ছোটোগল্প – মিউজিক থেরাপি

0
1044
Music Therapy
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:28 Minute, 59 Second

ছোটোগল্প – মিউজিক থেরাপি

হীরক মুখোপাধ্যায়

স্টাডিরুমে একরাশ বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে কিছু তথ্য খোঁজাখুঁজি করছিলেন রাজশেখর মুখার্জী, হঠাৎই মোবাইলে একটা ভিডিও কল এলো।
ফোনটা রিসিভ করার আগেই মুখুজ্যেমশাই দেখলেন ফোনটা আসছে তার অতিপ্রিয় এক ডাক্তারের কাছ থেকে। কাজের সময় অচেনা অজানা বা অনাকাঙিক্ষত কারো কাছ থেকে কোনো ফোন এলে সাধারণতঃ সেসব ফোন মোটেও রিসিভ করেন না মুখুজ্যেমশাই। এই জন্য মুখুজ্যেমশাইয়ের আড়ালে অনেকেই ওঁনাকে দেমাকি হাড়বজ্জাৎ লোক এমনকি অভব্য জানোয়ার বলে সম্বোধিত করতে মোটেও কার্পণ্য করেননা। যদিও এতে মুখুজ্যেমশাইয়ের কোনো যায় আসে বলে মনে হয়না।

কিন্তু আজকের ফোনটা এমন একটা জায়গা থেকে এসেছে যে সেই ফোনটা না ধরার মতো দুঃসাহস মুখুজ্যেমশাই অন্ততঃ দেখাতে পারলেননা। তাই ফোনটা ধরে তিনি জানতে চাইলেন, “হ্যাঁ সুনেত্রা বলো, কী মনে করে অসময়ে খোঁজাখুঁজি করছো ?”
“আরে আমি কতক্ষণ ধরে রিং করছি..এতক্ষণ কোথায় ছিলে, ফোন ধরছিলেনা কেনো, শরীর ঠিক আছে তো ?” একসাথে মেশিনগানের মতো দ্রুতগতিতে তিন তিনটে প্রশ্ন করে তবে থামল সুনেত্রা।
সুনেত্রার ফোন দেখেই মুখুজ্যেমশাই বুঝেছিলেন তাঁর কাজ এবার কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হতে চলেছে। তাই কোনোরকম ভনিতা না করেই তিনি সরাসরি বিষয়ে চলে এলেন, “সেই আদ্যিকালে পারসিক সুর আর হিন্দুস্থানী সুর যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের উপর একটা লেখা তৈরির জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করছিলাম, তাই ফোনটা ধরতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তা বলো, এই অসময়ে আমি তোমার কোন প্রয়োজনে আসতে পারি ?”
“কী আর বলবো তোমাকে, তোমার জন্যেই আমি এখন মহা সমস্যায় পড়ে গেছি, তুমি সাহায্য না করলে এখন আমার ইজ্জত একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে..। কোথাও আর মুখ দেখাতে পারবনা।”
সুনেত্রার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন মুখুজ্যেমশাই। একসময় নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে উনি বললেন, ” আমি সাহায্য না করলে তোমার ইজ্জতহানী হয়ে যাবে, এ কীরকম কথা ডার্লিং ! আমি কোনোদিন তোমার উপর কোনোরকম অকাজ বা কুকাজ করেছি বলে তো স্মরণে আসছেনা। তাহলে কেসটা কী হলো !”
