মক্কা-মদিনার পথে-প্রান্তরে : মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখবে
জহির-উল-ইসলাম
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। অর্থবান প্রতিটি মুসলমানের জন্য জীবনে অন্ততঃ একবার হজ পালন করা ফরজ বা একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, 'এবং মানুষের নিকট হজ ঘোষণা করে দাও; ওরা তোমার নিকট পদব্রজে ও সর্বপ্রকার দ্রুতগামী উটের পিঠে আসবে, আসবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করে; যাতে ওরা ওদের কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্-র নাম স্মরণ করে; ...।' (২২ : ২৭-২৮) সঙ্গতিসম্পন্ন হয়েও যারা হজ পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করে পৃথিবী পরিত্যাগ করে তাদের উদ্দেশ্য রসূলুল্লাহ্ স. কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছেন, 'আল্লাহ্-র ঘরে পৌঁছুবার জন্যে যার পাথেয় ও বাহন আছে অথচ যে হজ করে না সে ইহুদি বা খৃস্টান হয়ে প্রাণত্যাগ করল কিনা তাতে কিছু এসে যায় না।'(তিরমিজি)
সহজাত কারণেই কাবা শরীফ আর মক্কা-মদিনার প্রতি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের হৃদয়ের আকুল টান বিদ্যমান। দিবানিশি তার মন পড়ে থাকে দূর আরবের মরুময় প্রান্তরে। বাঙালির প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের অজস্র ইসলামী সংগীতের বাণীতে নবীর দেশের মাটির প্রতি তাঁর আকুল অনুরাগের কথা প্রকাশিত হয়েছে। কবি বলেছেন, "দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটীর হ'তে।" আবার কখনো বলেছেন, "সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহী মুসাফির।" কবির ইচ্ছা সেদেশে গিয়ে "আল্লাহর ঘর তওয়াফ করিয়া/কাঁদিব সেথায় পরাণ ভরিয়া।" না, অর্থাভাবে কবির সেই সদিচ্ছা পূরণ হয়নি। তাই বড় বেদনাসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেছেন, "হায় গো খোদা কেন মোরে/পাঠাইলে হায় কাঙাল ক'রে, /(আমি) যেতে নারি প্রিয় নবীর মাজার শরীফ জেয়ারতে।"
আল্লাহর আদেশ পালন আর নবীর মুহাব্বতে প্রতি বছর হজের সময় হলেই পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে যান কাবা প্রাঙ্গণে। নবীর শহর মক্কা মদিনার ধূলিকণার টানে বাংলার সবুজ জমিন থেকেও ফি বছর অগণিত পুণ্যলোভাতুর হজযাত্রী পাগলপারা হয়ে ছুটে যান আরবদেশে। আল্লাহ্ ও রসূল (স.)-এর প্রেমিক এমনই একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ মহিউদ্দিন সরকার। তিনি ২০০০ সালে পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মদিনায় হাজির হন। মুর্শিদাবাদের
খ্যাতিমান এই সন্তান রাজ্যে সরকারের পুলিশ বাহিনীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালে চাকরিতে যোগদান করে ১৯৯৮ সালে তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে বহু বিদগ্ধ মানুষের সাহচর্যে এসেছেন তিনি। ব্যাপক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জীবন তাঁর। ব্যস্ততম কর্মময় জীবনে তিনি অজস্র সাময়িক পত্র-পত্রিকায় সমাজভাবনা মূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন। অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে সামিল হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন জীবনভর। আল্লাহ্-র ঘর দর্শন আর নবীর দেশের মাটি একজন হজযাত্রীর হৃদয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনেকেই হজ থেকে ফিরে এসে কলম ধরেন। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় হজ কেন্দ্রিক অজস্র ভ্রমণ কাহিনী। আবদুল আজীজ আল্ আমানের এমনই এক কালজয়ী সৃষ্টি ‘কাবার পথে’ যা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, ভ্রমণমূলক বিশ্ব সাহিত্যে এক বিরলতম সংযোজন।
