হেমন্তের দূত আর আবহমান ঝুমকোলতা
সুমন ঘোষ
সারাদিন দিঘি। সারাদিন জলের সুরাহা। রোদ এসে খানিকটা পা ডুবিয়ে বসে। খানিকটা পা দিয়ে জল ছিটিয়ে দেয় আশেপাশের গাছগাছালিতে। তুমি গাছগাছালির মেয়ে। হেমন্ত তোমার প্রিয় ঋতু। জীবনানন্দের গ্রামে তোমার বাস। কিছু ধানখেত কিছু ধানসিড়ি কিছু কুয়াশা কিছু কার্তিক কিছু গান আর কিছু গাঙচিল– এইসবই তোমার পৃথিবী। এইসব ঠোঁটে নিয়ে তুমি উড়ে যাও জ্যোৎস্না ভেজা রাতে বিবাগী তারার ডাকে এদেশ থেকে ওদেশ। তোমার ডানার ছায়া আধোচুম্বনে আমার সর্বাঙ্গ হরণ করে নিয়ে যায় সেই কতদূর জাতিস্মরের দেশে। দু’দিন আলাপ অথচ মনে হয় তুমি আমার কতদিনের চেনা। কতদিন আগে তোমার পায়ে আলতা পরিয়ে দিয়েছিলাম, এখনও সেই চিহ্ন লেগে আছে। কতদিন আগে তুমি বলেছিলে, পাহাড়ে আপত্তি কী! এই দেখ চূড়া! সেই তুমি আমাকে চূড়াতে রেখে দিয়ে চলে গেলে। ফিরেও তাকালে না। আমি বারবার মেঘ পাঠালাম। হাওয়া পাঠালাম। পাখি পাঠালাম। তুমি চুপ করে রইলে। এই জন্মে, আমি কতবার ফোন করি তোমাকে। কতবার মেসেজ পাঠাই। যদি একবার উত্তর দাও…
একটা উত্তরের জন্য আমি সারাদিন জলস্পর্শ করি না। বিরামহীন উপোসের দিকে পা বাড়িয়ে বসে থাকি। হাঙর এসে সেইসব পা নিয়ে অন্ধকারে চলে যায়। পিরান্হা এসে আমাকে তছনছ করে যায়।
অথচ আমি সমস্ত বলেছি তোমাকে। বলেছি :
আকাশে নক্ষত্র আছে– ঢের আছে– তবু দূর প্রান্তরের পারে
ঐ কুঁড়েঘরে
যেই বাতি জ্বলে
সমস্ত নক্ষত্র মুছে ফেলে দিয়ে সে-ই যেন একা কথা বলে
বিনাশের বুদ্ধি চারিদিকে
যে রকম অবিনাশ — তেমনি আশার মত রয়েছে সে টিকে।
বলেছি, এই যে দেখা হল, এই দেখা লক্ষ বছরে হয়তো কারো কারো হয়। অথবা হয় না। কোটি কোটি বছর অপেক্ষা করতে হয়। বিরাট দালানে লতারা উঠে যায় কার্নিশ বেয়ে। ভাঙা-ভাঙা জানলায় হাওয়া ঠকঠক করে। তুমি বলে ওঠো : আমার ভয় করছে।
আমি বলি : এই তো আমি।
ভয় আর ভয়, প্রেমে পড়ে যাওয়া মুহূর্তের সেই ভয় দু’দণ্ড থমকে দাঁড়ায়। চারদণ্ড আয়নার দিকে তাকায়। শুধু আয়নার ভিতরে থরোথরো হৃদয়খানি বলে ওঠে : আহ্! এত ভূমিকম্প কেন! আমি মাটি চাপা পড়ে যাচ্ছি।
–মাটি কই! বিপুল বিশাল সরোবর!
মাটির রমনী তুমি। কত কাণ্ড করে যত্ন করে গড়েছি তোমাকে। এইভাবে পুনরায় ছেড়ে যাবে? জলে যাবে? কেন যাবে?
জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?
চুপিচুপি হৃদয় গণনা করি। তোমাকে নিয়ে যা বলি যা লিখি সব মিলে যায়! অথচ আমি কাউকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করিনি। কারোর কাছে তোমার খোঁজ নিইনি। গতজন্মে নিষেধ করেছিলে তাই কারো কাছে তোমার নামোচ্চারণ করিনি।
শুধু একবার তাকিয়েছি আর একবার ধারণ করেছি তোমার অশ্রুধারা। অশ্রুতে ঠিকানা লেখা ছিল। অবুঝ বিমনা ঠিকানা যা আমাকে ঘুরিয়ে মেরেছে চিরকাল। আমি বাসে চাপতে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছি। স্টেশনের খুব কাছে দোল দোল বাড়িটি বুঝি তোমার? পাশেই তোমার লক্ষ্মী সরোবর?