“ওহ্ লোল….!” একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল ডাক্তারের গলা দিয়ে।
“যাক, একটা অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচলুম। তা এবার তোমার সমস্যাটা আগে বলো শুনি।”
“শোনো না, এক মা বাবা তাঁর বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে গতকাল আমার চেম্বারে এসেছিলেন। ছেলেটা একটা ডিসর্ডারে ভুগছে…।”
ডাক্তারের কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে এদিক থেকে মুখুজ্যেমশাই জানতে চাইলেন, “এমএস গাইনি হয়ে কবে থেকে আবার এসব ট্রিটমেন্ট শুরু করলে আগে তো সেটা আমাকে পরিস্কার করে বলো, তারপর তোমার অন্য কথা শুনবো।”
“তুমি থামবে….।” কপট বিরক্তি ঝরে পড়ল ডাক্তারের গলা দিয়ে।
“বেশ বোলতে থাকো…।”
“শোনো, ছেলেটাকে ওঁনারা কোলকাতার অনেক নামীদামি চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই কোনো সুরাহা করতে পারেননি।
শেষে ওরা পিজি-তে যায়, ওখানে যেকোনো ভাবে স্পন্দিতা-র সাথে ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। স্পন্দিতা-র কাছ থেকে আমার নম্বর নিয়ে ওঁরা আমার সাথে যোগাযোগ করে গতকাল ছেলেকে নিয়ে আমার চেম্বারে এসেছিলেন।” একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে একটু থামল সুনেত্রা।
“ছেলেটা একটা ডিসর্ডারে ভুগছে, স্পন্দিতা তোমার নম্বর ওঁদের কাছে দিলো, ওঁরা তোমার চেম্বারে এলেন। এখানে আমার এটাচমেন্টটা কোথায় যে আমাকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছ ?”এবার বেশ ঝাঁঝালো স্বরেই এবার জানতে চাইলেন মুখুজ্যেমশাই।
“এই তো আবার ভুল বুঝছো !”
ভুল বোঝার উপর বরাবরই মেয়দের পেটেন্ট রাইট আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে মুখুজ্যেমশাই জানতে চাইলেন, “ছেলেটার সমস্যাটা কী বুঝলে ?”
“সমস্যাটা আমি আবার কী বুঝবো, ওটা তো তোমার বিষয় ?”
“আমি আবার কবে থেকে তোমাদের মতো চিকিৎসক হলাম রে বাবা !” ডাক্তারের কথায় হতভম্ব হয়ে এ প্রান্ত থেকে স্বগতোক্তি করলেন মুখুজ্যেমশাই।
মুখুজ্যেমশাইয়ের কথাকে কোনোরকম ধর্তব্যের মধ্যে না এনে ওপাশ থেকে ডাক্তার বলে চলল, “ওসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে শোনো…., ছেলেটার বাবা মা বলছিলেন, ছেলেটা যদি একসাথে সাতটা শব্দ করে তার মধ্যে দুটো শব্দ হয়তো মিনমিন করে বলল তারপর হয়তো একটা দুটো স্বাভাবিক বলল, আবার একটা হয়তো খুব চেঁচামেচি করে বলল, তারপরেরটা হয়তো আবার আস্তে বলল এভাবে কথা বলে। ওঁনারা কিছুতেই ছেলেকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারছেননা।
ওঁরা স্পন্দিতার কাছ থেকে শুনেছে, তুমি নাকি এই সমস্যাগুলো খুব ভালো ভাবে সামলাতে পারো, তাই ওঁরা তোমার সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ানোর জন্যই আমার কাছে এসেছিলেন।”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু স্পন্দিতা আমার নামে এ আবার কী রটাতে শুরু করল, আমি আবার কবে থেকে তোমাদের মতো গলায় স্টেথো ঝোলানো ডাক্তার হলুম..! পাই একবার ওকে হাতের কাছে।”
“আমি গতকালই ওঁদের বলে দিয়েছিলাম, আগামীকাল সকালে ডঃ মুখার্জী-র সাথে আপনাদের কনফারেন্স কলের মাধ্যমে কথা বলিয়ে দেবো।
শোনো না, এই কলটা ডিসকানেক্ট করে, আমি ওঁদের কনফারেন্সে নিয়ে তোমাকে আবার কানেক্ট করছি। লাইনটা ধরে তুমি ডিটেল্সটা একটু শুনে নাওনা। বাদবাকি কিছু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা..।”

(২)
“হ্যালো স্যার, সুনেত্রা বলছি..।”
“বলো।”
“স্যার আপনাকে যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম, তার অভিভাবকরা লাইনে আছেন। ওঁরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান..।”
সুনেত্রার কথা বলার ধরণ শুনে মুখে হাসি এসে গেলো মুখুজ্যেমশাইয়ের। যে মেয়ে কোনোদিন হ্যাঁগো, শোনোনা ছাড়া কথা বলেনি, সে যে কীভাবে স্যার স্যার বলছে ভাবতে ভাবতেই পেটের নাড়ি ছেঁড়ার উপক্রম হলো মুখুজ্যেমশাইয়ের। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে সিনিয়রের মতো বললেন, “ঠিক আছে ওঁনাদের কথা বলতে বলো।”
“নমস্কার, আমরা কী ডঃ মুখার্জী-র সাথে কথা বলছি ?”
