“সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তি সমন্বিতে”
||ভয়েভ্যস্ত্রাহিনো দেবী দুর্গা দেবী নমোহস্ত্ততে||
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী, কোচবিহার
ভয় নিয়ে কিছু লিখতেও এখন ভয় করে না জানি, পাঠক-মশাই আবার ফোনে না আমায় ভয় দেখান। বাড়িতে বউ এর ভয়, স্কুলে শিক্ষকের ভয়, অফিসে বস এর ভয়, পথে লরি’র ভয়,পাড়াতে দাদা’র ভয়, সমাজে নেতা-নেত্রী’র ভয়, দেশে মন্ত্রী-আমলাদের ভয়, সারা পৃথিবীতে করোনা’র ভয়। বলি, যাবেন টা কোথায়, শুনি?
এক সময়ের সেই Love-oriented lifeটা ই কেমন যেন রাতারাতি Fear- oriented হয়ে গেছে… তাই না ?
আমার যেন কোথাও মনে হয়, কারণে ভয়ের চেয়ে আমরা অকারণেই ভয় পাই বেশি। আচ্ছা, FEAR এর মানে, “Fantasized Experience Appearing Real” যদি এমনটা মনে করা হয় খুব ভুল হবে কী ?
ঋক্ বেদ এর বহু সূক্তে মন্ত্রের শেষে ” অভয়ং কুরু.… অভয়ং কুরু..…..” এমন প্রার্থনা তখনকার ভয়াল প্রকৃতি’র উদ্দেশ্যে পাওয়া যায় ।বেদ এ এমন ও লেখা আছেঃ
“ওঁ অভয়ং মিত্রাৎ অভয়ং অমিত্রাৎ অভয়ং জ্ঞাতাৎ অভয়ং পরোক্ষাৎ। অভয়ং নক্তম্ অভয়ং দিবা ভবন্তু।।
“হে ব্রহ্ম!আপনি বন্ধু-শত্রু, জ্ঞানী-অজ্ঞান, দিন ও রাত্রিতে আমাদের অভয় দান করুন। এতেই স্পষ্ট, কোন না কোনো ভয় আমাদের সঙ্গে সেদিন থেকেই ছিল, আছে আজও। (ষষ্ঠ সূক্ত : অভয়ম [ঋষি : অথর্বা। দেবতা : ইন্দ্র ও মন্ত্রোক্ত উদ্দিষ্টগণ। ছন্দ : বৃহতী, জগতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ।] রেফারেন্স লাইব্রেরি » বাংলা বেদ » অথর্ববেদ সংহিতা » ১৯।২ ঊনবিংশ কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক ॥৫॥ অভয়ং মিত্রাদভয়মমিত্রাদভয়ং জ্ঞাতাদভয়ং পুরো যঃ। অভয়ং নক্তমভয়ং দিবা নঃ সর্বা আশা মম মিত্রং ভবন্তু ॥৬॥)
কঠোপনিষদ্ এর ২ য় অধ্যায়ের***
৩য় বল্লীতে ঋষি জানাচ্ছেনঃ ” ভয়াদস্যাগ্নি ভয়াত্তপতি সূর্মঃ। ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ূশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।।” অর্থাৎ পরমচৈতণ্য-স্বরূপ ব্রহ্ম’র ভয়ে অগ্নি তাপ দান করেন, সূর্যদেব আলোক দেন, ইন্দ্রদেব বর্ষণ করেন, বায়ূ প্রবাহিত হয়, জীবের সায়াহ্নে মৃত্যূ-দেবতা এসে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করেন।
(***কঠোপনিষদ্ (সংস্কৃত: कठोपनिषद्) (Kaṭhopaniṣad) হল অন্যতম মুখ্য (প্রধান) একটি উপনিষদ্। এই উপনিষদ্টি যজুর্বেদের কঠ শাখার শেষ আটটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে নিহিত রয়েছে। [এই উপনিষদ্ কাঠকোপনিষদ্ নামেও পরিচিত। ১০৮টি উপনিষদের মুক্তিকা শাস্ত্রের ক্রমসংখ্যা অনুসারে কঠোপনিষদ্ হল তৃতীয় উপনিষদ্। কঠোপনিষদ্ দু-টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রত্যেকটি অধ্যায় আবার তিনটি করে ‘বল্লী’ বা অংশে বিভক্ত। মনে করা হয়, প্রথম অধ্যায়টি দ্বিতীয় অধ্যায়ের পূর্বে রচিত হয়েছিল। এই উপনিষদ্টি হল ঋষি বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা ও হিন্দু মৃত্যুদেবতা যমের সাক্ষাৎকারের কিংবদন্তি উপাখ্যান। তাদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে মানব-প্রকৃতি, জ্ঞান, আত্মা ও মোক্ষ-সংক্রান্ত বিষয়গুলি উঠে আসে।)
বাইবেলে এসেও দেখবেন সেই একই চিত্র-নাট্য। “Old Testament” এ ‘ভয়’ শব্দটি তিন’শ বারের মতো পাবেন। মানসিক-রোগ বিশেষজ্ঞদের
কাছে ভয় এর ‘Phobia’ শব্দে পরিভাষিত হয়।
একাকিত্বের ভয় এর পোশাকি নাম ‘Monophobia, or the fear of being alone’, সূঁচ-জাতীয় সূক্ষ্ম ধারালো বস্তুর ভয়কে বলা হয় ‘Aichmophobia’, বমি করার ভয় ‘Emetophobia’, বদ্ধঘরে থাকতে ভয় ‘Claustrophobia’, বিদ্যুৎ-ঝলকের ভয় কে বলে ‘Astrophobia’….এগুলো না হয় মানা গেল কিন্তু এমনও দেখা গেছে, কেউ কেউ ৪ এই বিশেষ সংখ্যাটিকে ই ভয় করেন তাদের কে বলে ‘Tetraphobia’ তে আক্রান্ত । আবার “Anthophobia – An abnormal and persistent fear of flowers”, শুধু ফুল দেখা মাত্রই কারো কারোর Panic attack হয়ে যায়। এটা মেনে নেওয়া কঠিন হলেও বাস্তব। আর, এই ভয় এর প্রকৃত কারন খুঁজে পেয়ে মুশকিল এর আসান করা সত্যিই আরও এক মুশকিল !
