এক বাংলা নানা রূপ – এ এক অন্য দুর্গার পূজা
সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়,মেলবোর্ন
সারা বিশ্বজুড়ে দুর্গা পূজা বলতে আমরা মহিষাসুরমর্দিনীরুপী দেবী দুর্গার পূজার কথা বলে থাকি সাধারণত । কিন্তু অনেকেরই হয়ত জানা নেই যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু জায়গায় মা দুর্গাকে অন্য রূপেও পূজা করা হয়।
বাঁকুড়া জেলার, বিষ্ণুপুর মহকুমায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রামের নাম, আমরাল। বিষ্ণুপুর মূল নগর থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূর। ব্যক্তিগতভাবে, এই গ্রামটির সাথে আমার একটা নাড়ির টান আছে পূর্বপুরুষানুক্রমে । জীবনের প্রথম টানা একুশটি দুর্গাপূজা আমার কেটেছে এই গ্রামের পুজোতেই। তারপরে একটু অনিয়মিত হয়ে যায় আমার উপস্থিতি বিভিন্ন অকাট্য কারণে । তবে আজও মন পড়ে থাকে সেই গ্রামের দুর্গাপূজাতেই, ভারতবর্ষ থেকে এত দূরে বসেও।
যাইহোক, এবার দুর্গাপূজার কথায় ফিরে আসি। এই আমরাল নামক গ্রামটিতে পাশাপাশি তিনটি পাড়া রয়েছে যেখানে মা দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজা করা হয় না। পূজা হয় গৌরী বা পার্বতী রুপী দুর্গার। এই পাড়াগুলির নাম হলো নামপাড়া, বোলতলা ও উপরপাড়া। প্রায় ৭০০ বছরের উপর বয়স এই তিনটি দুর্গাপুজোর।
নামপাড়ায় পূজা হয় কুমারী দুর্গার। তিনি থাকেন অষ্টসখী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে। পাশের পাড়া বোলতলায় পূজা হয় বিবাহিত মা দুর্গার। সেখানে একই চালচিত্রে মা দুর্গার সাথে থাকেন স্বামী দেবাদিদেব শিব এবং মায়ের দুই সখী, জয়া ও বিজয়া। বোলতলার পাশের পাড়া হোলো উপরপাড়া। আর সেই পাড়াতে পূজা হয় বিবাহিত ও ঘোর সংসারী মা দুর্গার। অর্থাৎ এখানকার চালচিত্রে, শিব দুর্গার সঙ্গে থাকেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী।
পূজা পার্বতী রূপে করা হলেও, অষ্টমীর সন্ধিক্ষণের সময় কিন্তু মা দুর্গাকে কালি বা চন্ডী রূপে পূজা করা হয় এই তিনটি পূজাতেই। সেটা অবশ্য মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষনণের মন্ত্রকে একটু মন দিয়ে শুনলে/পড়লেই বোঝা সম্ভব। মন্ত্রটি খানিকটা এইরকম: “ওঁ কালী করাল বদনাং মিনিস কান্তা শিপাশিনী, বিচিত্র খট্টাঙ্গোধারা, নরমালা বিভূষণাং, দীপ চর্ম পরিধানাং, শুষ্ক মাংসাশী ভৈরবা, অতি বিস্তার বদোনাং, জিহবা ললনে ভীষনা, নিমগ্না রক্তনয়না, নাদাল পরিত দ্বির্মুখা, ওঁ হৃং সৃং চামুণ্ডাওই নমঃ”
এই তিনটি পূজাই পালিত হয় বিষ্ণুপুরের মহারাজার পূজার সময় অনুসারে। মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণের সময় এই গ্রামে, দুটি কামানের গোলা মাটির দিকে মুখ করে দাগা হয় । কথিত আছে (এবং আমি স্বয়ং এক প্রতক্ষ্যদর্শীও বটে) বোলতলার সব থেকে উঁচু তেঁতুল গাছটির উপরে একজন গ্রামবাসী বসে থাকেন যিনি তাকিয়ে থাকেন বিষ্ণুপুরের মহারাজার প্রাসাদের দিকে । সেখানে মৃন্ময়ীরুপী মায়ের পূজার নির্ঘন্ট মেনে মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণের সময় রাজা যখন কামান দাগেন, তখন সেই কামানের বিদ্যুৎদৃশ্য ও ধোঁয়া দেখে গাছে বসে থাকা এই মানুষটি চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘তোপ তোপ’ বলে। সেই চিৎকার শুনে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অপর একজনও “তোপ তোপ” করে চেঁচিয়ে ওঠেন। সেই চিৎকার ধ্বনি শুনেই, আমরালে তখন পরপর দুটি তোপ দাগা হয় । এই দুই তোপধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় মহাষ্টমীর মহা সন্ধিক্ষণের আরতি। সে এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। প্রত্যক্ষ দর্শন না করলে তা ঠিক বোঝা বা বোঝানো কঠিন।
মহালয়ার পর থেকেই, এই দুর্গাপূজা তিনটিকে ঘিরে থাকা গ্রামবাসীদের কারোরই ঘরে আমিষের প্রবেশাধিকার নেই। সম্পূর্ণ নিরামিষ মতে চলে এই পূজা । তবে মা পার্বতী কৈলাসে ফিরে গেলে (অর্থাৎ প্রতিমা বিসর্জনের পর) প্রত্যেকের বাড়িতে আমিষের আবার পুনরাগমন ঘটে, পুকুর থেকে জাল ফেলে তোলা মাছদের হাত ধরে।
দেবী দূর্গাকে ঘিরে উৎসবের ঢল সারা বিশ্বজুড়ে নামে ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু অঞ্চলে আজও দুর্গাপূজা হয় পূজার দিকে মনোযোগ বেশি দিয়ে, বাহ্যিক উৎসবের উন্মাদনাকে তেমন অগ্রাধিকার না দিয়ে। আর তাই, সেই সব পূজাগুলি আক্ষরিক অর্থে হয়ে ওঠে দুর্গা পূজা, নিছক উড়ু-উড়ু দুর্গোৎসব নয়।
লেখক পরিচিতি : সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় মেলবোর্নে বসবাসকারী এক প্রবাসী বাঙালি। ১৬ বছর দেশের বাইরে থাকলেও, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অকৃপণ প্রেম। এক আশ্চর্য সুন্দর প্রতিভাধর মানুষ, ডেনিস লিলির পেস ফাউন্ডেশনের ছাত্র, দাপিয়ে খেলেছেন ক্রিকেট শুধু কলকাতা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে সার্টিফাইড ক্রিকেট কোচ, অভিনেতা, বাচিক শিল্পী, ব্যাংক আধিকারিক , লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার ও আরও অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সাবলীল ও উৎকর্ষ বিচরণ। আমাদের চ্যানেলের বিশেষ বন্ধু । তাই পুজোয় কলম ধরলেন আইবিজি নিউজ এর জন্য দুর্গা পূজা নিয়ে এক না শোনা সত্য কাহিনী তুলে ধরতে।