বাংলা নব বর্ষের বা বঙ্গাব্দের ইতিহাস
সোন-দানা, গয়নাগাটি, অনেক জিনিসপত্রই চুরির কথা শুনেছেন কিন্তু কখনত্ত কোনো জাতি বা । সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা ইতিহাস চুরি শুনেছন? অবাক লাগলেও হ্যাঁ ঠিক এটাই ঘটেছে বাস্তবে ভারতীয় হিন্দু বাঙালিদের সাথে। সুচারু রুপে বাঙালিদের সম্পূর্ণ বঙ্গাব্দটাই চুরি করে চালানো হচ্ছে মোঘল সম্রাট আকবরের নামে। এ প্রসঙ্গে এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা ভালো যে বাংলাদেশ গঠন হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তান বাংলা ভাষার এতোটাই বিরোধী ছিল যে সেখানে তারা বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির কোনো অনুষ্ঠানই হতে দিত না এমন কি রবিন্দ্রনাথের কবিতা, গানও নিষিদ্ধ ছিল। কারন বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তারা হিন্দুদের ভাষা ও সংস্কৃতি বলে মনে করত। এর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে (বাংলা ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ) ছায়ানট নামে একটা সংগঠন রবিন্দ্রনাথের এসো হে বৈশাখ গানটা গেয়ে বাংলা বর্ষবরন উৎসব পালন করে।
আসল সত্যটা জানতে গেলে একটা সোজা অঙ্ক কষলেই সবকিছু জলের মত পরিস্কার হয়ে যাবে। এটা বাংলা ১৪২৬ সন যা শুরু হয়ে ছিল ইংরেজী ১৯১৯ সালের ১৫ই এপ্রিল। এই হিসাবে বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছিল (২০১৯-১৪২৬)=৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সম্রাট আকবর কি করে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রতিষ্ঠাতা হলেন? কারন ইতিহাস বলছে আকবরের জন্ম ১৫ই অক্টোবর ১৫৪২ সাল মৃত্যু ২৭ অক্টোবর ১৬০৫ সাল। তার মানে ৪৭৭ বছর আগে। বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসাবে (১৪২৬-৪৭৭)= ৯৪৭ বঙ্গাব্দে। তাহলে এই ৯৪৭ বছরের বর্ষপঞ্জিও কি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর কি কেউ দিতে পারবে? ব্যাপারটা চুড়ান্ত হাস্যকর নয় কি???
বাংলা বর্ষপঞ্জি নিয়ে লিখতে গেলে হিন্দু বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে কয়েকটা কথা না বললে বাংলা শকাব্দের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যাবে না। অঙ্ক এবং ইতিহাস অনুসারে বাংলা বর্ষের শুরু ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে। সে কথায় আসার আগে কয়েকটা কথার উল্লেখ না করলে বোঝা যাবে না বাংলা বর্ষপঞ্জির মূলটা কোথায়।
হিন্দু বর্ষপঞ্জিকা‡ যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫৭ বছর আগে ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন বিক্রমাদিত্য। তিনি “বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকা”র প্রবর্তন করেছিলেন। হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল এই পঞ্জিকা মেনে চলে বলে, আন্তর্জাতিক মহলে একে হিন্দু পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার বলে। যখন “বিক্রম সাম্বাত” ক্যালেন্ডারের সুচনা হয় তখন লিখিত আকারে বাংলা ভাষা ছিল না, ছিল সংস্কৃত ভাষা। তারফলে যে সময়ে বাংলা ভাষার লিখিত আকার তৈরি হয় তখনই বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনা হয় ৫৯৩ সালে। ইতিহাস অনুসারে সেই সময়টা ছিল বাংলা ও গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকাল। কিন্তু একথা মানতে হবে এটা কোনো মৌলিক আবিষ্কার ছিল না। বিক্রম সাম্বাতকেই বাংলায় লেখা হয়। মাসের নামগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বি দেশ যেমন, মায়ানমার, লাওস, কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভূটান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশও একই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এপ্রিলের মাঝামাঝি বৈশাখের ১তারিখ নববর্ষ উদযাপন করে। বৌদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে এই পঞ্জিকার জন্ম বিভিন্ন দেশে কিছুটা ভিন্ন মতভেদে খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৫৪৩-৫৪৫ বছর আগে। অর্থাৎ বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বিক্রম সাম্বাত বাংলা বর্ষপঞ্জি একই পঞ্জিকা। তাই বাংলা ক্যালেন্ডারে বৈশাখ থেকে চৈত্র এই বারো মাসের নাম অন্য ক্যালেন্ডার গুলোতেও একই দেখা যায়। শুধু তাই নয় সাপ্তাহিক বারের নামেও মিল পাওয়া যায়।
একথা তো আগেই বলেছি অঙ্কের বিচারে প্রমাণিত যে বাংলা অব্দের সূচনা হয় ৫৯৩ খ্রীষ্টব্দে। ইতিহাস অনুসারে যেটা বাংলা তথা গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের শাসনকাল এবং তিনিই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন।
মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা অব্দের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে এতোদিন ধরে যে ইতিহাস বিকৃতি চলে আসছে বাস্তবিক ক্ষেত্রে সেটা সর্বৈব মিথ্যা। এর প্রকৃত কারন হচ্ছে সম্রাট আকবরের পিতা ও পিতামহ হিজরি সাল অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতেন। হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাস ভিত্তিক হওয়ায় ৩৫৪/৩৫৫ দিনে বছর হয় ফলে একই মাস ঘুরেফিরে কয়েক বছর পর ভিন্ন ঋতুতে আসে, এরফলে কৃষকদের খাজনা দিতে অসুবিধেয় পড়তে হত। চান্দ্র মাসের বছর একেক সময় এক এক ঋতুতে শেষ হয় বলে ফসল তোলার ঠিক থাকতো না, এই অসুবিধেটা দুর করার জন্যে আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ সিরাজিকে, হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌরবর্ষ পঞ্জিকাতে রুপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। অর্থাৎ আকবর খাজনা আদায়ের সুষ্ঠতা বজায় রাখার জন্যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে ব্যবহার করেছিলেন, এটা প্রতিষ্ঠাতা নন। তাই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাংলা ক্যালেন্ডার সম্পূর্ণটাই হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ।
পয়লা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু না হয়ে সুর্যদয় থেকে থেকে শুরু নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবে সুর্যদয় থেকে বাংলা দিধ গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টা থেকে দিন গণনার নিয়ম শুরু করে।
শুভ বাংলা নব বর্ষের প্রীতি শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
নমস্কারান্তে:সুনন্দ মিত্র
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:- www.prothomalo.com and Wikipedia.