“বলছেন।”
“স্যার, গতকাল আমরা ম্যাডামকে সব বলে এসেছিলাম, তাই পুরো বিষয়টা আর বলছিনা..।”
“আপনার ছেলের রোগের রূপরেখাটা আমার চোখের সামনে মোটামুটি পরিস্কার হয়েছে, কিন্তু মুশকিল হলো, আপনারা পুরো বিষয়টা আবার না বললে রোগটা ঠিকঠাক ধরা যাবেনা। তাই অনুরোধ করব, কষ্ট করে আর একবার রোগের উপসর্গগুলো বলুন।”
“স্যার, গতকালই আমরা ম্যাডাম-কে সব বলে এসেছিলাম, আমাদের ছেলে যদি একসাথে সাতটা কথা বলে সেক্ষেত্রে কোনোটাই সমানভাবে বলতে পারছেনা। কোনটা হয়তো খুব জোরে বলছে, কোনটা স্বাভাবিক আবার কোনোটা হয়তো স্বাভাবিকের থেকে আস্তে আস্তে বলছে যাকে আপনি মিনমিন স্বরের কথাও বলতে পারেন।”
“সে ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে একটু ভেবে বলুন ওই সাতটা স্বর বা শব্দের মধ্যে কোন কোন স্বর বা শব্দগুলো আপনার ছেলে জোরে বা আসতে বলছে।”
“এই ধরুন…।”
“কোনো ধরাধরির বিষয় নেই, এটা যেহেতু বিজ্ঞানের এক শাখা, তাই আপনারা যা বলবেন তা পুরোপুরি প্রামাণ্য হতে হবে। আপনারা সঠিক তথ্য দিলেই আপনার ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। নচেৎ ভবিষ্যতে ওকে নিয়ে আপনাদের অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হবে।” রোগীর বাড়ির লোকেদের বোধোদয়ের জন্যে বেশ কড়া ভাবেই কথাগুলো বললেন মুখুজ্যেমশাই।
“দেখুন আমরা তো সেভাবে কোনোদিন খাতা কলমে এগুলো লিখে রাখিনি, তাই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আমরা তো বলতে পারবনা ডক্টর..।” ওদিক থেকে বেশ হতাশ ভাবে বললেন রোগীর বাবা।
“ওয়েল, ইন দিস সিচ্যুয়েশন আই ক্যান এসিস্ট ইউ।
ধরুন আপনার ছেলে মুখ দিয়ে পরপর সাতটা শব্দ বা সিঙ্গেল সাউণ্ড বা আওয়াজ করছে। আপনার ছেলেকে না দেখেই আমি বলে দিচ্ছি ও প্রথম শব্দ বা আওয়াজটা ওর স্বাভাবিক স্বরেই করছে।
তার পরের দুটো শব্দ বা আওয়াজ ও হয়তো ওর স্বাভাবিক স্বরের থেকেও আস্তে বলছে।
এখন আপনাদের যেটা ভালো করে দেখে আমাকে জানাতে হবে, সেটা হলো চতুর্থ শব্দটা কী ও ওর স্বাভাবিক স্বরে বলছে না জোরে বলছে ?
