উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষ, পরীক্ষা সমূহের নিয়ামক বিমলেন্দু বিশ্বাস, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অলোক ঘোষ এবং দূরশিক্ষার ডিরেক্টর মানসমোহন অধিকারীর বিরুদ্ধে।
বিগত চার বছর ধরে বর্তমান উপাচার্য শঙ্করকুমার ঘোষের সৌজন্যে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় নানান বিতর্কে জড়িয়েছে। উঠেছে হাজারও অনিয়মের কথা। নিয়ম ভাঙাই যেন তাঁর মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের পদন্নোতি, চুক্তিভিত্তিক আধিকারিক ও কর্মী নিয়োগে ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। শুধুমাত্র স্বজনপোষণ ও নিয়ম ভাঙার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিদ্যায়তনিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন বাদ দিয়ে মামলা বাবদ লাখ লাখ সরকারি টাকা খরচ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় অন্দরের খবর, প্রশাসনিক ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যর্থতার জন্য ব্যহত হয়েছে উচ্চতর পঠন-পাঠন ও গবেষণা। সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলুষিত হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। ফলে ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের’ র্যাঙ্কিং-এ যা হবার তাই হয়েছে। বিগত চার বছরে অবনমন ঘটেছে ৪৬ ধাপ। বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক পরিবেশ ও প্রশাসনিক অবস্থা ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান একেবারে নিচে নেমে গেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত তালিকায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮৯তম। ২০১৯ সালে প্রকাশিত তালিকায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৯১ তম স্থানে। ২০১৮ সালে ছিল ৮৬, ২০১৭ সালে ৬৬ এবং ২০১৫ সালে ৪৫। কাজেই এই কয়েক বছরের র্যাঙ্ক প্রমাণ করে বিগত চার বছরে এই উপাচার্যের অদক্ষতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ভীষণভাবে অবনমন ঘটেছে। মনগড়া ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে র্যাঙ্কে আগে ওঠার অসৎ প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিগত চারবছরের র্যাঙ্ক প্রমাণ করছে, বিগত চার বছর ধরে শঙ্করকুমার ঘোষের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হয়নি, তেমনি প্রশাসনিক ব্যর্থতায় পঠন-পাঠন ও গবেষণায় খামতি দেখা দিয়েছে। এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তিও পূর্বের মত নিয়মিত ও নিয়মমাফিক হয় না। গতবছর পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তির জন্য তালিকা প্রকাশ করেও ছাত্র-ছাত্রীদের অনৈতিকভাবে ভর্ত্তি নেওয়া হয়নি। এ-নিয়েও হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। এছাড়া চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মানবীবিদ্যা কেন্দ্রে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনই দেওয়া হল না। এমনকি পাস করা পড়ুয়াদের চাকরির ক্ষেত্রেও তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করেনি বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছে, অযোগ্যদের হাতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দৈনদশা!
শঙ্করকুমার ঘোষের কার্যধারাতে স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপোষণ ভীষণভাবে হয়েছে বলে অভিযোগ। এক্ষেত্রে উপাচার্যকে সহায়তা করছেন কয়েকজন তাঁর কাছে অনৈতিক সুবিধাভোগী চাটুকার। উপাচার্য প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছেন বলে বহুবার অভিযোগ উঠেছে। নির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর উপাচার্যের বিরুদ্ধে তিনজনের দল গতমাস নভেম্বরের বারো তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করতে আসে। এই উপাচার্যের মেয়াদকালে বেস কয়েকবার উচ্চশিক্ষা দপ্তর থেকে তদন্ত করতে তদন্তকারি আধিকারিকরা এসেছেন।
