ড: ধীরেশ চৌধুরী ,
কলকাতা, 4 July 2022
মাত্র ৩৯ বছরে চলে গেলে। কিন্তু এত কম বয়সে এত আধ্মাতিক উত্তরণ কোনো কিছু দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারিনা।

তবে একটা কথা বলি তোমার চলে যাবার ১২০ বছর পরেও আমাদের মধ্যে কিন্তু আজও কোনো বিবেক বোধ জাগ্রত হয়নি, বরং দিনে দিনে সেটা কমছে…
পারো যদি জন্ম নাও আবার, তোমার সময়ের থেকেও অনেক অনেক বেশি দরকার তোমাকে এখন…
আজ ৪ঠা জুলাই, তোমার তিরোধান দিবসে আগের লেখা দিয়ে অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি
ঈশ্বর দর্শন –
নজরকাড়া সৌম্য দর্শনধারী মধ্য তিরিশের গৈরিক বসনে দাঁড়িয়ে আমার সামনে যিনি,
তাকে যে আমি ভীষণ রকম চিনি,
ইশারায় তাঁর হাত ধরতে আমায় ডাকছেন তিনি,
তবে কি সেই ইনি??? যাঁকে ঈশ্বর বলে মানি।
হাতটা ধরেই ফেললাম বহু ইতস্ততঃ করে,
এক অবর্ণনীয় শিহরণ গেল খেলে শরীর আলোড়িত করে,
এ অনুভূতি প্রকাশ করার নয়,
শুধুই অব্যক্তময়।
ভীষণ রকম এক ঘোরে,
সম্মুখ পানে চললাম তাঁর হাত ধরে,
ঘোর কাটলো তাঁর সেই দৃপ্ত স্বরে,
“হে মহাপ্রাণ, ওঠ জাগো ! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তোমার কি নিদ্রা সাজে?”
এর উত্তরে ক্ষীণ কণ্ঠে আমি যখন বললাম,
কিই বা ক্ষমতা আমার, লাগবো কোনো কাজে!
তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন তিনি –
“জগতে যদি কিছু পাপ থাকে, তবে দুর্বলতাই সেই পাপ। সর্বপ্রকার দুর্বলতা ত্যাগ কর—দুর্বলতাই মৃত্যু, দুর্বলতাই পাপ।”
উত্তরে একটু সাহস করে বলেই ফেললাম,
যে দুর্বলতাকে তুমি পাপ বলে উড়িয়ে দিচ্ছ মহাপ্রাণ,
সেটাই যে এই অধমের কাছে বড্ড বেশি চাপ,
শান্ত সমাহিত হাসি মুখে আমায় তখন ডেকে বললেন
আয় পাশে বস দিকি,
“তোমরা সকলে ভাবো—‘আমরা অনন্ত বলশালী আত্মা; দেখ দিকি কি বল বেরোয়। ‘দীনহীনা!’ কিসের ‘দীনহীনা’? আমি ব্রহ্মময়ীর বেটা! কিসের রোগ, কিসের ভয়, কিসের অভাব? ‘দীনহীনা’ ভাবকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় কর দিকি।”
স্নেহের উষ্ণ এই আবেশ কেটে ওঠার আগেই আবার বলে উঠলেন তিনি,
“হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে ভয় পেও না—এমন কি আকাশ থেকে প্রবল বজ্রাঘাত হলেও ভয় পেও না— খাড়া হয়ে ওঠ, ওঠ, কাজ কর।”
সে মুহূর্তে একথায় প্রাণ আমার যেন পেলো আগুনের পরশমণি।
এরপর তিনি হাত ধরে নিয়ে গেলেন গঙ্গা তীরে,
যেখানে কয়েকশো মানুষ স্নান করছেন মোক্ষ লাভের তরে,
তাদের বেশিরভাগই ক্ষুধার্ত অন্নহীন,
বলতে গেলে প্রায় সবদিক থেকে দীন,
তাদেরকে দেখিয়ে আমায় বললেন তিনি –
“ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাইতেছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল—সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নহে? অগ্রে তাহাদের উপাসনা কর না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করিয়া কূপ খনন করিতেছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস কর।”
পরমুহূর্তেই আবার আমার পানে চেয়ে বলে উঠলেন –