আমার ধারণা সব কিছু ঠিক থাকলে আপনার ছেলে পঞ্চম শব্দটা ওর স্বাভাবিক স্বরেই বলছে এবং ষষ্ঠ স্বরটা আবার ওর স্বাভাবিক স্বরের থেকে বেশ কিছুটা আস্তে বলছে।
যা বলছি এগুলো যদি সব ঠিকঠাক হয়ে থাকে তাহলে ওর শেষ শব্দটা ও নিশ্চয়ই আবার স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের থেকে আস্তে বলছে।

আর যদি দেখেন শেষের দুটো শব্দই ওর স্বাভাবিক স্বরের থেকে আস্তে উচ্চারণ করছে কিন্তু চতুর্থ স্বরটা জোরে না বলে স্বাভাবিকভাবেই বলছে তাহলেও বলবেন।
মাথায় রাখবেন দুটো রোগের ভেতর অনেকটা মিল থাকলেও মূল অমিলের স্থান ওই চতুর্থ এবং সপ্তম স্বরের বা শব্দের ক্ষেত্রটা।
তাই দেরি না করে ওকে ডেকে ওর সাথে কিছু সময় কথা বলে দেখুন। নইলে আমি তো আছি..।”

মুখুজ্যেমশাইয়ের আদেশ মেনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওই প্রান্তে ছেলের বাবা মা ছেলের সাথে অনেক ভাবে কথা বলে কিছু বুঝতে না পারলেও ফোনের এ প্রান্ত থেকে মুখুজ্যেমশাই ভালো ভাবেই বুঝতে পারছিলেন সমস্যাটা কোথায় হয়েছে।
মুখুজ্যেমশাইকে আবার নিজের কাজে মন দিতে হবে তাই এদিক থেকে মুখুজ্যেমশাই সরব হলেন, “এনিবডি হিয়ার মি ?”
“ইয়া আ’য়াম হিয়ারিং ইউ স্যার,” ওদিক থেকে ভেসে এলো ডাঃ সুনেত্রার গলা।
“ওঁনাদের কী হলো, এক ছেলের পেছনে বাবা মা দুজনেই ছুটে বেড়াচ্ছেন, আরে বাবা ওঁদের একজন তো কলটা এটেন্ড করতে পারেন..।” বিরক্তি ঝরে পড়ল মুখুজ্যেমশাইয়ের গলা দিয়ে।
“স্যার, স্যার উই আর এক্সট্রিমলি সরি স্যার। আসলে কোনোদিন তো এভাবে শব্দগুলো আলাদা আলাদা ভাবে শুনিনি, তাই একটু সমস্যা হচ্ছিল। তবে ভালো করে শুনে মনে হলো আপনি যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। আপনি ধন্য স্যার, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো সেটাই বুঝতে পারছিনা আমরা।”
“ওসব বাজে কথা রেখে আগে বলুন ও কী কোনো শিক্ষকের কাছে এখন গানের তালিম নিচ্ছে ?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি ওকে না দেখে ওর সাথে কোনোরকম কথা না বলে সবকিছু এভাবে ঠিকঠাক কীভাবে বলছেন স্যার। আপনি সত্যিই অন্তর্যামি স্যার..।”
“ওসব কথা পরে বললেও হবে, আগে বলুন ওর চতুর্থ স্বরটা কী রকম লাগলো, আর শেষ দুটো স্বরই বা কীরকম লাগলো ?”
“স্যার আপনার কথা মতো অনেকক্ষণ ওর সাথে কথা বলে বুঝলাম ওর কথার মধ্যে চতুর্থ কথাটা ও বেশ জোরে বলছে আর সপ্তম বা শেষ কথাটা আবার স্বাভাবিক ভাবেই বলছে। বাদবাকি আপনি যেমন যেমন বলেছেন ও তেমন ভাবেই কথা বলছে।”
“কাঁচকলা বুঝেছেন, ওসব বোঝার ক্ষমতা থাকলে আপনি যেগুলোকে কথা বলছেন সেগুলোকে কথা না বলে স্বর বা শব্দ বলতেন।
যাইহোক, এখন আপনি লাইনটা ছাড়ুন। ডঃ সুনেত্রাকে আমার কিছু ইন্সট্রাকশন দেওয়ার আছে। আজ বিকেলে বা আগামীকাল ওর সাথে যোগাযোগ করে ওর কাছ থেকে আপনার ছেলের ব্যবস্থাপত্রটা সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে স্যার।
ম্যাডাম আপনি লাইনে আছেন তো ?”
