মহা-মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী
“বেদান্ত নামঃ উপনিষদ প্রমাণম্”, মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক্ ও উপনিষদ এই নিয়ে পৃথিবীর আদি অধ্যাত্ম- সাহিত্য বেদ। এরই জ্ঞান-কান্ড এর নাম ‘উপনিষদ’ বা ‘বেদান্ত’। নাম এর অর্থে ই এর উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে…
” যে মহৎ বিদ্যা আচার্যের নিকটে বসেই শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতে হয় ”।
বেদ এর নিত্য ‘অগ্নিহোত্র’ এখানে এসে নিরন্তর তপস্যার রূপ পেল; কর্মকান্ড হোল জ্ঞান-নির্ভর। যজ্ঞ বদলে গেল তপস্যা তে। এখানে, বুদ্ধদেব এর ” দুঃখম্ দুঃখম্ সর্বম্ দুঃখম্ ” এই ধারণা যেমন খাটে না, ঠিক তেমনি, চৈতন্যদেব এর “জীব কৃষ্ণ-দাস এ বিশ্বাস” রাখার ও কোনো স্থান নেই। এখানে ” জীব ব্রহ্মৈব না পরঃ “….. জীব ই স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। প্রখ্যাত দার্শনিক ও জার্মান চিন্তাবিদ, ড. ইম্যানুয়েল কান্ট ও ঠিক এটাই মনে করতেনঃ ” Two things always filled me with wonder….the story heaven above and the human soul within.”
ভাবতে অবাক লাগলেও সত্য এটাই, কয়েক শ’ বছর আগে মোঘল সম্রাট, ঔরঙ্গজেব এর আপন ভাই দারাসিকোহ্ সংস্কৃতে লিখা উপনিষদ এর পার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম এর ভ্রাতৃত্ব-বোধ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। সেই পার্সি অনুবাদ থেকে ফরাসী ভাষা তে অনুবাদ করেন এনকোয়েটিল ডু পারসন। পরে, ঐ ফরাসী অনুবাদ কে জার্মানে ভাষান্তরিত করে এবং মূল সংস্কৃত ভাষার উপনিষদ সংগ্রহ করে রীতি মতো পড়াশোনা করেন বিশ্ব- বরেণ্য জার্মান চিন্তাবিদ সোপেন হাওয়ার্ড। গভীর নিষ্ঠা সহ পড়ে তিনি জানিয়েছেন তাঁর অনুভব, ঠিক এই ভাষাতেঃ ” In the whole world there is no study so beneficial and so elevating as that of the Upanisadas. It has been the solace of my life, it will be the solace of my death.”
বিশ্ব-বিখ্যাত এই সব গুনীজনদের পঠনে-পাঠনে এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে উপনিষদ এর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।তপস্যা কে উপেক্ষা করে, সংস্কৃত সাহিত্যের জ্ঞান থাকলেই তো আর উপনিষদ লিখা যায় না ! ‘গর্ভ উপনিষদ’, ‘গোপাল তাপনীয় উপনিষদ’, ‘কলি সন্তরণ উপনিষদ’, ‘হংস উপনিষদ’ সহ বহু খ্যাত- অখ্যাত লোকের দ্বারা লিখিত শতাধিক উপনিষদ এ বর্তমান বাজার গমগম্ করলেও সাকুল্যে ১০ টি কেই “বৈদিক-উপনিষদ্” এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোন্ কোন্ সেই দশটি?
“ঈশ-কেন-কঠ-প্রশ্ন-মুণ্ড-মাণ্ডুক্য-তিত্তিরিঃ।
ঐতরেয়ং চ ছান্দোগ্যং বৃহদারণ্যকং দশ।। “
উপনিষদ এর আলোচ্য কী বেদ-জাত ৪টি ‘মহা-বাক্য’ থেকেই তা সহজে অনুমান করা যায়।
বেদ | উপনিষদ | মহা-বাক্য |
ঋক্ বেদ | ঐতেরীয় | “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম”। |
সাম বেদ | চ্ছান্দোগ্য | “তৎ ত্বম্ অসি”। |
যজুঃ বেদ | বৃহদারণ্যক্ | “অহং ব্রহ্মাস্মি”। |
অথর্ব বেদ | মাণ্ডূক্য | “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম “। |
তৈতিরীয় উপনিষদ এর ব্রহ্মানন্দ বল্লী’র ২য় থেকে ৫ম অনুবাক্ থেকে জানা যায় জীবমাত্র ই অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ এর আবরনে আবৃত অনন্তের ক্ষুদ্র এক শাশ্বতঃ সত্ত্বা। কিন্তু, তাইই যদি হয় তবে পেঁয়াজ এর খোলা ছাড়ানোর মতো সেও তো একসময় শূণ্য ই হয়ে যায়। তাহলে আত্মা ( যা আসলেই ‘আমি’….the Supreme Consciousness )র অস্তিত্ব কোথায় ? জায়গা খুঁজতে, চলুন প্রখ্যাত সেই “Ten-Men-story” শুনি। নদী পারাপার হয়ে, ১০ জন বন্ধু নিজেদের গুনতে শুরু করলো….
