গান ই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী
“ঋগিভঃ স্তুবন্তি, যজুভিঃ যজন্তি সামভিঃ গায়ন্তি।”…. তাই, এটা মনে করা ভুল হবে না, সঙ্গীত- চর্চার শুরু ‘ষড়-অঙ্গ’ সেই বেদ এর হাত ধরেই। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ নিয়ে বেদ। এর যে ছ’টি অঙ্গ তাতেও ‘ছন্দ’ এর আড়ালে সেই সুর-সাধনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। যোগ দর্শন এর ‘অনাহত নাদ’ সে ও তো বিশেষ এক রাগে আধারিত এক ধ্বনী বিশেষ।
বেদ-পরবর্তী, গন্ধর্ব লোকের যে সনাতন ভারতীয় ভাবনা সেখানে তো বীণা-তন্ত্রী-বিপানসী’র তার আজও দ্রুত-মধ্য ও বিলম্বিত লয়ে ঝঙ্কৃত হয়ে সপ্তম সুরে রচে চলেছে তার সুরের মূর্ছনা। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০- ১১০০ ছিল ভারতীয় সংগীত এর স্বর্ণযুগ। মাতঙ্গ ঋষি’র ‘বৃহদ্দেশী’ তে রাগ-রাগিনীর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণ এ এমন ও উল্লেখ আছে, সঙ্গীত-নবীশ নারদ ভুল রাগে গান গাইলে, ব্রহ্মা তাঁকে উলুকেশ্বর নামে এক গন্ধর্বের কাছে সুদ্ধ-রাগ শিখতে পাঠিয়ে ছিলেন। তারপরেই তিনি “সঙ্গীত-মকরন্দ্” লিখে এ জগত কে ঋদ্ধ করেছেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ- সঙ্গীত তার ধ্রুপদ-ধামার -খেয়াল-তারাণা দিয়ে, আবার হালকা-উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তার টপকা- ঠুংরি-দাদরা-গজল্ বা কাওয়ালী দিয়ে যুগের পর যুগ সমৃদ্ধ রেখেছে আমাদের। সামাজিক পরিবেশ ও পাশ্চাত্যের প্রভাবে, এখন ভারতীয়-সঙ্গীত ও তার ভাবের গতি কিছুটা হলেও, বদলাতে বাধ্য হয়েছে.…সে অন্য কথা। তবু, আজও চৌষট্টি কলার শ্রেষ্ঠ কলার নাম ই যে সঙ্গীত।
এ কথা স্বীকার করতেই হয়, ভারতীয় সঙ্গীত তার রাগ-রাগিনী ‘র ঠাসা বুননে একে একে বুনে চলে পূর্বরাগ-অনুরাগ -প্রেম ও আবেগ শুধু নয়, সাথে তত্ব-দর্শণ এবং সুগভীর জীবনবোধ ও। যে স্বর মনে লহরী রচনা করে সেই তো ‘রাগ’ !
” সখি, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম…..
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো…
আকুল করিল মনো-প্রাণ ” এই সুরে কী বলছেন, চণ্ডীদাস।? “গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে”….. ভানু সিংহ ই বা আমাদের মনে কী লহরী তুলছেন, ভাবা যায় ? আবার ধরুন তো, ” ভরাবাদর মাহভাদর শূণ্য মন্দির মোর”……. বিলম্বিত লয়ে, কৃষ্ণ বিরহী রাধা’র কন্ঠে এ কী বিরহের মূর্ছনা সৃষ্টি করলেন ‘মৈথেলী-কোকিল’ ? ভক্তের বিশ্বাস, জয়দেব এর “গীত-গোবিন্দ” এর সুমধুর পদ শুনতে শুনতেই প্রতি রাতে আজও নীলাচলে নিদ্রা যান প্রভু জগন্নাথ।
” মধুরং মধুরং বপুরে সে বিভূ”….