উপাচার্য ও তাঁর সহযোগীদের নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপের শেষ নেই। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক অধ্যাপক দেবাংশু রায়কে অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছুটিতে পাঠান। তাঁর বিরুদ্ধে কোন ধরনের লিখিত অভিযোগ ছাড়াই তদন্তের নামে ছুটিতে পাঠায়। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভার সিধান্ত ছাড়াই নিবন্ধককে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে এবং তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে জানা যায়। দূরশিক্ষা বিভাগের দুই সহ অধিকর্তা সহ তিনজন শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষ চারজনের বেতন ও রিনুয়াল আটকে রেখেছেন। উচশিক্ষা দফতর কড়া ভাবে উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষকে শোকজ করেছে তারপরও তিনি অনৈতিক ও জোরপূর্বক অনিয়ম করে চলেছেন।
অন্যান্য বেনিয়মের বিষয়গুলি পরপর উল্লেখ করা হল: (১) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষক-গবেষিকারা তাদের ডিগ্রীর শংসাপত্র নির্দিষ্ট সময়ে হাতে পায়নি আজও। এর জন্য ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষক-গবেষিকাদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
(২) ২০১৮ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ তম সমাবর্তনে পিএইচডি ডিগ্রিধারী পড়ুয়াদের পিএইচডি ডিগ্রির পরিবর্তে উপাচার্য স্বাক্ষরিত ডিলিট শংসাপত্র প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য সে বছর বিদ্যায়তনিকভাবে ডিলিট শংসাপত্র প্রাপক ছিল না। অথচ বলা হয় ভুল করে এই ডিলিট শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। যে বছর ডিলিট শংসাপত্র প্রাপকই নেই, সে বছর কেন ডিলিট শংসাপত্র ছাপা হল? প্রায় ৩০ জনের বেশি পড়ুয়াকে পিএইচডি ডিগ্রীর বদলে ডিলিট শংসাপত্র দেওয়া হয় বলে জানা যায়। এই ঘটনা কেন ঘটলো তা খতিয়ে দেখতে কোন ধরনের বিচার-বিভাগীয় তদন্ত আজ পর্যন্ত হয়নি। আসলে এই ঘটনাই প্রমাণ করে উপাচার্যের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অস্বচ্ছতা। পরীক্ষা সমূহের নিয়ামকের স্ত্রীর ডিলিট ও অন্যদের অনিয়ম করে ডিলিট পাইয়ে দেওয়া কৌশল বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন।
(৩) দীর্ঘদিন ধরে কোর্ট, ইসি বা এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলের মিটিং না করে অগণতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপাচার্য এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে নজির গড়েছেন। এই ঘটনাও প্রমাণ করে উপাচার্যের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
(৪) ২০১৪ ও ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় তার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় ২০১৮ সালে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল অর্থাৎ চার বছর পর পুরানো বিজ্ঞাপনকে [Employment Notification- 03(Teach) DoR/2014 dated 29-08-2014 এবং 13(teach/off)/DoR/2015] কেন্দ্র করে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে আলোচনা না করে বা নতুন করে বিজ্ঞাপন না দিয়ে বেছে বেছে কিছু পদে নিয়োগ করেন উপাচার্য। এই দুটি বিজ্ঞাপনে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে 100 Point Roaster মানা হয়নি। আবার চার বছর পর পুরানো Advertisement থেকে ২০১৮ সালে গোপনভাবে নিয়োগ করা হয়েছে, যা করা যায় না। ২০১৭ সালে UGC ও রাজ্য সরকারের শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য নতুন বিধি বেরিয়েছিল। যেমন- GO No. 516-Edn(U)/IU-91/10 dated 16-05-2017 ( Dept. of Higher Education, Govt. of West Bengal)। UGC ও রাজ্য সরকারের এই Regulation কে লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ হয়েছে যা একেবারেই অনৈতিক। এক্ষেত্রে নতুন করে বিজ্ঞাপন না দেওয়ায় নতুন প্রার্থীরা যেমন সুযোগ পায়নি, পুরোনেরাও তাদের সিভি আপডেট করতে পারেনি এবং Reservation-এর ক্ষেত্রে 100 Point Roaster- নিয়ম প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বেনিয়ম ঘটেছে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগের প্রধান সুখেন বিশ্বাস নিজের স্ত্রীকে নিয়োগ করেছেন এবং নিজের ভাইরাভাইকেও নিয়োগ করেছেন উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষের সাহায্য নিয়ে। নিজের শালিকেও পিএইচডিতে ঢুকিয়েছেন। চরমভাবে অনিয়ম করে ওবিসি-এ পোস্টে নিজের স্ত্রীকে সাধারণ পোস্ট করে চাকরিতে নিয়োগ করেছেন সুখেন বিশ্বাস উপাচার্য শঙ্কর ঘোষের সাহায্য নিয়ে। এই নিয়ে আদালতে কেস চলছে।
