মহাভারতের কথা অমৃত সমান
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী।
বনপর্ব” তে..…. সারা “কৃষ্ণ-মৃগ” অঞ্চল পরিভ্রমণ করে, হিমালয় চড়ে যুধিষ্ঠির আদি পান্ডব ভায়েরা দ্রৌপদী সহ পথ চলতে চলতে বরফাবৃত বদ্রীকাশ্রমের সেই নিরালা-নিবেশে তপস্যা-রত মহামুনি আষ্টিসেন এর আশ্রমে এসে পৌঁছেছেন। অবশ্যই, সাথে আছেন ধৌম্য ঋষিও।
এঁদের দেখে, আসন থেকে উঠে এসে সানন্দে স্বাগত জানালেন মুনি। দ্রৌপদী সহ সবাই মুনির চরণে মাথা ঠেকিয়ে বিনম্রতা জ্ঞাপন করলেন। কুশল বিনিময় এর শেষে উভয়ের মধ্যে স্বল্প অথচ উচ্চ-কোটির জীবনমুখী যে বাক্যালাপ হয়েছিল ….. সেটাই আজ আমাদের আলোচ্য।
মহর্ষি বিলক্ষণ জানেন যুধিষ্ঠির মহারাজ কে। সমূহ পরিচিত মুনি তাঁর স্থিতির সাথেও। তবু মাত্র, ঠিক একটি পৃষ্ঠার আলাপ কেন? ‘মহাভারত’ যে আদতেই একটি Highly Realistic literature কিনা ! ‘রামায়ণ’ হোল Idealistic- literature । রামায়ণ এর ‘রাম’ পুরুষোত্তম…. আমাদের নিত্য-পূজ্য। পতিব্রতা ‘সীতা’…. সবারই আদরণীয়া। ‘লক্ষ্মণ’ বা ‘ভরত’র মতো ভাই ভাগ্যগুনে মিলে…. কোনো দ্বিমত নেই। ‘হনুমান’ তো ভক্তি আর আনুগত্যের শেষ কথা।
‘রাবণ’ এর মতো একনিষ্ঠ শত্রু এই কোয়ার্জ নিয়ন্ত্রিত যুগেও দুর্লভ। সত্যি বলতে কি, হনুমানজী যে “Truest friend and noblest foe”
আসলে, সব ক’টা চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে আমাদের আদর্শ । এঁদের নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে, স্বপ্ন দেখা যায়….. কিন্তু চাইলেও এঁদের মতো ‘দাদা’, ‘ভাই’, ‘ভক্ত’ বা ‘শত্রু’ হওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই জীবনটাকেও এমন আদর্শ পথে গড়ানো সম্ভব কী? সে দিক থেকে ‘মহাভারত’ কে আপনাকে একধাপ এগিয়ে রাখতেই হবে। এটাই যেন ঠিক-ঠিক্ আমাদের বাস্তব-জীবনে চলার পথ। “এই জীবনের পথ সোজা নয় যেন আঁকাবাঁকা বন্ধু……”।
মহাভারত অতি মূল্যবান এক Vertical literature কিনা !
সে যাক্। কথোপকথন এর মধ্য দিয়ে ঋষি এখন অর্জুন ছাড়া বাকি পান্ডবদের স্থিতি কেমন, তা বুঝার চেষ্টা করছেন।
প্রথমেই আষ্টিসেন যুধিষ্ঠির মহারাজ কে বলছেনঃ
“নানৃতে কুরুষে ভাষম্
কশ্চিৎ ধর্মে প্রবর্তসে
মাতাপিত্রৌশ্চতে বৃত্তি
কশ্চিৎ পাতন সীদতি।”
অনৃত বা অসত্য ভাবনা মনে আসে কী না, মন সবসময়েই ধর্ম-চিন্তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে কী না, মা-বাবা বা পূর্ব-পুরুষদের অধ্যাত্মিক পরম্পরার প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল তো ?