তাহলে, ভয় কী শুধুই ঋণাত্মক অর্থে বা শ্লেষ-বাচক ? না। মোটেই তা নয়। নিগূঢ় অর্থে, ভয় অবশ্যই ধনাত্মক, এ এক ধরণের অনুশাষণ; আত্ম-সংবরণ। দুর্বলতা বা হীনমন্যতা..নৈব নৈব চ। তাহলে, ভয় বস্তুটি কী? যা’কে নিয়ে এত এতো কূট-কাচালী, এতো কাটা-ছেঁড়া!
ভয় হল আসলে, মনের এক বিশেষ অবস্থা যা স্থায়ী এবং অস্থায়ী দুটোই হতে পারে; আগেই বলেছি, কারণে বা অকারণে অলীক কল্পনাতে ভর করে মনে আসতে পারে। তাহলে, ভয় মানে শুধুই ঋণাত্মক বা শ্লেষ-বাচক?… না। তা কেন হবে?
খ্রীষ্টান ধর্মের একটি মূল্যবান বই এর নাম ”PROVERB” (Proverbs 1:1–7)। এতে লেখা আছে “The fear of the LORD is the beginning of wisdom, and knowledge of the Holy One is understanding.”। আবার Epistle (বাইবেল এর চিঠি-পত্র অংশ) এ জন-পল,পিটার এঁরা লিখছেন ” “There is no fear in love, but perfect love casts out fear. For fear has to do with punishment, and whoever fears has not been perfected in love.” – 1 John 4:18 ESV”। মনে প্রকৃত গাঢ় ভালোবাসা এলে ভয় পালিয়ে যায়।” এটাই সঠিক।
আবার যুধিষ্ঠির মহারাজ মহাভারতে বলছেন, “পাপকে আমি খুব ভয় করি”। রামায়নে দেখুন মধ্যরাতে, যোগ-বল এর প্রভাবে, স্বর্ণলঙ্কাতে ঘুমন্ত-অর্ধ আবৃত নারীদেহে চোখ পড়া মাত্র মহাবীর হনুমানজী পর্যন্ত ভয় পেয়ে বলে উঠছেন,“এ আমি কী করলাম! আমি না অখন্ড ব্রহ্মচারী!”। এখানের ভয় “হ্রী /বিশেষ্য পদ/ লজ্জা, ব্রীড়া।” রূপী মহৎ-চেতনারই দ্যোতক।
শ্রী শ্রী চন্ডীতে যদিও সর্বপ্রকারের ভয় থেকে মুক্তি পেতে দেবী’র কাছে মাতৃভক্তের প্রার্থনা শোনা যায়…” ওঁ সর্ব্বেস্বরুপা সর্ব্বেষে সর্ব্বশক্তি সমহ্নিতে ভয়েভ্যোস্ত্রাহিনো দেবী দুর্গে দেবী নমস্তুতে।। জয় মা জয় মা জয় মা” তবে জানা নেই এ সব শুনেই কি তবে কবিগুরু তাঁর গীতবিতানের বিচিত্র পর্বে লিখছেনঃ
“সেই অভয় ব্রহ্মনাম আজি মোরা সবে লইলাম
যিনি সকল ভয়ের ভয়।”
সত্য এটাই। ভয়কে জয় করতে হার্দিক ভালোবাসাই একমাত্র শস্ত্র। ঈশ্বরের প্রতি বা তাঁর সৃষ্টির প্রতি আমাদের প্রেমের ঘনত্ব যতো বাড়বে| ভীতির পরিমান ততোই কমবে। এভাবে বাড়তে বাড়তে প্রেম যেদিন তার পরাকাষ্ঠায় পৌঁছে যাবে, পিছন ফিরে দেখবেন ভয় নামের বস্তুটি গুটি-বসন্তের মতো অস্তিত্ব-সংকটে পড়ে, সেও তার অস্তিত্ব হারিয়েছে! সেই সু-দিনটি’র আশায় চাতকের মতো অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ও তো তেমন কিছু দেখি না। দেখা যাক।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarians who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.