স্টার্ট–আপ থেকে উদ্ভাবনের দেশ
ডঃ কৃষ্ণা এল্লা
আমাদের দেশ স্টার্ট-আপ সংস্কৃতিকে যেভাবে জোরের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা আমার কাছে এক বিশেষ প্রেরণামূলক কাহিনী। সরকারের যাবতীয় নীতি এবং পরিচালন উদ্যোগের সঙ্গে এই উদ্ভাবনের বিষয় যুক্ত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আমি যখন দেশে ফিরলাম, এই সংস্কৃতির অভাব তখন গভীরভাবে অনুভব করেছি। টিকা ব্যবসায় স্বনির্ভরতার উদ্যোগের এই স্বপ্নের পথে তখন ছিল অনেক প্রতিবন্ধকতা। আমরা তখন স্টার্ট-আপ-এর পর্যায়ে। নতুন ভারত গড়ার লক্ষ্যে নীতি আয়োগের যে সর্বাত্মক জাতীয় প্রকৌশল তাতে আমি বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। সর্বাঙ্গীণ প্রয়াসকে যুক্ত করতে এ এক অভিনব উদ্যোগ। ২০৩০-এর মধ্যে জিডিপি-কে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং অন্য অংশীদারদেরকে যুক্ত করায় নীতিগতভাবে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সিএসআইআর ল্যাবরেটরি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি (আইআইটিএস), ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই), অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা কাজ করেছে যাতে করে দেশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত অনেক সাফল্যের ক্ষেত্রে শিরোপা অর্জন করতে পারে।
ইউনিকর্ন ইন্ডিয়া
গত আট বছরে অন্য দেশের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি ইউনিকর্ন তৈরি হয়েছে। স্টার্ট-আপ-এর সর্বাধিক সংখ্যার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ভারতের স্থান এখন দ্বিতীয়।
দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা করেন যে ২০২১-এ ১০০টির মধ্যে ৪৪টি ইউনিকর্ন তৈরি হয়েছে এবং এ বছরেই দ্রুত আরও ১৪টি ইউনিকর্ন গড়ে উঠেছে, তখন দেশের নাগরিকদের কাছে, বিশেষত আমার মতো প্রথম প্রজন্মের স্টার্ট-আপ উদ্যোগপতির কাছে তা এক শ্লাঘার বিষয়। বিশ্বজুড়ে মহামারীর সময়েও স্টার্ট-আপগুলি দেশের সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেওয়ায় দেশ শক্তিশালী হয়েছে।
দেশের যুব সম্প্রদায়ের স্বপ্ন পূরণে সরকার বছরের পর বছর যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ও নীতি রূপায়ণ করেছে তাতে উদ্যোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে যা ভবিষ্যৎ উদ্যোগপতিদের কাছে এক প্রেরণার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্টার্ট-আপগুলির প্রসারের ক্ষেত্রে ‘স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিতে বিনিয়োগের ওপর কর ছাড়, ‘ইনভেস্ট ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম’ এবং নীতি আয়োগের ‘অটল ইনোভেশন মিশন’ সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে। মহিলা উদ্যোগপতিদেরকে আরও বেশি উৎসাহ দিতে ‘অটল ইনোভেশন মিশন’ বিশেষভাবে সফল।
বিশ্ব ওষুধ ভাণ্ডার
বিশ্ব ওষুধ ভাণ্ডারে ভারত ধীরে ধীরে শক্তিশালী জায়গা দখল করে নিয়েছে। সস্তা মানবসম্পদ এবং উন্নতমানের উৎপাদন ক্ষেত্র থাকার ফলে বিশ্ববাসীর কাছে ওষুধ পৌঁছে দিতে ভারত এক বড় ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে, বিশেষ করে যাঁরা ওষুধের সুবিধা পান না, তাঁদের কাছে সস্তায় জীবনদায়ী ওষুধ এবং টিকা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত প্রথম সারির ভূমিকা পালন করছে।
ভারত বায়োটেক, যা একটি স্টার্ট-আপ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, বিশ্বব্যাপী সমস্যা দূরীকরণে এবং সময়ের মধ্যে সমাধানসূত্র পৌঁছে দিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
ভারতের নিজস্ব টিকা অগনিত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এটি ভারত বায়োটেকের এক সফল নিদর্শন। মহামারী থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের পরে ভারত তৃতীয় দেশ যা সাফল্যের সঙ্গে সময়সীমার মধ্যে ক্লিনিকাল পরীক্ষা চালিয়েছে এবং ক্লোন থেকে ভায়ালে এগিয়েছে।
টাইফয়েড ভ্যাক্সিন এবং রোটাভাইরাস ভ্যাক্সিন, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদিতে বিশ্ব যখন সমস্যাদীর্ণ, ভারত তখন এগুলির টিকা উৎপাদনে পথ দেখিয়েছে।
দেশে ওষুধ উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল যাতে দেশেই উৎপাদন করা যায় তার জন্য উৎপাদন ভিত্তিক উৎসাহ ভাতা (পিএলআই) প্রকল্প চালু করা হয়েছে যা এক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী ভারত বায়োটেক-এর উৎপাদন স্থান পরিদর্শন, উদ্যোগপতি এবং বিজ্ঞানী হিসেবে আমার কাছে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। দেশ এবং বিশ্বের কাছে সরকারের যে দায়বদ্ধতা এবং বিশ্বাসের জায়গা তা পুনঃপ্রতিষ্ঠান করেছে। এর পাশাপাশি বিজ্ঞানী এবং এক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কর্মচারীদেরকে অভাবনীয় এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় প্রেরণা প্রদান করেছে।
