আগামীতে বহু প্রতিভা আত্মপ্রকাশের অবলম্বন হবে ‘উদার আকাশ’
জহির-উল-ইসলাম
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ঘটকপুকুর থেকে প্রকাশিত পিয়ার রিভিউড রিসার্চ জার্নাল 'উদার আকাশ'-এর কুড়ি বছর পূর্তি সংখ্যাটি গত ১১ অক্টোবর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউটাউন ক্যাম্পাসে একটি সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত সেমিনারে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সংবাদপত্র জগতের একঝাঁক বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদক এবং আধুনিক ও রুচিশীল প্রকাশনা সংস্থা 'উদার আকাশ'-এর তারুণ্যদীপ্ত কর্মতৎপর কর্ণধার ফারুক আহমেদ কুড়ি বছর আগে বন্ধু-বান্ধবদের টিফিনের পয়সা সাশ্রয় করে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পত্রিকা সম্পাদনার দায়ভার কাঁধে তুলে নেন। আজও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মর্যাদার সঙ্গে পত্রিকাটি প্রকাশ করে চলেছেন তিনি। বয়সে নবীন হলেও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তাঁর সম্পাদিত উন্নত গুণমানসম্পন্ন এই পত্রিকাটি ইতিমধ্যে উভয়বঙ্গের সাহিত্য জগতের সচেতন পাঠকবর্গের সুদৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
অন্যান্য বছরের মতো এবারের কুড়ি বছর পূর্তি সংখ্যা ১৪২৮ ‘উদার আকাশ’ হাতে নিয়ে বোঝা গেল শুধু প্রকাশনা জগতেই নয়, পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও ফারুক আহমেদ তাঁর সেই রুচি ও মননশীলতার পরিচয় অক্ষুন্ন দেখছেন।
৩০৪ পৃষ্ঠা জুড়ে দুই বাংলার ১৮৫ জন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের মননশীল রচনায় সমৃদ্ধ এবারের সংখ্যাটি। যার মধ্যে প্রবন্ধ, গ্রন্থালোচনা, সাক্ষাৎকার, পাঠকের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ক লেখা আছে ৪৫ জনের, কবিতা ১০৬ জনের, ছড়া ১৩ জনের, ১৯ জন গল্পকারের ১৯ টি ছোটগল্প। এছাড়াও আছে চৈতালি বসুর ১ টি অনু উপন্যাস ও অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি অণু নাটিকা।
শুরু হয়েছে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ-এর ‘ক্ষমতার রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করছে…..’ শীর্ষক রচনা দিয়ে। কলুষিত রাজনীতির কারবারিরা যখন ক্ষমতার মোহে ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে তখন ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত এই লেখাটি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে আবার তুলে ধরে ‘উদার আকাশ’ এক মহান ও জাতীয় কর্তব্য সম্পাদন করলো।
এবছর কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্ম শতবার্ষিকী চলছে। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে সমগ্র নজরুল সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদক গিয়াসুদ্দিন দালালকৃত ‘বিদ্রোহী’-র কবিতার ইংরেজি রূপান্তর। নজরুলের কাব্য-সংগীতের গভীরে গিয়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধানের এক অনবদ্য প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় নীরব গবেষক আবুল হাসনাত-এর কলমে। ‘উদার আকাশ’-এর পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাঁর অনন্য উপহার ‘নজরুল গানে ট্রাজিক ভিশন : বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’। এই একটি নজরুল সংগীতকে নিয়ে এমন অনবদ্য বিশ্লেষণ অতীত-বর্তমানে আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। সঙ্গে এর ইংরেজি ভার্সনও। ‘শিউলিমালা’ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্প নিয়ে চমকপ্রদ আলোচনা উঠে এসেছে মোহাম্মদ শামসুল আলমের কলমে। এছাড়াও নজরুলকে নিয়ে কলম ধরেছেন সুমিতা চক্রবর্তী, আবদুস সালাম, অনিকেত মহাপাত্র। শেখ মকবুল ইসলাম সঙ্গে প্রয়াত আজহারউদ্দীন খানের ২০১২ সালে গৃহীত সাক্ষাৎকার নজরুল গবেষকদের কাছে এক মহার্ঘ সম্পদ।
পার্থ সেনগুপ্তকে স্মরণ করেছেন মীরাতুন নাহার ও সুরঞ্জন মিদ্দে। নারীর ক্ষমতায়নে বি আর আম্বেদকরের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন লিপিকা বিশ্বাস সাহা। অন্ধকার আর উপেক্ষার আবরণে মোড়া মুসলমানদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের অসামান্য অবদানের কথা উঠে এসেছে জহির-উল-ইসলামের কলমে। মুহাম্মদ মতিউল্লাহ্ কবি-ছান্দসিক-গবেষক আবদুল কাদিরকে নিয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। ইতিহাস-গবেষক আমিনুল ইসলাম উপহার দিয়েছেন বিভাগপূর্ব বাঙালি লেখিকাদের গদ্যচর্চা নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রমী এক নিবন্ধ। সোনা বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘সুবিদ আলি আর সাহানা নাটকটা দেখল না’ আমাদের চেতনালোককে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে গেল। সফিউন্নিসার ‘মায়ের মর্যাদা ও ইসলাম’ নিবন্ধে কেবল মায়ের প্রসঙ্গই নয়, পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর যুক্তিপূর্ণ মননশীল আলোচনা করেছেন– যা এক কথায় অনন্য। ব্যতিক্রমী রচনা মহিউদ্দিন সরকারের ‘আপনাকে কেন এত ভালোবাসি ইয়া-রাসূলুল্লাহ (সা.)’ আমাদের আধ্যাত্মিকতাবোধে উদ্দীপ্ত করে। বাহারউদ্দিন সম্পাদিত ‘আরম্ভ’ পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার কবিরের ইসলাম বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্যের যুক্তিপূর্ণ যথাযথ উত্তর দিয়েছেন একরামূল হক শেখ তাঁর লেখা ‘সমালোচনার আড়ালে তথ্যবিকৃতি ও ইসলাম-বিদ্বেষ’ শীর্ষক নিবন্ধে। প্রয়াত গোলাম আহমাদ মোর্তজার জীবন ও তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে বাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষদের কৌতূহলের অন্ত নেই। সেটা অনেকটাই নিবৃত হবে এ. ইসলামের ‘ইতিহাস পুনর্নির্মাণের অনন্য কারিগর’ পড়ে। জন্মশতবর্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কুমারেশ চক্রবর্তী লিখেছেন ‘সর্বাধিনায়কের প্রতি এক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকের শ্রদ্ধাঞ্জলি’।
গল্প লিখেছেন কামাল হোসেন, মোশারফ হোসেন, স্বস্তিনাথ শাস্ত্রী, সৌরভ হোসেন, ইসমাইল দরবেশ, গোলাম রাশিদ, গৌতম বিশ্বাস, সামশুল আলম, শামীম আজাদ, সোনিয়া তাসনিম খান, রোকেয়া ইসলাম প্রমুখ দুই বাংলার একঝাঁক নবীন-প্রবীন গল্পকার। কবিতা ও ছড়া লিখেছেন তাঁদের মধ্যে বিশিষ্টরা হলেন সুবোধ সরকার, নাসের হোসেন, তৈমুর খান, গোলাম রসুল, জাকির আবু জাফর, মনিরুদ্দিন খান, আনসার উল হক, কৃষ্ণলাল মাইতি, ইভা চক্রবর্তী, কবিরুল ইসলাম কঙ্ক প্রমুখ। গ্রন্থ সমালোচনার পাতায় উঠে এসেছে খাজিম আহমেদ-এর ‘পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা, মইনুল হাসান-এর ‘বাঙালি ও মুসলমান’, গোলাম রাশিদ-এর ‘দুই কাঁধের ফেরেশতা’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বই নিয়ে প্রাজ্ঞজনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে পাঠককে তৃপ্তি দেবার মতো এক অনবদ্য সংকলন এবারের ‘উদার আকাশ’ কুড়ি বছর পূর্তি সংখ্যা ১৪২৮।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এক অভিভাষণ ‘তরুণের সাধনা’য় বলেছেন, ‘সম্মুখে আমাদের পর্ব্বত-প্রমাণ বাধা, নিরাশার মরুভূমি, বিধি-নিষেধের দুস্তর পাথার; এই সব লংঘন করিয়া অতিক্রম করিয়া যাইবার দুঃসাহসিকতা যাহাদের—তাহারা তরুণ।’ ফারুক আহমেদের এরকমই দুঃসাহস আছে অনাগত দিনে সাহিত্য ক্ষেত্রে এই পশ্চাৎপদ সমাজকে কিছু দেওয়ার। আগামীতে বহু প্রতিভা আত্মপ্রকাশের অবলম্বন হবে ‘উদার আকাশ’ এ প্রত্যাশা অমূলক নয়।