“হ্যাঁ আছি, বলুন।”
“আমরা তাহলে পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি। এখন রাখি তাহলে…।”
ওদিক থেকে ডাক্তার সুনেত্রার গলা শোনা গেলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ রাখুন।”

কনফারেন্স থেকে সেকেণ্ড লাইন ডিসকানেক্ট হতেই সুনেত্রার গলা শোনা গেলো, “অ্যাই শোনোনা, ছেলেটার গলায় কী কোনো মেজর প্রবলেম হয়েছে ? তুমি এসব জানতে চাইবে সেকথা আমাকে আগে বললে আমি তো আগেই ওর ভোকাল কর্ডের পরীক্ষাটা করিয়ে নিতাম। কিন্তু, গতকাল ওর সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেও আমি তো ওর গলার স্বরে কোনো অস্বাভাবিকতাই টের পাইনি গো ! তুমি সমস্যাটা ধরলে কীভাবে ?”
“হুঁ, টের না পাওয়ারই কথা।”
“এতো দেমাক কিন্তু মোটেও ভালো নয়। লোকে সাধ করে তোমাকে হাড়বজ্জাৎ, অভব্য জানোয়ার বলে না বুঝেছো।” এবার বেশ রাগত স্বরেই ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠলো ডাক্তার সুনেত্রা।
“যা বাব্বা, এখানে আবার আমার দেমাক কোথায় দেখলে !”
“ধুর ছাতা, রোগটা কী হয়েছে আগে সেটা তো বলো। আমার অন্য নম্বরটায় স্পন্দিতা সমানে ফোন করছে ওকে বলতে হবে তো..।”
“কী আর বলবে, ডার্লিংকে বলে দাও রোগটা সনাক্ত করা গেছে। এখন ওষুধ পেলেই রোগটা সেরে যাবে।”
“দ্যাখো, তোমার ফাজলামি বন্ধ করবে না ফোন ডিসকানেক্ট করে এখনই তোমার স্টাডিরুমে হামলা চালাবো..।”
“খবরদার, ওই কম্মটা এখন ভুলেও করবেনা। আমাকে এখন অনেকক্ষণ স্টাডিরুমে কাটাতে হবে। তোমার জন্য এখন আমি আর একটুও সময় বার করতে পারবনা।”
“বেশ, তাহলে ঝটপট করে রোগ, রোগ সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া আর চিকিৎসা পদ্ধতিটা আগে বলে দাও।” অনুরোধ ঝরে পড়ল সুনেত্রার গলা দিয়ে।
“তাহলে মন দিয়ে শোনো, তুমি নিশ্চয়ই জানো সনাতন ভারতীয় শাস্ত্র অনুযায়ী সপ্তস্বর মানে সা রে গা মা পা ধা নি আর আরোগ্য শাস্ত্র দুটোরই প্রণেতা শিব।
এই স্বরশাস্ত্র অনুযায়ী তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঠাট, আর দশটা পৃথক পৃথক ঠাট থেকে তৈরি হয়েছে অজস্র রাগ রাগিণী। এই রাগ রাগিণী-কে নিয়েই আবার সৃষ্টি হয়েছে আজকের এত ধ্রুপদী আর লঘু সঙ্গীত।
সনাতন স্বরশাস্ত্র ও বর্তমান স্বরবিজ্ঞান দুটোই একযোগে স্বীকার করে নিয়েছে পৃথিবীতে এমন কোনো শব্দ নেই যা স্বরশাস্ত্রর আওতাধীন নয়। বর্তমান স্বরবিজ্ঞান গলার স্বরথলির কম্পাঙ্কের মাত্রা অনুযায়ী ভারতীয় সনাতন সপ্তস্বর-কে বর্ধিত করে দ্বাদশ ধ্বনি পর্যন্ত নিয়ে গেছে।”
“কিন্তু, সঙ্গীত শাস্ত্র-র কথা শুনে আমি কী করব !” বিরক্তি ঝরে পড়ল ডাক্তার সুনেত্রার গলা দিয়ে।