দেশীয় কোম্পানিগুলির কাছে থেকে কোভিড-১৯ টিকার ৯৭ শতাংশই পাওয়া আমাদের কাছে এক গর্বের মুহূর্ত। সরকারের নিরন্তর উৎসাহ এবং নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া এই সাফল্য অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না এবং আমার মতো একজন উদ্যোগপতির কাছে এটি একটি নতুন প্রয়াস।
ডিজিটাইজেশন ও সামগ্রিকতা – এক সফল পথের দিশা
ইউপিআই-এর মতো ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতি নিঃসন্দেহে ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সফল পদক্ষেপ, সাম্প্রতিককালে যা নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় প্রচেষ্টা বলে মনে করা হয়।
ই-কমার্স-এর বৃদ্ধির ফলে আর্থিক বৃদ্ধিতে সকলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। নতুন ভারতের আরও একটি সাফল্যের নজির হল গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। মহামারীর সময় যে কোউইন অ্যাপ চালু হয়েছিল তা ১০০ কোটি দেশবাসীর ডেটাকে সংযুক্ত করতে সাহায্য করেছে যা বিশ্বের দেশগুলির কাছে জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশকে ডিজিটাইজ করতে পারার এক সফল নিদর্শন।
মহামারীর প্রস্তুতিতে দেশকে তা সাহায্য করেছে। এই অ্যাপ্লিকেশন এবং ডেটাবেস সহ অন্যান্য সমাধানসূত্র সারা বিশ্বে এক নজির গড়েছে। ভবিষ্যৎ গবেষণার ক্ষেত্রে এটি কাজে লাগানো যাবে।
ভবিষ্যতে কোনও মহামারীর মোকাবিলায় এবং কোনও এলাকায় কোনও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে কোউইন অ্যাপের মাধ্যমে সরকার সহজেই তার মোকাবিলা করতে পারবে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব
যে কোনও দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা, ওষুধ এবং গবেষণা সহ যে কোনও ক্ষেত্রেই এটি একটি আদর্শ হিসেবে কাজ করবে।
রোটোভ্যাক, টাইফয়েড এবং কোভ্যাক্সিন-এর উজ্জ্বল উদাহরণই এ ধরনের যৌথ উদ্যোগের সাফল্য প্রমাণ করে। টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভারত বিশ্বকে রোটাভাইরাস, টাইফয়েড এবং কোভ্যাক্সিনের মতো বিশ্বমানের সস্তা কোভিড-১৯ টিকা প্রদান করেছে।
উদ্ভাবনকে উৎসাহ যোগাতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উদ্ভাবনের এক বাতাবরণ তৈরি করতে সরকার ইনোভেশন সেল এবং ‘চিফ ইনোভেশন অফিসার’ নিয়োগ করেছে। এটি সরকারের এক সফল প্রয়াস।
এখন যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ইনকিউবেশন সেন্টার রয়েছে এবং তারা সরকার ও শিল্পক্ষেত্রে সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে। ভারত বায়োটেক ও আইসিএমআর-এনআইভি-র মধ্যে যৌথ উদ্যোগের সফল প্রয়াস হল কোভ্যাক্সিন।
শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের এই যৌথ সহযোগিতা আরও বাড়াতে হবে যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আরও বেশি স্টার্ট-আপ তৈরি করতে পারে এবং উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন বিজ্ঞান-ভিত্তিক উদ্যোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মূলধন বিনিয়োগ করতে পারে।
এছাড়াও, এসবিআইআরএ-বিআইআরএসি গ্র্যান্ট এবং নীতি আয়োগের সহায়তা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রকে আরও বেশি প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।
ঐক্যবদ্ধ ভারত
দেশের অগ্রগতির জন্য যা প্রয়োজন তা হল জনসাধারণ ও নেতৃত্বের মধ্যে এক ঐক্যবদ্ধ চেতনা। একটি রাষ্ট্র তখনই বড় হয় যখন সেখানে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, পরিশ্রুত জল, সকলের জন্য উন্নতমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ, দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ সরকার এবং উদ্যোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে স্টার্ট-আপ-এর এই সাফল্য সরকারকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এর জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
কেবলমাত্র দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণে এইসব স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ পৌঁছে দিতে এইসব উদ্যোগগুলি দেশকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।
আমি নিশ্চিত আগামীদিনে বিশ্বের বৃহত্তর মানুষের কাছে সহজলভ্য ওষুধ ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্র কার্যকরি ভূমিকা নেবে এবং আমার স্থির বিশ্বাস যে এক্ষেত্রে ভারতের সম্ভাবনাময় স্টার্ট-আপগুলি এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারবে।
জনস্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মসূচিতে ভারত বৃহৎ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বিভিন্ন উন্নত দেশ এবং বিশ্ব নেতৃত্বের সাধুবাদ কুড়িয়েছে। আমরা আমাদের দেশকে আরও বৃহৎ ভূমিকায় উত্তীর্ণ করার ভিত্তি তৈরি করে ফেলেছি।
এই ভারত উৎসাহের ভারত!
*লেখক: ভারত বায়োটেক–এর চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর