মাঘ নিশীথের কোকিল আজহারউদ্দীন ও একটি স্মরণানুষ্ঠান
অনল আবেদিন
প্রায়বিস্মৃত ইতিহাসকে অনেক সময়ই আলোর সামনে উদ্ভাসিত করার দায় বহন করতে হয় তরুণদলকেই। গত ২০১১ সালে দুর্ঘটনায় পুত্রবধূ ও নাতনি মারা যাওয়ার পর থেকে ১০ বছর ধরে কলম বন্ধ করে দেওয়া শোককাতর সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান (১৯৩০-২০২১) প্রয়াত হয়েছেন গত ২২ জুন। তাঁর জীবন ও কর্মের উপর জমে থাকা বিস্মৃতির ধুলোবালি সরিয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিকে বাঙালি পাঠকের সামনে মেলে ধরার আয়োজন করেছিলেন ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ ও তাঁর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল্লা। ওই পত্রিকার আয়োজনে গত ১ জুলাই ‘ভার্চুয়াল’ মাধ্যমে প্রায় পৌন ৩ ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আজহারউদ্দীনকে নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সাধকদের একটি অংশের মূল্যবান আলোচনা ও স্মৃতিচারণা। অধ্যাপক সা’আদুল ইসলাম মনে করিয়ে দিলেন, কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্যকৃতির বিশিষ্ট গবেষক আজহারউদ্দিন আসলে বাংলাসাহিত্যের একটি সন্ধিক্ষণের ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’। উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বিস্মৃতপ্রায় আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩)-কে আজহারউদ্দীন তাঁর লেখায় বাংলাসাহিত্যের আকাশে বসন্তের আগমনবার্তার অগ্রদূত হিসাবে ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ বলে সম্বোধন করেছেন। একই রকম সন্ধিক্ষণের লেখক বলেই সেই একই অভিধায় আজহারউদ্দীনকেও আখ্যায়িত করেন সা’আদুল ইসলাম।
সভামুখ্য, তথা প্রাক্তন সাংসদ ও বিশিষ্ট লেখক মইনুল হাসান আলোচনার শুরুতেই ‘চলমান গ্রন্থাগার’ অভিধায় ভূষিত করে আজহারউদ্দীনের জ্ঞান-পাণ্ডিত্য-বৈদগ্ধের উচ্চতাকে শ্রোতাদের সামনে মেলে ধরেন। সেই ধরতাই অক্ষুন্ন রেখেই বিশিষ্ট অধ্যাপক মীরাতুন নাহার জানিয়ে দেন, আজহারউদ্দীন যেমন ব্যক্তিজীবনে ছিলেন ব্রহ্মতেজ ও নরম মনের বৈপরীত্যের সমন্বিত সমাহার, তেমনি সাহিত্যজীবনেও কবি নজরুল ও মোহিতলাল মজুমদারের দ্বন্দ্ব-মিলনের প্রথম ব্যাখ্যাকার। বিশিষ্ট সাহিত্যিক গোপাল হালদার তাঁর জন্ম শতবর্ষে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। তখন আজহারউদ্দিনই তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে বাঙালি সারস্বত সমাজকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরানের সুবাদে আমরা জানতে পারি, কবি নজরুলের দুর্দিনে মেদিনীপুরে চ্যারিটি ফুটবল প্রতিযোগিতা করে ও অন্য ভাবে সংগ্রহ করা অর্থ নিয়ে কবিপত্নী প্রমীলার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন আজহারউদ্দীন। এই সূত্রে তিনি প্রাসঙ্গিক ভাবেই অন্য একটি প্রশ্ন তুলে আমাদের অস্থিমজ্জায় বইতে থাকা সাম্প্রদায়িকতার অবচেতন স্রোতের দিকে সঙ্গত ভাবেই অঙ্গুল তুলে ধরেছেন। ইমরান বলেন, “রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণননের নামের আগে অসাম্প্রদায়িক কথাটি বলতে হয় না। কিন্ত রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের ক্ষেত্রে বলা হয়, তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। মুসলমান হলেই কেন এমন ধারা বিচার?” তাঁর এই শ্লেষের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে খাঁটি বাঙালি আজহারউদ্দীন স্মরণচর্চায়। ১৯৪৮-১৯৫০ সাল নাগাদ নজরুলকে নিয়ে তরুণ আজহারউদ্দীনের প্রথম লেখা ‘কবিদর্শন’ প্রকাশিত হয়। আহমেদ হাসানের সুবাদেই শ্রোতারা এই তথ্য জানতে পারেন।