“ডার্লিং এটা মিউজিক থেরাপি। তুমি যেমন মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করো, কখনো অন্য ডাক্তার ভুল মেডিসিন প্রেসক্রাইব করলে তুমি যেমন সেটা রেক্টিফাই করে পারফেক্ট মেডিসিন এপ্লাই করো। এখানেও সেইরকম। তবে আমরা মেডিসিন-এর পরিবর্তে পারফেক্ট টিউন-কে এপ্লাই করি। তোমার ভেতরে বিজ্ঞানের যথাযথ জ্ঞানের ঝলক না থাকলে আজ বা আগামীকাল তুমি তোমার পেশেন্ট পার্টীকে কনভিন্স করবে কীভাবে ! সেইজন্যই আমাকে বকে মরতে হচ্ছে ..।”
“বুঝতে পেরেছি, আজ তুমি আমার মাথা খাবে। খাও আর কতভাবে খেতে চাও খেয়ে নাও..।” বিড়বিড় করে বললো ডাক্তার সুনেত্রা।
“হ্যাঁ মন দিয়ে শোনো, ভারতীয় সপ্তস্বর-কে পাশ্চাত্যের স্বরবিজ্ঞানীরা সি ডি ই এফ জি এ এবং বি স্বর বলে চিহ্নিত করেই থেমে থাকেননি গলার স্বরথলির কম্পাঙ্কের উপর ভিত্তি করে তাঁরা সা এবং রে-র মাঝে কোমল রে বা ঋ বলে যে স্বরটা আছে সেটাকে সি শার্প, রে এবং গা-র মাঝে কোমল গ বা জ্ঞ বলে যে স্বরটা আছে তাকে ডি শার্প, মা এবং পা-এর মাঝে কড়ি ম বা ক্ষ বলে যে স্বরটা আছে তাকে এফ শার্প, প ও ধ-এর মাঝে কোমল ধ বা দ বলে যে স্বরটা আছে তাকে জি শার্প, ধ এবং ন-এর মাঝে কোমল ন বা ণ বলে যে স্বরটা আছে তাকে এ শার্প বলে চিহ্নিত করেছেন।
এর ফলে আধুনিক স্বরচিকিৎসকগণ এই দ্বাদশ ধ্বনিকে ক্রমান্বয়ে সি, সি শার্প, ডি, ডি শার্প, ই, এফ, এফ শার্প, জি, জি শার্প, এ, এ শার্প ও বি বলে চিনে থাকেন।

তোমার পেশেন্ট পার্টীর সাথে কথা বলে বোঝা গেলো ছেলেটা যখন ওর গলা দিয়ে কোনো স্বর প্রক্ষেপ করছে তখন ওর প্রথম স্বরটা স্বাভাবিক থাকছে। এটাকে সা বা নর্মাল সি হিসাবে ধরলে ওর পরের দুটো স্বর ঋ এবং জ্ঞ যথাক্রমে সি শার্প ও ডি শার্প-এর উপর থাকছে, আবার ওর চতুর্থ আওয়াজটা বেশ কিছুটা তীব্র হয়ে কড়ি ম বা ক্ষ কিংবা এফ শার্প-এর মতো শোনাচ্ছে। পঞ্চম স্বর বা প-কে ছেলেটা স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারণ করলেও ষষ্ঠ স্বর রূপে ও আবার শুদ্ধ ধ-এর জায়গায় কোমল ধ বা জি শার্প-এর উপর থাকছে, যদিও শেষ স্বর বা শুদ্ধ ন কে ও শুদ্ধ ভাবেই উচ্চারণ করছে অর্থাৎ বি তেই রাখছে।
ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী সঙ্গীত চর্চার আলোকে এই বিষয়টা ভাবলে বোঝা যায়, ছেলেটা সবসময় ওর গলায় টোডী বা তোড়ী ঠাট আউরে চলেছে।”

“কিন্তু তুমি মাঝখানে বলছিলেনা, দুটো রোগের উপসর্গ অনেকটা এক। ঠিক করে বলুন; নইলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে। ওখানে তুমি অন্য কোন বিষয়ে ভাবছিলে ?”