“কৃষ্ণ কর্ণামৃত কাব্য” এর অন্ধ ব্রাহ্মণ বিল্বমঙ্গল’র এই পদ সুরের কী আবেগ জাগায় আমাদের মনে ? আর এই তো সেদিন, কবিগুরু দের ‘উপাসনা গৃহ’ তে রোজ বসতো ব্রাহ্ম- সঙ্গীত সাধনার আসর। প্রবাদ প্রতিম ধ্রুপদ শিল্পী বিষ্ণু চক্রবর্তী ও যদু নাথ ভট্টাচার্য ছিলেন কবিগুরু’র ‘সুরগুরু’। ১৮৮১ তে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে লেখা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাট্য-কাব্যের শেষদৃশ্যে, বীণাপাণি তাঁর বীণা বাল্মীকির হাতে তুলে দিয়ে বলছেনঃ
” আমি বীণাপাণি তোরে এসেছি
শিখাতে গান
তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণ প্রাণ।”
বিশ্ব-বরেণ্য দার্শনিক প্ল্যাটো ও যথার্থই বলেছেন,
” Music gives a soul to the universe, wings to the mind, flight to the imagination and life to everything”……. পাষাণ-প্রাণ তো গলবে ই।
তাহলে কী, বধির সেই সঙ্গীত-শিল্পী, Ludwig Von Beethoven এর সেই বিখ্যাত উক্তি, “Music can change the whole world” মেনেই ২য় বিশ্বযুদ্ধ এর পরপরই গঠিত হোল বিশ্বের সব চেয়ে বড়ো সঙ্গীত- চিকিৎসা কেন্দ্র AMTA ( American Music Therapy Association) ? সঙ্গীতের মাধ্যমে মানসিক অবসাদ কমাতে, ওজন-বৃদ্ধি রুখতে, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, স্মৃতি শক্তি এবং বোধ-শক্তি ( Alzheimer’s & Cognitive failure) বাড়াতে গান এখন এক পরীক্ষিত সত্য। তাই শুধু নয়, দেখা গেছে,অপারেশন এর পরে Adrenaline এবং Cortisol এর মাত্রা কমিয়ে ও Endorphin নিঃসরণ করে রোগীর ব্যথা কমাতে সক্ষম। নেশা-মুক্ত করতে, এমন কি, ক্যানসারে ও সঙ্গীত এক কার্যকরী দাওয়াই বলে প্রমানিত। প্রখ্যাত গনিতজ্ঞ, পিথাগোরাস ও গান এর ঔষধি গুন স্বীকার করে গেছেন। জিউস-বাইবেল এর ১৬শ অধ্যায়ে রয়েছে, ” And it happened that whenever the Spirit of melancholy from God was upon Saul David would take the lyre and play it. Saul would then feel relieved and the Spirit of melancholy would depart from him”….
বাদ্য-যন্ত্রটি বাজালেই রাজা সৌল আরাম অনুভব করছেন, ‘বিশাদ-আত্মা’ দূরে পালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, চিকিৎসা বিজ্ঞান এর সাথে ভারতীয় সঙ্গীত সাধনা মিলিত ভাবে প্রমান করতে পেরেছে——-
ইমন রাগঃ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে খুব কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
ভৈরবী রাগঃ উদ্বেগ, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের অ্যালার্জি, টিবি, ক্যান্সার, শ্লেষ্মা, সর্দিকাশি, সাইনাসাইটিস, দাঁতব্যথা, আর্থ্রাইটিসে উপকারী।
দরবারি রাগঃ অনিদ্রা এবং উদ্বেগে কার্যকরী।
দরবারি কানাড়াঃ মাথাব্যথা, স্নায়ুরোগ অ্যাজমা, মস্তিষ্কের সমস্যা, ব্যথা-বেদনায় উপকারী।
বসন্ত রাগঃ উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ, হার্ট ও স্নায়ুরোগ, নার্ভাস ব্রেকডাউন, পক্ষাঘাতে সুফল দেয়।
টোড়ি রাগঃ মাথাব্যথা, ঠাণ্ডা লাগা, উচ্চ রক্তচাপে উপকারী।
আশা বরী রাগঃ নিম্ন রক্তচাপ ও হীনমন্যতায় কার্য্যকরী।
ভীমপলশ্রী রাগঃ উদ্বেগ ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পারে।
রামকেলি রাগঃ কোলাইটিস ও অর্শ রোগে সফল বলে প্রমানিত।১১০০
বেহাগ্ রাগঃ ঘুমের ব্যাঘাতে ও নাকডাকায় ভীষণ উপকারী।
এ রকম অসংখ্য, জানা-অজানা, রাগ-রাগিনী
রয়েছে ভারতীয় সঙ্গীত এর ভান্ডারে যারা জীবের শরীরে আরোগ্যকারী-ক্ষমতার সাক্ষ্য রাখতে পারে।
তাই, বেগ বাড়িয়ে আবেগ কমিয়ে, লক্ষ-শত স্ট্রেস স্ট্রেন টেনসন নিয়ে চলতে যখন হবেই তবে রাগ এর প্রতি বিরাগ না দেখিয়ে আসুন, আমরা বরং যে যার “অনুরাগের ছোঁয়া” দিয়ে সঙ্গীত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার কন্ঠে গলা মিলিয়ে স্বীকার করে নিই….” গান ই সর্ব-শ্রেষ্ঠ সা.…ধ….না। “

Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.