‘নতুন গতি’র সম্পাদক এমদাদুল হক নূরের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, “বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি মুসলমান লেখকদের কথা লিখে নাম যশ খ্যাতি হবে না জেনেও দায়িত্ববোধ থেকে আজহারউদ্দীন কলম ধরেছিলেন। সাধক মনের তাগিদ থেকে তিনি কলম ধরেছিলেন।”
কবি নজরুলকে নিয়ে ১৯৫৪ সালে ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ নামের গ্রন্থখানি লেখেন আজহারউদ্দীন। ২১২ পৃষ্ঠার ওই গবেষণা গ্রন্থ ২০১৪ সালের ১০ম সংস্করণে এসে ৮৫০ পৃষ্ঠায় পৌঁছয়। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক জাহিরুল হাসানের মত, “বাংলা ভাষার আদি উৎস চর্চাপদ থেকে এখন পর্যন্ত এমন মহাগ্রন্থের তুল্য আর কোনও নজির নেই। ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থখানি যেন বটবৃক্ষ। যত এগিয়েছে তত তার ঝুরি নেমেছে।” অর্থাৎ আলোচনার প্রয়োজনে পৃষ্ঠা সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। এমন একটি মহাগ্রন্থের গবেষককে বিভিন্ন সংস্থা বহু আগে থেকে পুরস্কৃত করলেও রাজ্য সরকারের দেওয়া নজরুল পুরস্কার পেতে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ আজহারউদ্দীনের দল সিপিএমই তার আগের ২৬ বছর ধরে রাজ্যপাটে ক্ষমতাসীন ছিল। এপার বাংলায় বাঙালি মুসলমান লেখকের সাহিত্যকৃতি যথাযথ কদর পায় না বলে এমদাদুল হক নূর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মইনুল হাসান সম্প্রতি একই ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন, ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন সংস্থা থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থে। এমদাদুল হক নূরের অভিযোগটি যে ভুঁইফোঁড় নয়, এটা তারই আরও একটি প্রমাণ।
তাঁকে তাঁর দলের দ্বারা পরিচালিত সরকারের পুরস্কৃত করতে ২৬ বছর দেরির হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন আজহারউদ্দীনের জীবনীকার অশোক পাল। তিনি বলেন, “নজরুল সম্পর্কে সিপিএমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুজাফ্ফর আহমেদের লিখিত বক্তব্যের কিছু অংশের বিরোধী ছিলেন আজহারউদ্দীন। এ কারণে তাঁকে পুরস্কৃত করতে শাসকরা দ্বিধান্বিত ছিলেন।” ‘জাগরণ’ নামে একটি পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার ‘অপরাধ’-এ ১৯৫৭ সালে একটি বছর সরকারি নির্দেশে কলকাতায় এই নজরুল গবেষকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তথ্যটি জানিয়েছেন জাহিরুল হাসান। ঘটনটি আরও একটু বিস্তারিত জানা গেলে অনেক শ্রোতার কৌতুহল মিটত। জাহিরুলের কাছ থেকেই জানা যায়, দীর্ঘ দিন মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করলেও প্রয়োজনীয় ডিগ্রি না থাকায় তাঁকে সরে যেতে হয় মহকুমা গ্রন্থাগারিকের পদে। অশোক পাল জানান, ‘বঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়’ লেখার জন্য তাঁকে বিরূপ সমালোচনা সইতে হয়েছে। আবার নাম না করে এমদাদুল হক নূরের বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে জাহিরুল হাসান তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘ইয়ারবুক’- এর পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “এই পাঠকদের ৯০ শতাংশই হিন্দু।”