যেখানে রোজ আমি ডুবসাঁতার দিতে যাই কিন্তু তুমি এত লাজুক যে বারবার সরোবরটিকে রেখে দিয়ে আসো তোমার ঐ অচেনা অদেখা গ্রামের বাড়িতে। আমি মনে মনে বলি :
দিল মেরা সোজ-এ-নিহাঁ সে বে-মহবা জ্বল গয়া
আতিশ-এ-খামোশ কী মানিন্দ গোয়া জ্বল গয়া।
কোনও রকম আভাস ছাড়ায় যে মন পুড়ে যায়, তাকে আমি কোথায় রেখে আসি! যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের — মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা?
অথচ তুমি যে বলেছিলে–
নিত্য প্রেমের ইচ্ছা নিয়ে তবুও চঞ্চল
পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল,
তোমার আলোয় আলো হলাম,
তোমার গুণে গুণ;
অনন্তকাল স্থায়ী প্রেমের আশ্বাসে করুণ
জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।
গালিব লিখেছিলেন :
কহতে হো, ‘ ন দেঙ্গে হম দিল অগর পড়া পায়া’
দিল কঁহা কি গুম কীজে? হমনে মুদ্দয়া পায়া।
আচ্ছা, মন কি মনের কথা জানে? জানে না বলেই তো এত খোঁজ, এত তারায় তারায় ভ্রমণ, এত গান, এত সুর, কবিতার নির্জন পদস্খলন, আমি থেকে তুমি আর তুমি থেকে আমি, হৃতপ্রদেশের স্মৃতির সুড়ঙ্গ, আত্মাবিনিময়।
এই করতে করতে এ-জীবন সে-জীবন ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ একটি বই আর বইয়ের ভিতরে দেখলাম তুমি বসে আছো। জীবনের শত উপাসনা আর দারিদ্র্য পার করে বসে আছো পোকার গুঞ্জনে। একটি ছোট হাইফেনের পাশে। কীরকম হাইফেন?
সেই হাইফেনের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়
ধানসিড়ি, ধলেশ্বরী, কোপাই। উড়ে যায় শঙ্খচিল,
ঘাস থেকে ঘাসের অমোঘ নিভৃতে গুবরে পোকার
গুঞ্জন, জামরুল-হিজলের বন, বেহুলার ডিঙা।
সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রতিসরণে এই হাইফেনটুকু অমোঘ বাসনা হয়ে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকার প্রতিটি অনুষঙ্গে অনুভূত হয় : কারুবাসনার চেয়ে প্রিয়তর কিছু নেই।
এই কারুবাসনাই আমাদের নিয়ে চলেছে নিভৃত কার্তিকে, ভ্রমরের গুনগুনে, মুথাঘাস-মাখা নীরব পাড়াগাঁর দিকে যেখানে হিজলের বাঁকা ডালে কবির ইচ্ছায় চাঁদ উঠবে আর কবির অপ্রকাশিত রচনা নিয়ে একা একা অপেক্ষায় থাকবে ঝুমকোলতা।
হ্যাঁ, এখানে ওর নাম ঝুমকোলতা। হেমন্তের গাঁয়ে সে কাঁপন-লাগা হাওয়ার শরীর নিয়ে বসে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে সে ছুঁয়ে আসে দেশবিদেশের মিথ। অথচ আমি বেশ বুঝতে পারি সে আসলে বহুদূর রক্তমাংসের নারী। সেকারণে ঝুমকোলতার কবি লিখেছেন–
তোমার বাড়ি থেকে স্টেশন মিনিট পাঁচের পথ, ওখানে ছিলাম এতদিন,
চিনতে পারোনি?
আসলে ঝুমকোলতা তো কাউকে চিনতে চায় নি। চিনতে চায় না। কবি তাকে অতর্কিতে চিনে ফেলেছে। তারপর থেকেই সে দুঃখের সওদাগর হয়ে সদাভ্রাম্যমাণ। এই সে গানের জলসায় সিউড়িতে তো এই তার মাটি ছুঁয়ে গেল সেমেটিক সভ্যতার কোনো সুর। এই সে কুমারসম্ভবে তো এই সে মার্কেজের জাদুবাস্তবতায়। কখনও ধ্বনি তো কখনও প্রতিধ্বনি। কখনও পৃথিবী তো কখনও ছায়াপথ।
যখন প্রথম কবিতা লিখেছিলাম
আর ছাপা হয়েছিল কৃত্তিবাসে
যেদিন দ্রাবিড় জলভূমি থেকে ফিরে এসেছিল
সব বাণিজ্য তরণী, তখন কোথায় ছিলে?