সঙ্গীত শাস্ত্রের এহেন নীরস তাত্ত্বিক আলোচনার উপর হঠাৎ করে ডাক্তার সুনেত্রা-র আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন মুখুজ্যেমশাই।
নিজেকে কোনো রকমে সামলে তিনি আবার বলা শুরু করলেন, “ভারতীয় ঠাটের নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র ভৈরবী ঠাট এবং টোডী বা তোড়ী ঠাটের ক্ষেত্রে একসাথে চারটে করে স্বরবিকৃতি লক্ষ্য করা যায় ।
ভৈরবী ঠাটটা সা ঋ জ্ঞ ম প দ ণ এই সপ্ত স্বরের উপর দিয়ে চলে। একটু নজর করলেই বুঝতে পারবে, প্রথম স্বরটা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক থাকলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্বর দুটো কোমল; আবার চতুর্থ ও পঞ্চম স্বর দুটো স্বাভাবিক থাকলেও শেষ দুটো স্বর আবার কোমল।
উল্টো দিকে ঠাট তোড়ী চলে সা ঋ জ্ঞ ক্ষ প দ ন স্বরের উপর দিয়ে। এইক্ষেত্রে প্রথম স্বরটা স্বাভাবিক, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্বরটা ভৈরবী ঠাটের মতো কোমল হলেও চতুর্থ স্বর রূপে এখানে দেখা যায় কড়ি ম বা ক্ষ-র প্রয়োগ। আবার পঞ্চম ও সপ্তম স্বর শুদ্ধ থাকলেও মাঝের ষষ্ঠ স্বরকে এখানে কোমল রূপে দেখা যায়।
তাই বারবার করে আমি জানতে চাইছিলাম চতুর্থ স্বর আর শেষ দুটো স্বর ছেলেটা কীভাবে উচ্চারণ করছে বলুন।
ছেলেটা যখন ওর বাবা মার সাথে কথা বলছিল, ওর কথা বলার ধরণ শুনে আমার মনে হচ্ছিল ও ভেতর ভেতর টোডী ঠাটটা গুনগুনিয়ে চলেছে।
ছেলেটার অভিভাবকরা তোমার কাছে এলে তুমি ওঁদের আশ্বস্ত করে বলবে, ‘ভয়ের তেমন কিছু কারণ নেই, সব ঠিকঠাক আছে, শুধু যে সঙ্গীত শিক্ষকের মাধ্যমে ওঁনারা ছেলের সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, তাঁর মতো আনাড়ী সঙ্গীত শিক্ষকের হাত থেকে অবিলম্বে ছেলেকে সরিয়ে আনতে হবে ,অন্যথায় সেই সঙ্গীত শিক্ষককে বলতে হবে তিনি যেন অবিলম্বে ঠাট টোডী শেখানো বন্ধ করে আগে বিলাবল ঠাট শেখাতে শুরু করেন।’
ওঁদের বুঝিয়ে বলবে বিলাবল হচ্ছে একমাত্র সেই ঠাট যেখানে সাতটাই বিশুদ্ধ স্বর পরপর প্রয়োগ হয়। তাই ছেলের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে হলে ওঁনারা যেন অবিলম্বে বিলাবল ঠাট শেখানোর ব্যবস্থা করেন। একমাত্র এই ঠাটই ছেলেটার স্বরশুদ্ধি ঘটাতে পারবে। অন্যথায় সমস্যা বেড়েই চলবে।” একসঙ্গে অনেকটা কথা বলে থামলেন মুখুজ্যেমশাই।
“ইন দিস কেস ওনলি বিলাবল ইজ দ্য আলটিমেট ট্রিটমেন্ট অব মিউজিক থেরাপি, আর ইউ সিওর এবাউট ইট ?”
