শিবরাত্রি-ব্রত কী ?এর প্রাপ্তিই বা কী ?
ড. রঘুপতি সারেঙ্গী
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্। শিব শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মঙ্গল’। শিব অর্থে সন্তোষ, কল্যান। সত্য, সুন্দর ও জ্ঞানময় যে সত্ত্বা তিনি শিব। আবার সব দেবতার আদি বলে মহাদেব ‘আদিদেব’ নামেও পরিচিত। পুরানে ‘ত্রিদেব’ (প্রধান তিন দেবতা) ’র অন্যতম মহাদেব শিব।
প্রাচীন মুনি ঋষিদের উপাস্য দেবতা শিব হওয়ায় ভারতবর্ষের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত শিবালয়ের ছড়াছড়ি। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, পশুপতিনাথ এর মত গরিমাযুক্ত মন্দিরের কথা বাদ দিলেও রামেশ্বর, বানেশ্বর, জলেশ্বর, জল্পেশ্বর, চন্দনেশ্বর বা তারকেশ্বর ই কম যান কিসে ? দেওঘর এর বৈদ্যনাথ ধামে চৈত্রমাসে ভক্তদের শ্রদ্ধাভক্তি, আনন্দ উল্লাস আমাদের অধ্যাত্মিক চেতনার দ্যোতক নয় কী ? আজও এই আর্যাবর্তে (বর্তমান ভারতবর্ষে) মহাদেব এর দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ যেন সনাতন ধর্মের বারোটি সুউচ্চ স্তম্ভ স্বরূপ ।
” সৌরাষ্ট্রে সোমনাথঞ্চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুনম্ ।
উজ্জয়িন্যাং মহাকালমোঙ্কারমমলেশ্বরম্ ।।
পরল্যাং বৈজনাথং চ ডাকিন্যাং ভীমশঙ্করম্ ।
সেতুবন্ধে তু রামেশাং নাগেশং দারুকাবনে ।।
বারাণস্যাং তু বিশ্বেশং ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে ।
হিমালয়ে তু কেদারং ঘুসৃনেশং শিবালয়ে ।।”
এই হোল সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে মহাদেব’র দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ ।
শিব কী কোনো বৈদিক দেবতা ?
অনেক অধ্যাত্মিক সমালোচক শিবকে বৈদিক বা আর্যদের সেবিত দেবতার স্বীকৃতি দিতে চান না। কারন ? কারন তাঁর সহজ সরল কৃত্রিমতাহীন জীবন যাপন, সাজ -পোশাক ইত্যাদি আর্য সেবিত হিসাবে নাকি নেহাতই বেমানান। ব্যাঘ্রচর্মে নামমাত্র লজ্জা নিবারণ, নাগভূষণ, সর্বাঙ্গে চিতা ভষ্ম, মাথায় তেল-স্যাম্পু হীন জটা। বৃদ্ধ ষাঁড় এক, বাহন । নন্দী ভৃঙ্গি প্রধান সহকারী। সঙ্গী বলতে ভীষণ দর্শনা ভূত পেত্নী, চেড়ি চামুন্ডী । নির্জন শ্মশান ই তাঁর আদর্শ বিচরণ ভূমি।
স্বাভাবিক ভাবেই, এমন জামাতার উচ্চ বংশে অনুপ্রবেশ বা দক্ষরাজ এর যজ্ঞে আমন্ত্রন, এসব তখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। ঘটেও নি।
কিন্তু আশ্চর্য, ঋগ্বেদ এ ও যে তাঁর অবাধ প্রবেশ! এই বেদে তিনি ‘রুদ্র’ । ঋগ্বেদে এর ১০ম মন্ডলে রয়েছেঃ “ওঁ অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্ আদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ”।
অর্থাৎ আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট-বসু, দ্বাদশ আদিত্য। আমিই সমগ্র বিশ্বে জীবের আত্মা হিসাবে বিচরন করি ।
ঋক্বেদ এর অন্তর্গত ‘মহামৃত্যুঞ্জয়’ মন্ত্রে এই শিব ই ত্র্যম্বক (ওঁ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টি বর্ধনম্….) । কোথাও বা তিনি বজ্রধারী – কপর্দী । যজুর্বেদ্ এ এসে সেই তিনিই হলেন নীলকন্ঠ ।
উপনিষদে বিশেষতঃ ছান্দোগ্য উপনিষদ এ সর্বাঙ্গ হিরন্ময় যে সুপুরুষ কে আদিত্য মন্ডলের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে তিনি মহাদেব শিব ছাড়া আর কেউ নয় ।
মহাকবি কালিদাস তাঁর মহাকাব্যে লিখছেনঃ “শিবাস্তে সন্তু পন্থানঃ” – আপনার যাত্রাপথ মঙ্গলময় হোক। আবার, সেই শিবভক্ত তাঁর খন্ডকাব্য ‘মেঘদূত’ এ কৈলাশ পর্বত কে বর্ণনা করছেন, “…….. রাশিভূত প্রতিদিনম্ ত্র্যম্বকশ্চস্য অট্টহাস্যে”।
তাঁর চোখে, সাদা চূড়ার উজ্জ্বল এই কৈলাশ আসলে নটরাজ এব পুঞ্জিভুত হিমায়িত হাস্য রাশি। ভাবা যায়, এই না হোলে কবির কল্পনা?