….
….
বলো ঝুমকোলতা
যখন আমার সাতাশ বছর বয়স ছিল
তখন কোথায় ছিলে তুমি?
কল্পনা করুন, কবির অতিক্রান্ত সাতাশ আর সেই বয়সে না-পাওয়া ঝুমকোলতার দীর্ঘ বেদনা কী আবেগে এখন ধেয়ে আসছে। আমি সেই ঢেউ স্পর্শ করতে পারছি। আমার জীবনেও ঝুমকোলতার মতো সত্য আর কিছু নেই।
পুনরায় কবি লিখছেন–
দীর্ঘদিন যে সত্য বলিনি
আজ বলি অভাবই আমার স্বাধীনতা
আমার ঈদ, শারদীয়া, নবান্ন উৎসব
আমার সন্তান আর ঝুমকোলতা
আমার বাসমতি সংগ্রহ
হলুদ তাঁতশাড়ি, মায়ের হাসিমুখ,
ভ্রমর গুঞ্জন করে, গাছে গাছে পাখিদের শিস
শহরে যাব না এই অহংকারে
ঝুমকোলতা ভাত চড়িয়েছে
শুদ্ধতম মাটির উনুনে।
মনে পড়ে যায়, আমিও একদিন তোমার কাছে ভাত চেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে : সে আমার সৌভাগ্য। অথচ সেইটুকু দিন জলের মতো গড়িয়ে গেছে। অস্থির হতে হতে মরেই গেছি প্রায়। কিন্তু একবারও সেই জল স্পর্শ করিনি।
জীবনানন্দ মনে পড়ে–
একদিন মনে হত জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–
অথবা দুপুরবেলা– বিকেলের আসন্ন আলোয়–
চেয়ে আছে– চলে যায়– জলের প্রতিভা।
ভাবুন, কী আশ্চর্য! যে আমাকে অন্ন দেবে বলে সম্মতি জানিয়েছিল এবং তারপর অকারণে আচম্বিতে রুদ্ধ করেছিল সকল দুয়ার, আজ তাকেই দেখলাম, একটি কবিতার ভিতর শুদ্ধতম মাটির উনুনে ভাত চড়িয়েছে। আমার জন্য নয়, কবির জন্য। এই কবির নাম নাসিম-এ-আলম। এখানে তার যে বইটির কথা বলছি তার নাম– বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা। প্রকাশক : বার্ণিক।
অগ্রহায়ণ এখানে হেমন্তের দূত। আর সেই হেমন্তের সূত্রে এই বইটির স্বপ্নে ও স্রোতে বয়ে চলেছেন জীবনানন্দ। আর বুকের অনন্ত ধারায় জীবনানন্দকে সন্ধ্যাতারার মতো রেখে দিয়েছেন ঝুমকোলতা।
জয় লিখেছিলেন না, সেই মেয়েটির কাছে সন্ধ্যাতারা আছে। এই সেই মেয়ে। নাসিম লিখেছেন:
রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপি শেষের পর্যায়ে
ঝুমকোলতা দেখে নিচ্ছে অসংখ্য কমা-হাইফেন
জটিল হাতের লেখায় বাসমতির সুঘ্রাণ, মেঠো
ইঁদুরের মতো মরণের ঘোরে ক্ষুদের গন্ধ লেগে আছে।
লিখছেন:
আমিও জেনেছি কিছু বাসমতির উপাখ্যান।
অগ্রন্থিত লেখাগুলো কোথায় সযত্নে রাখা আছে।
বুকের আঁচল দিয়ে সব খাতা আগলে রেখেছে ঝুমকোলতা।
কীভাবে তা বুঝি?