“যদি ভাল চাও তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান নর-নারায়ণের—মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজো করগে—বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ,তার পূজো মানে তার সেবা—এর নাম কর্ম…”
একথা শুনে বারবার কেমন যেন মনে হলো
কর্মে নয়, বরং আমরা ধর্মকে এতদিন শুধু করেছি আত্মরক্ষার বর্ম।
এবার তাঁর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম ভারত দর্শনে,
মিথ্যে দৃষ্টিতে দেখা এতদিনের চেনা ভারত নয়,
বরং সামনে থেকেও অদেখা সেই দেশকে তাঁর আহ্বানে –
“হে ভ্রাতৃবৃন্দ, আমাদের সকলকেই এখন কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে,এখন ঘুমাইবার সময় নহে। আমাদের কার্যকলাপের উপরই ভারতের ভবিষ্যত নির্ভর করিতেছে ঐ দেখ, ভারতমাতা ধীরে ধীরে নয়ন উন্মীলন করিতেছেন। তিনি কিছুকাল নিদ্রিত ছিলেন মাত্র। উঠ, তাহাকে জাগাও—আর নূতন জাগরনে নূতন প্রাণে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গৌরবমণ্ডিতা করিয়া ভক্তিভাবে তাঁহাকে তাঁহার শাশ্বত সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কর।”
তিনিই সেই সন্ন্যাসী, যিনি অন্নকে স্থান দিয়েছেন ধর্মের অনেক আগে,
নির্দ্বিধায় তাই বলে উঠলেন –
“আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি,মানুষকে বিশ্বাস করি; দুঃখী দরিদ্রকে সাহায্য করা,পরের সেবার জন্য নরকে যাইতে প্রস্তুত হওয়া—আমি খুব বড় কাজ বলিয়া বিশ্বাস করি।…
অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন—ইহা আমি বিশ্বাস করি না।”
বুঝতে পারলাম আমি কি মোক্ষম প্রাপ্তি আসে বৈরাগ্যে।
তাঁর সাথে পায়ে পা মেলাচ্ছি যতো, ততো চোখ খুলছে আমার,
এতদিনকার মিথ্যা দৃষ্টি ভেঙে হয়ে যাচ্ছে চুরমার,
যে কথাটা আমিও ভেবেছি বারবার
শোনালেন সেই কথা তিনি আবার –
“যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করিতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে একমুঠো খাবার দিতে পারে না,আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। যত উচ্চ মতবাদ হউক,যত সুবিন্যস্ত দার্শনিক তত্ত্বই উহাতে থাকুক, যতক্ষণ উহা মত বা পুস্তকেই আবদ্ধ, ততক্ষণ উহাকে আমি ধর্ম নাম দিই না।”
নিগূঢ় কথাটাই কতো খোলসা করে বলে ফেললেন আবার
“তিনি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করিতেছেন। যদি দর্পণের উপর ধূলি ও ময়লা থাকে, তবে তাহাতে আমরা আমাদের চেহারা দেখিতে পাই না। আমাদের হৃদয়-দৰ্পণেও এইরূপ অজ্ঞান ও পাপের ময়লা রহিয়াছে।”
ঈশ্বর কি? আমি জানিনা, আমি দেখিনি,
কিন্তু আমি তাঁকে দেখলাম আজ,
আর সেটাই যে আমার ঈশ্বর দর্শন,
সেই ঈশ্বর যিনি বলেন –
“বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
সবে চোখটা এসেছে জড়িয়ে,
দেখতে পাচ্ছি আমি তিনি আস্তে আস্তে যাচ্ছেন ক্রমে মিলিয়ে,
স্বপ্নে এতক্ষণ দিয়ে গেলেন আমায় যিনি
এক অনির্বচনীয় পরমানন্দ,
তিনি আর কেউ নন
তোমরা যাঁকে ডাকো ‘বিবেকানন্দ’।