ভালোবাসায় কী না হয়
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী।
গীতিকার ঠিকই বলেছেন, ” ভালো বাসা অ…নে…ক পেলাম, ভালোবাসা পেলাম না !” সত্যিই আজকের রকেট এর বেগে তাল রাখতে গিয়ে ভক্তি-ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম-অনুভূতির আবেগ গুলো, কিছুটা হলেও, যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। নাকি, আমরা, মধ্য-বয়স্করা, কঠিন এই বাস্তবতাকে ঠিক বাস্তব ভাবে নিজেরাই নিতে পারছি না কারণে, দিনে দিনে back dated হয়ে পড়ছি, কী জানি !
‘রামায়ন’ এর রাম-সীতা’র প্রেম-ভালোবাসার সাথে মহাভারতের দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বা যজাতির সাথে দেবযানীর ভালোবাসা কে গুলিয়ে ফেলা টা যেমন ঠিক নয়, ঠিক তেমনি ভালোবাসা শব্দটি কে জীবন থেকে বর্জন করে দেওয়াটাও সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তবু বলবো, আমাদের দেবগুরু বৃহস্পতি’র পুত্র কচ্ এর সাথে দানব-গুরু শুক্রাচার্য্য এর একমাত্র কন্যা দেবযানী’র সম্পর্কের মাঝে কেউ কেউ একটু betrayal এর গন্ধ পেলেও আমার কাছে এই ঘটনাগুলো কে সাহিত্যের “ethical dilema” বলেই মনে হয় ……….যা যে কোনো উন্নত সাহিত্যকে আরও উৎকৃষ্টতা দান করে। যাক্ সে এক অন্য প্রসঙ্গ।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর গ্রন্থে ‘ভালোবাসার’ সংঙা দিতে লিখছেন, ” Love means to live in one’s good “….. “কারুর ভালো তে বাস করা”। মায়া-রূপী যে ভালোবাসা পেয়ে আমাদের জীবনের শুরু মোক্ষ-রূপী সেই ভালোবাসা তেই তার সমাপ্তি। সব জেনেশুনে ও তাহলে সমাজে আজ ভালোবাসার অভাব বলে ভাবছি কেন ? কারণ এর একটাও সতে পারে, কারুর প্রতি আমাদের নিজেদেরই প্রকৃত ভালোবাসা নেই। যে দিতে জানে না, পাবে সে কী করে ?
আর, যা’কে ভালোবাসা বলে মনে হচ্ছে, আসলে তার কেন্দ্রে থাকছে কোনো না কোনো স্বার্থ। উপনিষদ এ পাই, “নবারে পত্যুঃপ্রিয়কামায় পতিপ্রিয়ঃ ভবতি। আত্মণস্তু কামায় পতিপ্রিয়ঃ ভবতি।। নবারে জায়য়া কামায় জায়াপ্রিয়া ভবতি। আত্মনস্তু কামায় জায়া প্রিয় ভবতি।। নবারে পুত্রাণাম্ কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি।আত্মনস্তু কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি।।” ……. অর্থাৎ স্বামীকে ভালোবাসলে সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষিত হবে বলেই স্ত্রী স্বামীকে ভালোবাসেন। স্ত্রী ভালোবাসেন কারণেই স্বামীকেও তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হয়। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সম্বল মনে করে, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই তার সন্তান দের ভালোবাসেন। ভেবে দেখলে, এমন ভালোবাসার মূলেও কিন্তু ঘুরেফিরে সেই স্বার্থ ! কিন্তু, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কখনও বিফলে যায় না, যেতে পারে না।
এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর ঘটনা মনে পড়ছে। সাল টি ১৮৭৩ বা ৭৪। আমেরিকার নিউজার্সি অঞ্চলের পেনসিলভেনিয়ার কোনো একটি জায়গা। বেশ কয়েকটা দিন ধরে এক পড়ুয়া বালকের খাবার টুকুও ঠিকঠাক্ জুটছিল না। পেটে ছুঁচো ডন মারলে কোথায় আবার কিসের পড়া ! মরিয়া হয়ে বেরিয়ে একদিন সে ভাবছে, সামনে যে ঘর পড়বে তারই দরজায় সে কড়া নাড়বে। কোনো মা বেরোলেই আগে কিছু খাবার চাইবে। ঘটলো ও তাই। কড়া তে নাড়া পড়তেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু, কোনো মা নয়, সামনে মুখ তুলতেই, বছর ১৫ বয়সীর এক সদ্য-যুবতি।
“কী……. কিছু বলবে, ভাই ?”