বুঝি হ্যারিকেন আলোর অন্তিম কলরবে
বুঝি কামরাঙা মেঘের সাঁতারে, দেবদারু নির্জনে
বুঝি পাড়াগাঁর দুপহর ভালোবেসে, কলমীর ঘ্রাণে
বুঝি কবির রচিত অন্ধকারে জোনাকির নিমগ্ন
আহ্লাদে, বাতাসে এলাচের ঘ্রাণে, চিলের খয়েরি ডানায়।
বুঝি ম্রিয়মান গোধূলি নামলে।
এত প্রেম আমি কোথা রাখি নাথ? কোথা রাখি সেই সোয়াটার বোনা দুপুরের ঘ্রাণ, শস্যের সনেট আর অপরিসীম ঝুমকোলতা। সারা বইয়ে ঝুমকোলতার গায়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে জীবনানন্দ। জানলার ফাঁক দিয়ে একে একে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন শক্তি-বিনয়-পিকাসো-সিলভিয়া প্লাথ-মার্কেজ-রবার্ট ফ্রস্ট- মিনহাজউদ্দিন-মপাসাঁ-বোদল্যেয়র-স্যামুয়েল-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-ভিঞ্চি-শেলীর মতো স্বপ্নের মানুষজন। ঝুমকোলতা অনন্ত কিশোরী। তার পায়ের কাছে আজও থমকে আছে সময়। ফলে, সময় নিয়ে লোফালুফি করতে করতে নির্মাণ ও বিনির্মাণের আশ্চর্য পরিসর তৈরি করেছেন নাসিম। পাশাপাশি অফুরন্ত নিসর্গ, খণ্ড খণ্ড ইতিহাস আর আলতো চাদরের মতো গায়ে লেগে থাকা দর্শনের টুকরো। ঈষৎ ছেলেমানুষী। যে ছেলেমানুষী ঝুমকোলতার আজীবনের প্রতিবিম্ব।
‘মৃত্যুর হেমন্তবালা ও ঝুমকোলতা’ কবিতায় কবি লিখছেন সাধ্যাতীত ভালোবাসার কথা, আমার নিমেষে মনে পড়ে যাচ্ছে শক্তির কবিতা:
আজ সাধ্যাতীত ভালোবাসবো বলে সকাল আমার
এত ভালো লাগে, এত সুন্দর, আলস্যভরা বায়ু
ঘর না বাহির, নাকি ঊর্ণাময় স্বপ্নের ফোয়ারা–
আমি বসে আছি, আমি শুয়ে আছি চারিদিকে কার
পশ্চাতে পাঠানো শান্তি লেগে আছে ভালবাসবো বলে
আমি ভালবাসবো, আমি হৈ হৈ করবো সারাদিন।
ঝুমকোলতার প্রতিটি স্পর্শ ভালবাসার স্পর্শ। সে সভ্যতার পর সভ্যতা পেরিয়ে, শিল্প আর শিল্পীর সন্তরণ পেরিয়ে, সৃষ্টি আর স্রষ্টার যোগাযোগ ও শূন্যতাকে ধারণ করে আছে। জীবনানন্দের জ্বর আসে। আর ঝুমকোলতা বারবার জীবনানন্দের জন্য চা করে আনে। কী মিষ্টি এক দৃশ্যকল্প। কত ঘরোয়া অথচ অসাধারণ।
আচ্ছা, ঝুমকোলতা নিজেও কি শিল্পী?
নইলে কবি লিখবেন কেন —
কুমোরের মাটি থেকে প্রতিমার অশ্রু
তুমি কিশোরীবেলায় চিনেছিলে,
যেন আগামীর না-বলা যত কথা লেখা ছিল উড়ন্ত রুমালে।
কেন বলবেন–
নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া ক্রমাগত
নিজেকে পুড়িয়ে দেওয়া নিঃশেষে
সব শেষ হলে শিল্পের আশ্রয়ে কি পড়ে থাকে? পড়ে থাকে কিছু?
পড়ে যে থাকে না কিছু সেকথা তো টের পাই। জীবনানন্দ লিখেছেন না?
…
যে অঙ্গার জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে যাবে, হয়ে যাবে ছাই–
সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে
জীবন পুড়িয়া যায়– আমরাও ঝরে পুড়ে যাই।
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি– তবু শক্তি চাই।
ঝুমকোলতার সঙ্গে কবির যোগাযোগ শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর যোগাযোগ। এখানে ঝুমকোলতা নিজেও একজন শিল্পী, হয়তো তেমন প্রকাশিত নন, হয়তো নির্জন, কিন্তু তিনি প্রকৃতার্থে শিল্পী। বারবার মনে হয় সে আমার কতদিনের চেনা।
সুনীল লিখেছিলেন —
বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার?
এই দিক-শূন্য ওড়াওড়ি, এ যেন শিল্পের রূপ–
আচমকা আলোর রশ্মি পপি ফুল ছুঁয়ে গেলে
যে-রকম মিহি মায়াজাল
বাতাসে তুলোর বীজ তুমি কার?