(৫) ২০১৮ সালের নিয়োগে উপাচার্যর জন্যই একজন যোগ্য প্রার্থীর চাকরি বাতিল হয়। প্রথমে তাঁকে নিয়োগ পত্র দেওয়া হয় এবং নিযুক্তও করা হয়। কিন্তু পরে তার নিয়োগপত্র উপাচার্যের নির্দেশে বাতিল করা হয়। সুদীপ্ত মণ্ডল নামক ঐ প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করে উচ্চতর ন্যায়ালয়ের দ্বারস্থ হন। উপাচার্যের কৃতকর্মের খেসারত বাবদ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতি হেয়ারিং বাবদ প্রচুর টাকা উচ্চতর ন্যায়ালয়ে খরচ করতে হচ্ছে। অন্যায়ভাবে একজন প্রার্থীর নিয়োগ পত্র বাতিল এবং সরকারের টাকার তছরুপ করে উপাচার্য নজির সৃষ্টি করেছেন।
(৬) UGC, রাজ্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরি সমিতির (EC) অনুমোদন ছাড়ায় উপাচার্য ৩ টি নতুন কোর্স শুরু করেন। কোর্সগুলি হল: M.Sc in Genemo Science, M.Sc in Data Science এবং M.Sc Nano Science & Nanotechnology। উপাচার্য এই কোর্সগুলির জন্য ১৫ জন ও দূরশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করেন সরকারের কোনোরকম অনুমোদন ছাড়াই। UGC ২০.০১.২০২০ তারিখের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় UGC-র অনুমোদন ব্যতীত নতুন কোন কোর্স চালু করা যাবে না। অনুমতি না নিলে তার বৈধতাও থাকবে না বলে UGC- জানায়।
(৭) উচ্চশিক্ষা দপ্তর তথা রাজ্য সরকারের অনুমতি ব্যতীত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরি সমিতির (EC) অনুমোদন ছাড়াই প্রায় ৩০ জন চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক, ০৬ জন আধিকারিক ও বেশ কিছু কর্মী নিয়োগ করেছেন। এই নিয়োগের ক্ষেত্রেও স্বজনপোষণের অভিযোগ রয়েছে। আবার আধিকারিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞাপন না দেওয়া, তেমনি ইন্টারভিউ না নিয়ে নিয়োগের দৃষ্টান্তও রয়েছে। উপাচার্য শঙ্কর ঘোষ নিজের আত্মীয় স্বজনদের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
(৮) RUSA Programme-র জন্য ১ লক্ষ টাকা বেতন দিয়ে উপাচার্য তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনকে চুক্তিভিত্তিকভাবে Project Manager অন্যায়ভাবে নিয়োগ করেছেন। ঐ ব্যক্তির নাম হল ড. প্রদীপ মজুমদার। তাঁর MVSc ডিগ্রী রয়েছে, কিন্তু EDP training-র আভিজ্ঞতা তাঁর নেই। অর্থাৎ উপাচার্য ঐ পদে সঠিক যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ করান নি।
(৯) উপাচার্য নিজের পরিচিত সুশীলকুমার সাহাকে চুক্তিভিত্তিক অনুসারে ‘University Law Officer’ হিসাবে নিয়োগ করেছেন কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়াই। তাঁকে উপাচার্য নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অনেক অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছেন।
(১০) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভুল পদক্ষেপের জেরে ব্যাপকভাবে কোর্ট কেস হয়। ফলে কোর্ট কেস বাবদ বহুল পরিমাণে সরকারি আর্থিক ব্যয় হয়েছে।
(১১) বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষকের পদোন্নতি আটকে রয়েছে, ফলে ওই শিক্ষকেরা তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং অপরদিকে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
(১২) উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নির্দেশ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষক নিয়োগ না করে শূন্যপদ রাখা হয়েছে; যা বহুলভাবে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে।
(১৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই দশা। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা হয়নি।
(১৪) নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। এক্ষেত্রে বারবার উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি করেছেন। বিভাগগুলি হল- শিক্ষা বিজ্ঞান ও রসায়ন। বি.এড কোর্সেও কয়েকজনকে ভর্তি করা হয়েছে। এর ফলে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত হয়েছে।