তুলনাটা কি যথাযথ? গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও প্রবন্ধের মতো মৌলিক সাহিত্যকৃতির পাঠকের সঙ্গে ‘ইয়ারবুক’- এর মতো ‘সাহিত্য ক্যালেন্ডার’ গোত্রীয় রচনার পাঠক সংখ্যার তুলনা চলে কি? ‘ইয়ারবুক’ কষ্টসাধ্য সৃষ্টি হলেও? ‘অন্ধ হলে’ও প্রলয় বন্ধ থাকে’ না। জাহিরুল নিজেও তা অনেকের চেয়ে ভাল মতোই জানেন বলেই তাঁকে ‘কোঁচা দিয়ে ধুতি পরা মুসলমান’- এর প্রসঙ্গ টানতে হয়েছে আজহারউদ্দীন প্রসঙ্গে। ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ -এর মতো ‘মহাগ্রন্থ’- এর উৎসর্গপত্রে ‘দিদিমাক প্রণাম’, মীর মোশারফ হোসেনের ‘জমিদার দপর্ন’- এর উৎসর্গপত্রে ‘পরমপূজ্যপাদ মীর সাজ্জাদ হোসেন’ ও চা মহম্মদ সাগিরের ‘ইউসুফ জুলেখা’র বন্দনা অংশের ‘ওস্তাদকে প্রণাম’-এর অসাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গ টেনে জাহিরুলকে সঙ্গত কারণেই বলতে হয়েছে, “ভাষাকে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জড়ানো পাপ।” অধ্যাপক রেজাউল করিম এই প্রসঙ্গেই বলেন, “বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য দ্বিখণ্ডিত। সবটাই যেন দুটো ভাগে প্রবাহিত। একটির সঙ্গে অন্যটির যোগ নেই। সেই ১৯২৬ সাল থেকে, যখন মুক্তবুদ্ধি চর্চার মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার জন্ম হয়।” বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন তমসাচ্ছন্ন আবহেই মেদিনীপুরে আজহারউদ্দীনের জন্ম। মাত্র ২৪ বছর বয়সে নজরুল গবেষণায় তাঁর হাতেখড়ি।
‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’, ‘বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল’, ‘বাংলা সাহিত্যে কুমুদরঞ্জন মল্লিক’, ‘বাংলা সাহিত্য বিদ্যাসাগর’, ‘শরৎ বীক্ষা’, ‘দীপ্ত আলোর বন্যা’, ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’, ‘গেটে ও বাংলা সাহিত্য’, ‘বিলুপ্ত হৃদয়’ ও ‘রক্তে রাঙানো দিন’- সহ আরও নানা গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। বাঙালি পাঠক সমাজের মন থেকে মুঝে যেতে বসা আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মীর মোশারফ হোসেন, কবি শাহাদাত হোসেন, মেজাম্মেল হক, মহম্মদ শহিদুল্লাহ, মুনির চৌধুরী, কায়কোবাদ, মহম্মদ আব্দুল হাই ও এস ওয়াজেদ আলির মতো অনেক সাহিত্যসাধক রবীন্দ্র-অনুরাগী আজহারউদ্দীনের কলমে পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন। এ কারণেই তাঁকে ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ বলে সম্বোধন। অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক রেজাউল করিম, শেখ মকবুল ইসলাম, আজহারউদ্দিনের দুই ছেলে আমেরিকা প্রবাসী আরিফ খান ও মেদিনীপুরের আসিফ খান-সহ বিভিন্ন বক্তার আলোচনায় সে সব প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে। উঠে এসেছে স্পষ্টবাক এই সাহিত্যসাধকের আন্তরিক আতিথেয়তার ও সত্যবাদিতার প্রসঙ্গটিও। ফুটবল প্রেমী আজহারউদ্দীনের সাহিত্যকৃতি এপার বাংলার থেকে ওপার বাংলায় অধিক সমাদৃত। অনেকের আলোচনায় এই খেদও প্রকাশিত হয়েছে। সেই খেদ দূর করতে হলে তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যসাধকদের উদ্যোগে ‘উদার আকাশ’ আয়োজিত এমনতর প্রকৃতির আলোচনাসভার সংখ্যা বৃদ্ধি বেশ জরুরি। জরুরি বাঙালিকে বাঙালি বলে গ্রহণ করার অভ্যাস অনুশীলন করাও।