এই বইয়েও নাসিম ফিরিয়ে এনেছেন সেই বাতাসে তুলোর বীজ। কারণ, ঝুমকোলতার অভিমান। নীরাকে মনে পড়ছে না? সেই সত্যবদ্ধ অভিমান? ঝুমকোলতার অসুখ শুনে মনে পড়ে যায় না নীরার অসুখের কথা– নীরার অসুখ করলে কলকাতায় সবাই বড় দুঃখে থাকে।
অথচ এইসব কবিতা কারো অনুকরণের ছাঁচে গড়া নয়। তারা কেবল আবহমানের স্মৃতিকে উস্কে দেয়। আর শ্রীমতী ঝুমকোলতাও বড় একান্ত তার অন্তরের নিজস্বতায়। নাগরিকতা নয়, ঝুমকোলতা আমাদের গ্রামবাংলার লক্ষ্মীসরোবর। স্বয়ং প্রকৃতি। সে কাউকে চেনা দিতেই চায় না। আমি তাকে চিনে ফেলেছি সে আমার নিয়তি। কিন্তু প্রবাদে, মনস্তাপে সে সবার থেকে আলাদা। সে বিশ্বাস করে পাখি শিস দিলে বিলুপ্ত ভাষারা ফিরে আসে। মনে মনে সে চায় মেয়েদের নক্ষত্র ছোঁয়ার স্বপ্ন সফল হোক। পুরুষতন্ত্র ভেঙে যাক। অথচ সে জন্য তার এতটুকু তর্জনগর্জন নেই। সারা বই জুড়ে সে চুপচাপ। কবিই তার হলুদ শাড়িতে বাসমতি ধান এনে রাখছেন বারবার।
আজকাল কবিতায় এমন উজাড় করা নিরাভরণ ভালবাসা কমে গেছে। আমি কবিতার সামান্য পাঠক, ভালবাসার কাঙাল। ভালবাসার কাছে নতজানু হতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। অনেকদিন এরকম জলসেচ-ভরা কবিতার বাসমতিতে ম ম করে ওঠেনি আমাদের গোলা। অনেকদিন ভালবাসার এত দৃঢ় আর স্পষ্ট উচ্চারণ আদিগন্ত জড়িয়ে ধরেনি। রূপ আর রূপান্তরের স্রোতে ঝুমকোলতা আমার আজীবনের আলো ও আলেয়া হয়ে বেঁচে থাকে।
কবি লিখেছেন :
আমার আরোগ্য তুমি,
মৃতসঞ্জীবনী ঝুমকোলতা।
যতদূর জানি, নাসিম এখন মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছেন। ঝুমকোলতা, ও ঝুমকোলতা, তুমি ওকে সারিয়ে তুলবে না?
এই বইয়ে ঝুমকোলতা ছাড়াও অন্যান্য কবিতা বলে একটি অংশ আছে। সেখানে নাসিম নানা বিষয়ের কবিতা রচনা করেছেন এবং তার কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আমি আজ সে প্রসঙ্গে যাব না। আমার মন আজ আচ্ছন্ন হয়ে আছে ঝুমকোলতায়। যে আমাকে রোজ তাচ্ছিল্য করেছে অবহেলা করেছে, অথচ এই অদম্য গ্রন্থে সে রাণির মতো বিদ্যমান। অন্তর্লীন পিপাসার বাষ্প ছড়িয়ে সে বসে আছে। দেখামাত্রই আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি, তুমিও কি চিনতে পেরেছ আমায়, ঝুমকোলতা? এই চেনাটুকুর দ্যোতনায় একবার কথা বলা যায়? একবার?
এই লেখাটি শুরু করেছিলাম এক সমর্পিত অশেষ সম্পর্কের আভায়। শেষ করব কাদুর একটি কবিতা দিয়ে–
যদি দেখি কখনো তোমার
রূপান্তরে কোনো অস্থিরতা
তবে সেই অস্থিরতা এই :
তোমাকে প্রেমের আগে আমি
তোমার প্রেমকে ভালোবাসি।
এইবার বলুন তো কী মনে হয়– স্বপ্ন? নাকি বোধ? ভ্রম নাকি স্মৃতি?
কবিতার বই : বাসমতি ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা
কবি : নাসিম-এ-আলম
প্রচ্ছদ : অর্পণ
প্রকাশক : বার্ণিক
বার্ণিক বইবিতান, ২নং পাকমারা লেন,
বর্ধমান- ৭১৩১০১
দাম : ১৩৫ টাকা