” না, না…… তেমন কিছু নয়। “
” কিছু খেতে চাইছ ? মুখটা শুকিয়ে গেছে তোমার। “
” না, খেয়েই এসেছি তো।”
” তবে, কি এক গ্লাস জল খাবে ?”
” দিন তাহলে।”
মেয়েটি এক গ্লাস উষ্ণ-দুধ এনে হাতে দিতেই মুহূর্তে শেষ। বালক বললো, ” কতো দেবো আপনাকে ?”
মেয়েটি বললো, ” সে কী… মা শিখিয়েছে, কারুর প্রতি ভালোবাসা দেখালে, বিনিময়ে কিছু নিতে নেই।”
“ঠিক আছে। চলি তবে” …..বলেই, মাথা নীচু করে বালক হনহন্ করে চলা শুরু করলো।
তার বহু বছর পরের ঘটনা। John Hopkins Medical College এ জটীল-রোগে আক্রান্ত, মৃতপ্রায় এক পেশেন্ট কে জরুরি ভিত্তিতে operation করবার ডাক পেলেন প্রতিভাশালী স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, ডাঃ হাভার্ড কেলি। ছুটে এলেন। অপারেশন সাকসেশফুল। মহিলা দ্রুত আরোগ্য লাভ করলেন। কিন্তু, এখন প্রতিমুহূর্তে ভদ্রমহিলার মনে হতে লাগলো, মৃত্যুটাই বুঝি ঠিক ছিল। এই বিশাল অঙ্কের অর্থের যোগান দেবে কে ? আর, না দিতে পারলে, তিনি ছাড়াই বা পাবেন কী করে ?
পরের দিন নিয়মমতো,অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীর দরজায় দাঁড়ালো। বেড এ থাকতেই বিল এসে পৌঁছালো পেশেন্ট এর হাতে। কিন্তু, এ কী আশ্চর্য্য ! লম্বা বিল এর তলাতে ডাক্তারের স্বাক্ষর সহ তারকা চিহ্ন দিয়ে লেখা………..
” Paid in full with a glass of milk on that day.”।
ডাক্তারকে চেনা রোগীর পক্ষে সম্ভব না হোলেও রোগীকে চিনতে ডাক্তারের এক মুহুর্ত ভুল হয় নি। এর নাম ই নিস্বার্থ ভালোবাসা, কিনা!
প্রকৃত ভালোবাসা তে কী না হয় ? প্রতিটি দিন ক্ষুধার্ত বাঘ-সিংহের খাঁচাতে ঢুকে, খাঁচা পরিস্কার করা বা মুখের সামনে মাংসের টুকরো দিয়ে আসার মতো কাজ গুলো তো আপনার আমার মতোই রক্ত-মাংসে গড়া একজন মানুষ ই করে! আসলে, বন্যেরাও বুঝে ভালোবাসা কারে কয়।
গাছপালার ক্ষেত্রেও বিষয় টা নাকি একই রকম বলে বর্তমান বিশ্ব মনে করে। Luther Berbank নামে এক ম্যাক্সিকান নাগরিকের সখ ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাকটাস সংগ্রহ করে নিজের বাগানে চাষ করা। হঠাৎ একদিন তাঁর মাথায় এলো, রুক্ষ পরিবেশে থেকে, ভালোবাসার অভাবে, এদের পাতাগুলো কাঁটাতে রূপান্তরিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখানে তো ভালবাসার কোনো অভাব নেই ! তাহলে, এখানেও এদের সারাটি গায়ে কাঁটা হবে কেন ? তাহলে, কী ওদের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা আমি ওদের বোঝাতেই পারি নি এতোদিন?
এরপরে, তিনি একটি নির্দিষ্ট ক্যাকটাস চারা ঠিক করে তার গায়ে তুলো-জড়ানো একটি নরম কাঠি দিয়ে রোজ দিন হালকা ভাবে নাড়া দিতে দিতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে, শুনিয়ে শুনিয়ে, নিজের মুখে বলতে লাগলেন, ” এই, আমি তো তোমার বন্ধু। তোমাকে কত্তো ভালোবাসি। রোজ আসি। খাবার দিই, জল দিই। এখানে না কোনো উট আছে, না তোমার কোনো শত্রু আছে। তবে এখানেও সারা গায়ে তোমার কাঁটা হবে কেন ?”
সত্য এটাই, আড়াই মাস পরে, ক্যাকটাসে নতুন bud বেরলো। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখলো, নতুন সেই bud এ একটিও কাঁটা নেই !!!
স্পর্শকাতর এই বিষয়ে উদ্ভিদ-বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন মহল তাঁদের ব্যাখ্যা দিয়েই চলেছেন। দেখা যাক্ কোথায় থামে তাদের মানবিক মুখ ।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.