” এক, দুই, তিন…… নয় হোল”।তাহলে তো একজন ভেসে গেছে! অন্য বন্ধু অবাক হয়ে, আবারও গুনতে শুরু করলো….এই, এক…. দুই ..তিন..চার…হ্যাঁ, ঠিক ৯ই তো ! আশ্চর্য্য, আর একজন গেল কোথায়? এমন সময়ে, বাইরে থেকে অন্য একজন এসে গুনে দেখিয়ে দিলেন, সবাই আছে। ১০ জন ই আছে। প্রত্যেকেই নিজেকে বাদ দিয়ে গুনছিল, তাই! ঠিক এই ভুল টাই করে যাচ্ছি আমরা প্রতিটি মুহূর্তে।
“ষষ্ঠ অনুবাক্ থেকেও এই সত্যটিই জানা যাচ্ছেঃ
” অসন্নেব স ভবতি। অসদ্ ব্রহ্মেতি বেদ চেৎ। অস্তি ব্রহ্মেতি চেদ্বেদ। সন্তমেনং ততো বিদুঃ।”
ব্রহ্মকে অস্তিত্বহীন ভাবার কোনো কারণ নেই। জ্ঞানময় আনন্দের মাঝেই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা। আনন্দ ই স্বয়ং ব্রহ্ম। তাই, আনন্দ কেই জীবনে আমাদের খুঁজে পেতে হবে।
কিন্তু, তা কী ভাবে?
কঠোপনিষদ্ এ এসে দেখা যাচ্ছে পুত্র, নচিকেতা পিতাকে তাঁর যজ্ঞের ত্রুটি থেকে মুক্ত করে, ‘অগ্নিবিদ্যা’ লাভ করেও ক্ষান্ত হোল না। ‘প্রেয়’ কে ছেড়ে সে ‘শ্রেয়’ কেই আঁকড়ে থাকলো। তখন যমরাজ বাধ্য হলেন ঐ এক রত্তি বালকের সাথে আত্মতত্ব বিষয়ে আলোচনা করতে। যম বালক কে বলেছিলেন,
“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়াদুর্গংপথস্তংকবয়ে বদন্তি ॥৬৭ “
নচিকেতা ! তোমাকে মোহনিদ্রা ত্যাগ করে, সজাগ হয়ে উঠে তত্ববেত্তা আচার্য্য থেকে আত্মজ্ঞান লাভ না করা পর্যন্ত থামলে চলবে না। যদিও, ক্রান্তদর্শী (কবি) রা বলেন, তমসাচ্ছন্ন এই পথ দূর্গম ও ক্ষুরধার, তবুও।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ এর ঋষি ডাক দিয়ে বলছেন…..
হে অমৃতস্য পুত্রাঃ ! “বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। ত্বমেব বিদিত্বাহ্তি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ্য়নায়।”
কবিগুরু, এরই অনুসরণে, সহজ-সরল বাংলা ভাষায় শোনালেন সেই একই অমৃতত্বের মন্ত্রঃ
” শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগন
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহাকে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁকে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুকে লঙ্ঘিতে আর অন্য পথ নাহি।”
উপনিষদ এর আশ্রয়ে আত্ম-তত্ব লাভ করে তাঁকে
জানলেই ” আত্যন্তিক দুঃখ নিবৃত্তির সাথে পরমানন্দ প্রাপ্তি ” পাওয়া সম্ভব। জীবের যে আর অন্য পথ নাই !

Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown light on many fronts.