সে যাক। বানেশ্বর বনৌষধি’র জ্ঞাতা। নটরাজ মূর্তিতে ‘হট্যোগ’ এর প্রণেতা ও সমগ্র সংগীত শাস্ত্রের উদ্গাতা। পানিণী’র ‘শিবসূত্র’ ও নাকি আসলে শিবের ডমরুর আঠারো টি বিশেষ বোল। আর আমাদের হরপার্বতী’র একান্ত কথোপকথন এর মাধ্যমেই তো ভারতীয় “আগম শাস্ত্র” বা তন্ত্রের আগমন ।
এমন মহাদেব আর্য দেবতা না অনার্য সেবিত দেবতা – এই বিষয়ে ঐক্যমতে আসা হয় তো কিছুটা কঠিন তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, আদিদেব শিব স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি । শিব পূজা মানেই প্রকৃতির উপাদান… ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম এর শান্তি, স্বস্তি ও শ্রী বৃদ্ধি কামনা ।
“ওঁ সর্বায় ক্ষিতিমূর্তয়ে নমঃ, ওঁ ভবায় জলমূর্তয়ে নমঃ, ওঁ রুদ্রায় অগ্নিমূর্তয়ে নমঃ” – এইসব বেদ-মন্ত্র আমার এই ধারনার বলিষ্ঠ প্রমাণ ।
শিবরাত্রির পৌরাণিক ব্রতকথাঃ
অনার্য শিব আর্য হয়ে ঋগ্বেদে স্থান করে নিলেন । ঋগ্বেদ্ থেকে উপনিষদ্ । উপনিষদ্ অতিক্রম করে পুরাণ । পুরাণ হয়ে পাঁচালি পাঁচালি …… যা আজও মায়েরা চতুর্থ প্রহর পূজার শেষে পাঠ করে নিজে শুনেন, ব্রতী দের শোনান ।
কথিত আছে, বারানসীর গভীর জঙ্গলে এক ব্যাধ পশু শিকার করে দিন যাপন করতো । একদিন ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । ঘুম যখন ভাঙে তখন আঁধার নেমে গেছে। অগত্যা সে হিংস্র বন্য পশুর ভয়ে একটি গাছে আশ্রয় নেয় । অভুক্ত পেট, মনে ভয়, মাথায় শিশির…… ঘুম আর আসে কী করে ? থরথর্ কাঁপতে থাকে গোটা রাত্রি । আর এই কম্পনের ফলে মাঝে মধ্যেই একটি করে পাতা অজানতেই পড়তে থাকে নীচে । ভাগ্যক্রমে, নীচে মহাদেব ছিলেন লিঙ্গ-রূপে। আর সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। মহাদেব এতেই অতি প্রসন্ন হয়ে গেলেন অপাঙ্ক্তেয় এই ব্যাধের উপর । সারাজীবন মন্দির, মসজিদ, গুম্ফা বা গির্জাতে না গিয়েও মৃত্যুর পরে নিকৃষ্ট ব্যাধের শিবলোক প্রাপ্তি হোল ।
শিবরাত্রির যৌগিক ব্যাখ্যাঃ
আজ এমন এক পবিত্র দিন যেদিন নির্জলা উপবাস থেকে কঠোর সাধনার অবসানে পার্বতির সাথে ‘হর’ এর মিলন হয়েছিল ।
পুরানে রয়েছে, “ফাল্গুনে কৃষ্ণপক্ষস্য যা তিথিঃ
স্যাচ্চতুর্দ্দশী তস্যাং যা তামসী রাত্রিঃ সোচ্যতে শিবরাত্রিকা”।
বাংলা ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের যে চতুর্দ্দশী তিথি হয় তার রাত্রি শিবরাত্রি হিসাবে নির্দিষ্ট ।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, উজ্জ্বল দিবালোক ছেড়ে ঘোর কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীতে শিবস্ততির আয়োজন কেন ?