“ইয়া হাণ্ড্রেড পার্শেন্ট।”
“যদি এটা না ধরে,…” কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় ডাক্তার সুনেত্রা।
“ইন দ্যাট কেস ছেলেটাকে তোমার চেম্বারে ডেকে ওর কানের গোড়ায় ঠাঁটিয়ে একটা চড় কষিও তাহলে পুরো ঠিক হয়ে যাবে।”
মুখুজ্যেমশাইয়ের কথা কানে যেতেই ওপ্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে ডাক্তার সুনেত্রা বলে উঠল, “কথার মাঝে খেলার ছলে চটপট রোগ ধরে ফেলার পদ্ধতির জন্যই তোমাকে আমি…,”
ডাক্তার সুনেত্রাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে মুখুজ্যেমশাই গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন, “যে কথা মন থেকে বলোনা, ওসব কথা মুখে নয় নাই বললে। অনেক হয়েছে ফোন রাখো এবারে।”
এপ্রান্ত থেকে মুখুজ্যেমশাই-এর কথাটা কানে যেতেই ঘা খাওয়া ক্রুদ্ধ নাগিনীর মতো মাথা উঁচু করে ওপ্রান্ত থেকে ডাক্তার সুনেত্রা বলে উঠলো, “খালি নিজের কাজ আর হিজিবিজি মাথামুণ্ডুহীন লেখালিখি, দিনদিন একেবারে যাতা হয়ে যাচ্ছ তুমি। এই জন্যই এখন তোমাকে আগের মতো আর ফোন করিনা আমি। কথা দিলাম, মরে গেলেও কোনোদিন আর তোমাকে আমি যেচে ফোন করবোনা দেখো নিয়ো।”
ডাক্তারের কথাগুলো শুনতে শুনতে মুখুজ্যেমশাই কোনোরকমে বললেন, “ইটস টোটালি এবসার্ড, কখনোই হতেই পারেনা।”
“কী হতে পারে না, আমি যখন বলেছি ফোন করবনা তো করবইনা। মিলিয়ে নিও।”
“আরে বাবা ! সেইসব মিলিয়েই তো বললাম, ইটস রিয়েলি এবসার্ড, এভাবে হয়না।”
“লাইনে এসো।”
“হুঁ আমাকে লাইনে আনতে হবেনা। তুমি নিজে শুনে নাও ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্র অনুযায়ী এমন কোনো ঠাট নেই যেখানে সাতটাই অবিশুদ্ধ স্বর একসাথে চলে।”
“আরে বাবা আমি বলছি, তোমাকে আমি আর কক্খোনো ফোন করবনা, এখানে সাতটা অবিশুদ্ধ স্বর এলো কোথা থেকে যে বলছো ইটস টোটালি এবসার্ড ?”
“এসব গূঢ় তত্ত্ব ঠিকভাবে বুঝতে গেলে আগে তোমাকে ভালো করে সঙ্গীত চর্চা করতে হবে ডার্লিং।
পারলে ফোনটা ডিসকানেক্ট করে এখনই তোমার বাপির কানের পাশে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে বিলাবল, ভৈরবী আর তোড়ী ঠাট তিনটে ভালো করে গলায় তুলে নাও তো।
রেওয়াজটা ঠিক হচ্ছে কিনা পরে আমি কোনো একসময় শুনে আসব। এখনকার মতো আমাকে ক্ষমা করো ম্যাডাম।” বলতে বলতে কলটা ডিসকানেক্ট করলেন মুখুজ্যেমশাই।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here