(১৫) উচ্চশিক্ষা দপ্তরের হস্তক্ষেপে লোকসংস্কৃতির বিভাগে পিএইচডি কোর্সে ২০১৮ সালের ভর্তি ২০১৯ এ হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে পিএইচডির পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও এখনো অব্দি পিএইচডির মেধা তালিকা প্রকাশ হয়নি। ফলে ভর্তিও সম্ভব হয়নি। আর বিগত ২ বছর ধরে University Research Scholar (URS)-এর ভর্তি নেওয়া হয়নি।
(১৬) কয়েকজন গবেষকদের ন্যায্য ফেলোশিপ অন্যায় ও অনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আটকে রেখেছে।
(১৭) AIU- আয়োজিত Youth Festival-এ বর্তমান উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করে তাঁদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং বিভিন্ন পুরস্কার জিতেছে। বিগত চার বছরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কোন টিম পাঠায়নি। কাজেই ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় স্তরের এ ধরনের কার্যকলাপে প্রশাসনিক অব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
(১৮) অধ্যাপক উৎপল বিশ্বাস ও অধ্যাপিকা রীতা ঘোষ নিয়ম বহির্ভূতভাবে বেশি বেতন পাচ্ছেন, যা সরকারি অডিট রিপোর্টে ধরা পড়েছে। রাজ্য সরকারের নির্দিষ্ট দফতর থেকে তাঁদের টাকা ফেরানোর জন্য নির্দেশিকা বের হলেও তাঁরা সরকারের কাছে এখনও কোনও টাকা ফেরত দেননি। উপাচার্য এবিষয়ে এখনো পর্যন্ত উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
(১৯) কলা ও বাণিজ্য অনুষদের প্রাক্তন ডিন অধ্যাপক তপনকুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে দু’দুটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়ে তার তদন্ত হয়েছে। নিজের বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট টিউশনি করানো এবং তাঁর বিভাগেরই এক গবেষিকাকে মানসিক নির্যাতন সহ ক্যেরিয়ার ক্ষতি করার অপপ্রচেষ্টার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন হয়। অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রী সহ অন্যের লেখা হুবহু টুকে ডি.লিট ডিগ্রী পান। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউজিসির দফতর, রাষ্ট্রপতির দফতর, রাজ্যপাল দফতর তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও উপাচার্য তা ভ্রূক্ষেপ করেননি। বরং সাহায্য করেছেন। ফলে এবিষয়ে এখনও পর্যন্ত যথাযথ বিচার অধরা।
(২০) এমফিল ও পিএইচডি-র Regulation কে লঙ্ঘন করে উপাচার্য এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তির প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে Coursework করাচ্ছেন।
(২১) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মোতাবেক পরিকাঠামোগত উন্নয়নে ‘RUSA Fund’-র অর্থ ব্যয় না করে তা ভিন্ন কাজে ব্যয় হচ্ছে বলে অভিযোগ। ‘RUSA’ সম্পর্কে যাবতীয় কার্যকলাপ সমস্ত শিক্ষকদের কাছে সঠিকভাবে অবহিত করা হয়নি বলে অভিযোগ।
(২২) উপাচার্য বায়োমেট্রিক ডিভাইস স্বসিদ্ধান্তে ক্রয় করে বিপুল সরকারি টাকার অপচয় করেছেন। এই বায়োমেট্রিক ডিভাইসগুলি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
(২৩) যোগ্যতম শিক্ষকের পদোন্নতি অনৈতিকভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে।
(২৪) উপাচার্য তাঁর প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপছন্দের শিক্ষক-গবেষকদের নানাভাবে হেনস্থা করেছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বহু কোর্ট কেসও হয়েছে।
(২৫) উপাচার্য কোর্টের নির্দেশ অমান্য করেন। এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আদালতের রায় অবমাননার জন্য হাইকোর্টে Contempt Case হয়েছে।
(২৬) দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ন পদ Dean of Students’ Welfare (DSW) পদে নিয়োগ করান নি। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো-মন্দ ও সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্য কোন ‘full-time’ আধিকারিক নেই।
(২৭) বিগত সাড়ে চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।
(২৮) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের সামগ্রিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে মাঝে মাঝেই ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
(২৯) বিভিন্ন কোর্সে সঠিক সময়ে রেজাল্ট প্রকাশিত হয়না।