এরপরে মুনি জানতে চাইছেনঃ গুরুজন, বয়সে- জ্ঞানে বা তপস্যাতে বৃদ্ধ ব্যক্তি, বিদ্বানদের প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল তো ? সামান্য কোন উপকারী ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শণ করেন কী?
অপকারি ব্যক্তির প্রতি উদাসীনতা দেখান তো? সঙ্গে থাকা, ধৌম্য মুনি বা সাধু-সন্তজন আপনার প্রতি প্রসন্ন থাকেন তো?
বলছেন, ” দানধর্ম তপঃ শৌচ আর্যধর্ম তিতিক্ষয়া”……. অর্থাৎ দরিদ্র-দুঃখী বা সনাতন কর্মে কিছু না কিছু দান করা, প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যানাদিকরা, ধোয়া-কাচা-স্নান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাহ্যিক শৌচ এবং পারমার্থিক বিষয়ে কিছু সদ্-গ্রন্থের নিত্য পঠন-পাঠন-শ্রবণ-চিন্তন ও অপরের মঙ্গল চিন্তার দ্বারা আভ্যন্তরীণ শৌচ হয়। তিতিক্ষা (√তিজ্+সন্+অ+আ)…..মানে, মনে কষ্ট হোলেও সহনশীল হওয়া, সহিষ্ণুতা দেখানো ….
“সহনম্ সর্বদুঃক্ষানাম্”…..এই নীতি মহারাজ মেনে চলেন কি না।
আর বক্তব্যের শেষ দিকে এসে মুনি বলছেনঃ
” পিতামাতা তথৈবাগ্নিঃ গুরুঃ আত্মা চ পঞ্চমঃ”
অর্থাৎ পিতা-মাতা-গুরু’র প্রতি কর্তব্য পরায়ন হয়ে সেবা’র মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ জাগবে ( Humanity in a Man) ; ‘অগ্নিহোত্র’ আদি
করলে অধ্যাত্মিক পথে যাত্রা শুরু হবে আর আত্ম- বিদ্যার অনুশীলনে জীব মুক্ত হবে….” সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে।”
আতিথ্য সহকারে এবার সবার উদ্দেশ্যে মুনি বললেন, যেহেতু আমাদের পরিবারে কোন দুষ্ট আত্মা জন্ম নিলে স্বর্গ-লোক থেকে পূর্ব- পূর্বপুরুষরা কাঁদেন|
” হায় রে! এদের সারাজীবনের দুষ্কর্ম-ফলে আমরা কতো কষ্ট টাই না পাবো!” আবার সুদ্ধ-আত্মা জন্ম নিলে তাঁরাই হেসে বলেন|
ও হো ! ” কূলম্ পবিত্রম্ জননী পবিত্রা “। তাই, সব ধরনের চপলতা ত্যাগ করে , দেহ-মনে সংযম রক্ষা করে, ফল-মূলাদি মুনি-ঋষি’র খাদ্য খেয়ে তাঁরা এখানেই অবস্থান করুন, যতদিন না অর্জুনের সাথে দেখা হয়।
প্রশ্ন জাগে, মহাভারত এর দেওয়া এই Frameless glass এর মাধ্যমে দেখা, অখন্ড ভারতবর্ষের এমন সনাতন ভাবনায় আমাদের মন ভাবিত হবে কবে ?
রূচি-শীল হয়ে শুচি-শীল মনে, চুরি না করে, দান করতে ইচ্ছে হবে কবে, গোলি না মেরে, ফুল ছুঁড়তে বাসনা জাগবে কবে আর অন্যকে বদল বদল করার ভ্রান্তচেষ্টা না করে….. নিজেই বদলাবো কবে ? আমার বিশ্বাস, এমন হাজারও “কবে”র উত্তর একমাত্র সেই দিতে পারে যা’র নাম…. মহাভারত।

Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.