হজ ও জিয়ারত থেকে ফিরে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবি আল্ মাহমুদ লিখেছেন, ‘একটি চুম্বনের জন্য’, রফিকউল্লাহ্ লিখেছেন ‘হজ্জ্ব মহা-অভিসার’, আবদুর রাকিব লিখেছেন,’দূর আরবের স্বপন’। হজ পালনের পর মহিউদ্দিন সরকার তাঁর নিজের হৃদয়াবেগ প্রকাশ করতে বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করলেন ‘মক্কা-মদিনার পথে-প্রান্তরে’ শীর্ষক এক অতুজ্জ্বল গ্রন্থ। অবশ্য ‘তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং ইসলামী জীবন-চর্চা ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ লক্ষ্য করে তৎকালীন ‘কলম’ সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরানের একান্ত অনুরোধ এ ব্যাপারে তাঁকে উদ্দীপনা যোগায়। এই রচনাটি প্রথমে ‘কলম’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে (২০০২) কলম প্রকাশনী গ্রন্থটি প্রকাশ করে বাংলার আপামর পাঠকদের হাতে তুলে দিয়ে এক মহৎ কর্তব্য সম্পাদন করেছে।
প্রকৃতপক্ষে মহিউদ্দিন সরকারের লেখা ‘মক্কা-মদিনার পথে-প্রান্তরে’ নিছক হজ কেন্দ্রিক কোন ভ্রমণ কাহিনী নয়, আগামী দিনের হজ যাত্রীদের জন্য একটি সেরা গাইড বইও বটে। হজ সংক্রান্ত নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত জানা যাবে গ্রন্থটি পড়ে। যেমন হজ তিন প্রকার, হজের নিষিদ্ধ কাজসমূহ, আরাফাহ দিবসের দোয়া ইত্যাদি উপশিরোনামে চমকপ্রদ ভাষায় হজের নিয়মাবলী বর্ণিত হয়েছে পাতায় পাতায়। ছোট অথচ তথ্যবহুল এই বইটি পড়ে আরও জানা যায় কাবা শরীফে ঢোকার জন্য ৯৬ টি গেট রয়েছে। মক্কার অর্থ স্বল্পতা, পানির স্বল্পতার জন্য এই শহরকে মক্কা বলা হয়। পবিত্র মক্কা নগরী বাক্কা, বালাদে আমিন, মা-আদ, উম্মুল কোরা, আল্ কারইয়া ইত্যাদি একাধিক নামে পরিচিত। ২১.৫০ ডিগ্রি অক্ষাংশ আর ৪০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এইসব ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও সংযোজিত হয়েছে গ্রন্থটিতে। যেমন রসূলুল্লাহ্ স. ও হযরত আলী রা.-এর জন্মস্থান, হযরত খাদিজা রা.-এর ঘর, মসজিদুল কু’বা, মসজিদুল জুম’আ, মসজিদুল ফাতাহ্, মসজিদে বেলাল, মসজিদে শামস্, মসজিদে যুবাব, ওহুদ পাহাড়, আকিক উপত্যকা, বিরে আরীস, বিরে রুমা, মোয়াল্লাহ্ কবরস্থান ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
জড়বাদী সভ্যতার দাপটে যখন আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ হারিয়ে যাবার কারণে মানুষের মধ্যে মানবীয় গুনাবলী লুপ্ত হতে বসেছে তখন আধ্যাত্মিক সুধা ভরা সুন্দর কাগজে ঝকঝকে ছাপা-বাঁধা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণে বইটির ব্যাপক প্রচার প্রসার কামনা করি।
মক্কা-মদীনার পথে-প্রান্তরে
মহিউদ্দিন সরকার
কলম প্রকাশনী
কলকাতা-৭০০ ০১৬
মূল্য: ১২.০০