(৩০) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে উপাচার্য নিয়মবহির্ভূতভাবে Departmental Research Committee (DRC) বা বিভাগীয় গবেষণা সমিতির চেয়ারম্যান নিয়োজিত করেছেন। M.Phil & Ph.D. Regulation অনুযায়ী নিয়ম হল বিভাগের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষককে চেয়ারম্যান করা।
(৩১) উপাচার্য নিয়মবহির্ভূতভাবে দু’বছরের অধিক সময় ধরে একই ব্যক্তিকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুসারে করা যায় না। এছাড়া তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিকে বারংবার লঙ্ঘন করেছেন।
(৩২) উপাচার্য শিক্ষক, আধিকারিক, কর্মচারীদের ও গবেষক-ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেন। সংখ্যালঘু, তপশীল ও উপজাতি আধিকারিক, কর্মী, গবেষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অপমান করেন এবং নানভাবে হেনস্থা করছেন। কথায় কথায় হুমকি দেন, অসাংবিধানিক কথা বলেন। পঠন-পাঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সূত্রে অধ্যাপকরা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। এমনকি সংগঠনের পক্ষ থেকে সাক্ষাতের জন্য বারংবার চিঠি দিলেও তিনি দেখা করেন নি বলে জানা যায়।
(৩৩) বেআইনিভাবে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এবং ইন্টারভিউ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরবর্তী শিক্ষা কেন্দ্রে (ডিওডিএল) ৭০ বছরের একজন বয়স্ক তাঁর ঘনিষ্ঠ মানসমোহন অধিকারীকে অন্যায়ভাবে ডিরেক্টর পদে নিয়োগ করেছেন।
(৩৪) উপাচার্য দূরবর্তী শিক্ষা কেন্দ্রের আধিকারিক ও শিক্ষকদের পদের অবনমন করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অন্যায়ভাবে স্থানান্তরিত করেছেন। মূলত তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদেরকেই তিনি সেখান থেকে স্থানান্তরিত করেছেন।
(৩৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষার অব্যবস্থার ফলে ফলে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী হয়রানির শিকার হয়েছে।
(৩৬) ইউজিসি অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নেট/সেট কোচিং সেন্টার চালু ছিল, তা এখন প্রশাসনিক ব্যার্থতায় বন্ধ রয়েছে।
(৩৭) উপাচার্য প্রাণীবিদ্যা বিভাগে এগ্রিকালচার বিষয়ে এম.এসসি করা একজনকে শিক্ষক পদে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ করেছেন। ঐ ব্যক্তির প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে কোন ডিগ্রী নেই। ঐ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছিল তা তাঁর নেই।
(৩৮) গত ২৪-০৭-২০২০ তারিখে উপাচার্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে দুজন অধ্যাপককে অস্থায়ীভাবে ডিন পদে নিয়োগ করেন। তাঁরা হলেন কলা ও বাণিজ্য ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র সরকার এবং বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ডিন (অস্থায়ী) অধ্যাপক ইদ্রজিৎ লাহিড়ী।
(৩৯) চুক্তিভিত্তিক কয়েকজন নিজের ঘনিষ্ঠ আধিকারিক, শিক্ষক ও কর্মচারীদের উপাচার্য ইচ্ছে মত বেতন বৃদ্ধি করেছেন রাজ্য সরকারের অনুমতি ব্যতিত এবং Finance Committee ও Executive Council-র সভার সিধান্ত ছাড়াই। এভাবে সরকারী টাকার অপচয় হচ্ছে তাঁর সময়কালে।
আরও অনেক বেনিয়মের অভিযোগ উপাচার্যের বিরুদ্ধে রয়েছে বলে সূত্রের খবর। উপাচার্য ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কার্যকলাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অচলবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, বিধি ও উপবিধি এবং নিয়মনীতিকে অমান্য করে নিজের মর্জি মতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। ফলে ভুরি ভুরি বেনিয়ম সংঘঠিত হচ্ছে। যেখানে মূখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যজুড়ে শিক্ষার উন্নয়নের ধারা ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তী দেশব্যপী স্বীকৃতি পা সেখানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ লোকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাল দশা বারংবার রাজ্যের ভাবমূর্তীতে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান উপাচার্য শঙ্করকুমার ঘোষের অপশাসনের আশায় অপেক্ষা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকলেই। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ পুনরায় ফিরে আসুক বলে অনেকেই কামনা করছেন।
অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পেশের বিতর্কে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
এন আই আর এফ র্যাঙ্কিং-এর জন্য তথ্য পেশের বিতর্কে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এল। বিগত চার বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় নানান বিতর্কে জড়িয়েছে। উঠেছে হাজারও অনিয়মের কথা। নিয়ম ভাঙাই যেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের পদন্নোতি, চুক্তিভিত্তিক আধিকারিক ও কর্মী নিয়োগে ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। শুধুমাত্র স্বজনপোষণ ও নিয়ম ভাঙার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বিদ্যায়তনিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন বাদ দিয়ে মামলা বাবদ লাখ লাখ সরকারি টাকা খরচ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় অন্দরের খবর, প্রশাসনিক ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যর্থতার জন্য ব্যহত হয়েছে উচ্চতর পঠন-পাঠন ও গবেষণা। সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলুষিত হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। ফলে ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের’ র্যাঙ্কিং-এ যা হবার তাই হয়েছে। বিগত তিন বছরে অবনমন ঘটেছে ৪৬ ধাপ। এবছরের এন আই আর এফ র্যাঙ্ক প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা মহলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে অসত্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পেশের প্রসঙ্গ নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরই ধারণা, এবছরে এন আই আর এফ কে সঠিক তথ্য দিলে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম একশোর তালিকার মধ্যেই থাকতো না। এবার বিতর্কিত সেই সব তথ্যের নমুনা পেশ করা যাক। পাশ করা পড়ুয়াদের পেশ করা চাকরীর বার্ষিক বেতনের গড় সম্পর্কিত তথ্য নিয়েও কলকাতার মত কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা দিয়েছে সংশয় এবং উঠছে নানান প্রশ্ন। যেমন, চার বছরের স্নাতক পাঠক্রমের ক্ষেত্রে আগের বছর বেতনের বার্ষিক গড় দেখানো হয়েছিল তিন লক্ষ, আর এবছর আরোও এক লক্ষ আশি হাজার বাড়িয়ে দেখানো হল চার লক্ষ আশি হাজার, যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি। মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা বেশী কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এ-তথ্য কী বিশ্বাসযোগ্য! হ্যাঁ, এ-প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা প্রয়োজন ২০১৫-২০১৬ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ছিল দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার। ফলে অসাঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধি অনেকেরই চোখে লাগছে। এই পেশ করা তথ্যের ভিত্তি নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। একইভাবে দু’বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও বার্ষিক বেতনের গড় বেড়ে হয়েছে সাড়ে তিন লক্ষ। তিন বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে চার লক্ষ, আগের বছরে যা ছিল দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার। এক্ষেত্রেও বৃদ্ধি পেয়েছে এক লক্ষ ষাট হাজার। অথচ ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ সালে একই ছিল অর্থাৎ দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার। পাঁচ বছরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে যে সংহত পাঠক্রম, সেক্ষেত্রেও বার্ষিক বেতনের গড় পঞ্চাশ হাজার বেড়ে হয়েছে সাড়ে তিন লক্ষ থেকে চার লক্ষ। এই তথ্যগুলি প্রায় ২০১৭ সালে প্রদেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যের কাছাকাছি। ফলে এ-নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে কল্যাণী তো কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত মানের নয়! তাহলে উপযুক্ত প্লেসমেন্টের পরিকাঠামো ও ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও কল্যাণীর তথ্য ঐ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বা প্রায় কাছাকাছি হচ্ছে কি করে!