আসলে, পুরাণ এর এই বিধানের সাথে যোগমার্গের সম্পর্ক খুঁজে পান আধ্যাত্মিক তত্ত্ব-বেত্তারা ।
এখানে, তমসাচ্ছন্ন রাত্রি আসলে অজ্ঞানতা-রূপ অন্ধকারের প্রতিক। উপনিষদ এর মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলেনঃ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’। হে ঈশ্বর ! আপনি আমাদের মন থেকে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে জ্যোতি’র পথে প্রেরন করুন। শিবসূত্রে আছেঃ “জ্ঞানম্ জাগ্রতঃ”। জাগৃতি বলতে জ্ঞানই। ঋগ্বেদে ‘রাত্রিসূক্ত’ নির্দিষ্ট আছে । ওখানে রাত্রিকে ও দেবত্ব প্রদান করা হয়েছে।
আর এ কথাও ঠিক, স্বাভাবিক নানান কোলাহল, যান্ত্রিক শব্দের মাঝে চঞ্চল চিত্তে ‘মঙ্গলম্’ শিব এসে বসবেনই বা কোথায়….. সেজন্যই হয়ত রাত্রির নিদান ।
গীতা’র সাংখ্য যোগে রয়েছেঃ
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।
মূঢ়তা এবং অজ্ঞানতার অন্ধকারে সাধারন জীব যখন ঘুমন্ত/আচ্ছন্ন থাকে যোগশ্রষ্টা মঙ্গলমূর্তি শিবের তখনই আগমন । আর কিসে আগমন ? এই নন্দী ভৃঙ্গীতে চড়ে । এই নন্দী ভৃঙ্গী…. আসলে ‘ইড়া’ এবং ‘পিঙ্গল’ এই দুই নাড়ি । এদের অবস্থান মূলাধার চক্র । এরাই পার্থিব সব কামনা বাসনা ভোগ ও চিত্তচাঞ্চল্যের আঁতুড় ঘর । কঠোর যোগাভ্যাস এর মাধ্যমে জীবের মন ‘চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’ করে যোগ ধ্যান ও চিন্তনের মাধ্যমে যখন এই ইড়া ও পিঙ্গ্লার উপর প্রভুত্ব দেখিয়ে সুষুম্না মধ্যস্থ ষড় চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রারে পৌছায় তখনই হয় হর-পার্বতির মিলন । ঠিক তখন জীবের শিবপ্রাপ্তি ঘটে। শিবপ্রাপ্তি মানে আত্মজ্ঞান লাভ।
তাহলে, পবিত্র চিত্তে এই ব্রত পালনের প্রাপ্তি ই বা কতোখানি ? পুষ্পদন্ত মুণী তাঁর ” শিব মহিম্ন স্তোত্রম্ ” এ লিখছেন ….
” অসিত-গিরি-সমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধু-পাত্রে সুর-তরুবর-শাখা লেখনী পত্রমুর্বী ।
লিখতি যদি গৃহীত্বা শারদা সর্বকালং তদপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি ॥”
মা সরস্বতী নিজে যদি হিমালয় এর মতো ভূষা কালির খন্ড কে কালি বানিয়ে সমুদ্র রূপী দোয়াতে ভরে, কল্প- বৃক্ষের ডাল দিয়ে যুগ যুগ ধরে লিখে চলেন তবুও এই ব্রত পালনের মহিমা শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু সত্য এটাই , পার্বতীর স্থিতি কে উপেক্ষা করে নির্জলা উপবাস কেই ব্রত মনে করলে ভুল হবে।
হর হর শম্ভু।
Dr. Raghupati Sharangi, is better known as a people’s doctor around Coochbehar. His followers believe him like doctors with “Midas Touch”.
He is originally from a remote village in the erstwhile Midnapore district. He loved homeopathy from his childhood and took his passion in order to the profession. He got a degree in Homeopathic Medicine from the University of Calcutta with the highest marks in the exam. After service with a homeopathy college in Kolkata, he took the government service in North Bengal and started his crusade against the pain and agony of disease through Homeopathy.
At present, he is associated with a health center under Coochbehar District with West Bengal Government Health Unit.