পিএইচডি সংক্রান্ত তথ্য পেশের ক্ষেত্রেও অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে। ২০১৭-২০১৮ সালে পিএইচডিতে নাম নথিভুক্ত রয়েছে এমন পূর্ণ সময়ের গবেষকের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে ২০৭ জন। সেখানে পার্টটাইম কোন গবেষক নেই বলে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কোনো পার্টটাইম গবেষক নেই? অথচ দেখা যাচ্ছে অনেক বিভাগেই পার্টটাইম গবেষক রয়েছেন। এছাড়া, ইতিমধ্যে যারা পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন তাঁদের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, ২০১৫-২০১৬ সালে পূর্ণ সময়ের গবেষকের পরিসংখ্যান ১৩৯ জন এবং পার্টটাইম গবেষক ১৬ জন। ২০১৬-২০১৭ সালে তা হয়েছে যথাক্রমে ১৫১ ও ১৯। অথচ অবাক করা তথ্য, ২০১৭-২০১৮ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেছে এমন পূর্ণ সময়ের গবেষক ছিলেন ২০৯ জন। সেখানেও পার্টটাইম কোন গবেষক নেই। ফলে পিএইচডি সংক্রান্ত তথ্য পেশেও যথেষ্ট অসঙ্গতি রয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠছে প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরিকাঠামোগত তথ্য পেশের ক্ষেত্রে। প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে এন আই আর এফ-এর মূলত তিনটি প্রশ্ন রয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলিতে লিফট্/র্যাম্প আছে কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে তথ্য প্রদান করেছে তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি হাস্যকরও বটে। কেননা ২০১৬-২০১৭ তে তথ্য দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবনগুলিতে লিফট্/র্যাম্প আছে। আর এবারের (২০১৯) তথ্যে বলা হয়েছে আশি শতাংশ ভবনে লিফট্/র্যাম্প আছে। তাহলে আগের বছরের থেকে লিফট্/র্যাম্পের সংখ্যা কমে গেল! আসলে এই দু’বছরই এন আই আর এফ-এর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসত্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পেশ করেছে। বরং ২০১৪-২০১৫ ও ২০১৫-২০১৬ অর্থাৎ ২০১৬ ও ২০১৭ সালের র্যাঙ্কিং-এর জন্য এই প্রশ্নের অনেকটাই সঠিক উত্তর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিয়েছিল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল কিছু ভবনে এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ঠিক একইরকম অসত্য তথ্য প্রদান করা হয়েছে প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার সম্পর্কিত প্রশ্নের ক্ষেত্রেও। প্রশ্ন দু’টি হল: (১) প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হুইলচেয়ার, হাঁটার সাহায্যকারী উপকরণ ও এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাতায়াতের জন্য যানবহনের ব্যবস্থা আছে কি না? এবং (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলিতে প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষভাবে গড়ে তোলা শৌচালয় আছে কি না? এই দু’টি প্রশ্নের ক্ষেত্রে এবছরের র্যাঙ্কিং-এর উত্তর হিসেবে দেওয়া হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি শতাংশ ভবনেই এই ব্যবস্থা রয়েছে। আর আগের বছর বলেছিল, সব ভবনেই এই ব্যবস্থা ছিল। কাজেই খুব সহজেই চোখে পড়ছে তথ্য পেশের নজিরবিহীন অসঙ্গতি। অথচ এ-বিষয়ে ২০১৪-২০১৫ ও ২০১৫-২০১৬ অর্থাৎ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে জানিয়েছিল প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এ-সবের কোন ব্যবস্থ্যা নেই। বাস্তবে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্রই লিফট্ রয়েছে, যা প্রশাসনিক ভবনে অবস্থিত। আর কোন ভবনে লিফটের ব্যবস্থা নেই। র্যাম্পের ব্যবস্থা মাত্র কয়েকটি ভবনে রয়েছে, যা ব্যবহারের মত যথোপযুক্ত নয়। এছাড়া হুইল চেয়ার, হাঁটার সাহায্যকারী উপকরণ, এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাতায়াতের জন্য যানবহনের ব্যবস্থা ও বিশেষভাবে নির্মাণ করা শৌচালয় – এইসব পরিষেবা, ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নেই।
মনগড়া ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে র্যাঙ্কে আগে ওঠার অসৎ প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। বিগত তিনবছরের র্যাঙ্ক প্রমাণ করছে, বিগত তিন বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হয়নি, তেমনি প্রশাসনিক ব্যর্থতায় পঠন-পাঠন ও গবেষণায় খামতি দেখা দিয়েছে। এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তিও পূর্বের মত নিয়মিত ও নিয়মমাফিক হয় না। গতবছর একটি বিভাগে এমফিল ও পিএইচডি কোর্সে ভর্ত্তির জন্য তালিকা প্রকাশ করেও ছাত্র-ছাত্রীদের অনৈতিকভাবে ভর্ত্তি নেওয়া হয়নি। এ-নিয়েও হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। এছাড়া চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মানবীবিদ্যা কেন্দ্রে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনই দেওয়া হল না। এমনকি পাস করা পড়ুয়াদের চাকরির ক্ষেত্রেও তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করেনি বলে বিশ্ববিদ্যালয় সুত্রে খবর। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছে, অযোগ্যদের হাতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দৈনদশা!