জাতপাত আর লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এক আদিবাসী নারীর কাহিনি

0
238
জাতপাত আর লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এক আদিবাসী নারীর কাহিনি
জাতপাত আর লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এক আদিবাসী নারীর কাহিনি
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:9 Minute, 50 Second

জাতপাত আর লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এক আদিবাসী নারীর কাহিনি

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়

সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। আজকের মতো অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়াও ছিল না। ফলে এক আদিবাসী নারীর স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনার খবর সীমাবদ্ধ ছিল খবরের কাগজের পাতায়। মৃত্যুর খবর সেখানে বেরিয়েছে, মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ নিয়ে প্রতিবেদনও বেরিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর আগেই যে সেই ছাত্রীর অভিযোগের তদন্ত করতে এক তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছিল এবং তারা যে একটা রিপোর্টও পেশ করেছিল সে-খবর বিশেষ কারুর কাছে পৌঁছোয় নি। কী ছিল সেই রিপোর্টে? তা জানার উপায় ছিল না। কারণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নিয়ে এই ঘটনা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেই কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেন নি। সেই প্রতিবেদন চিরকালের মত অবগুণ্ঠিতই থেকে যেত
যদি ঘটনা ঘটার তিন দশক পরে জগদ্বন্ধু বিশ্বাস এই প্রতিবেদন প্রকাশ না করতেন।

চরিত্রের নাম চুনী কোটাল। ভারতের প্রথম লোধা-শবর স্নাতক। এই কৃতিত্ব অর্জনের জন্য তিনি সংবর্ধনা পেয়েছিলেন দিল্লীর তিনমূর্তি ভবনে, দেশের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছ থেকে। ১৯৮৫ সালে মেদিনীপুর কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন চুনী। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের চাকরি পান তিনি। প্রথম পোস্টিং ছিল ঝাড়গ্রামে। পরে চুনী বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বে এম এ পড়তে চান। তাঁর পড়ার স্বার্থে মেদিনীপুরে আদিবাসী মেয়েদের হোস্টেল রাণী শিরোমণি কেন্দ্রীয় ছাত্রী নিবাসের সুপারের চাকরি দেওয়া হয় চুনীকে। এটি চুনীর পদোন্নতিও ছিল, তাঁর বেতনও বেড়েছিল। কিন্তু চুনী বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢোকার পরেই শুরু হয় সমস্যা।

সমস্যার কারণ মূলত এক উচ্চবর্গীয় শিক্ষকের চুনীর প্রতি বৈষম্যমূলক খারাপ ব্যবহার এবং অন্য শিক্ষকদের চুনীর প্রতি ঔদাসীন্য; চুনীর সমস্যার সময়ে তার পাশে না দাঁড়ানো। চুনী তাঁর শিক্ষক ফাল্গুনী চক্রবর্তী সম্পর্কে তাঁর অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন বিভাগের প্রধানের কাছে, ছাত্র সংসদের কাছে কিন্তু কেউই তাঁর কথা শুনে তাঁর পাশে দাঁড়ান নি। চুনী শেষ অবধি অনন্যোপায় তাঁর প্রতি হয়ে চলা এই অবিচারের প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি দেন।

চুনী চিঠি দিয়েছিলেন ১৯৯১এর ১০ এপ্রিল। এই বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ২৬ জুলাই। কমিটি কাজ শুরু করে ২ আগস্ট। তদন্ত শেষ হয় ১৯৯২এর ২৪ জানুয়ারি কিন্তু তা সত্ত্বেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হল না। চুনী দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে লাগলেন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সুবিচার পাওয়ার আশায়। কিন্তু তাঁর সেই আশা কুহকিনী হয়েই রয়ে গেল। ২৪ আগস্ট প্রতিবেদন যখন জমা পড়ল তার আটদিন আগে চুনী স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন।

চুনীর মৃত্যু কি আমাদের লজ্জিত করেছিল? সেই লজ্জা কিছুটা দূর করা যেত যদি, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যে অভিযুক্ত শিক্ষককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তাঁর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে যথোপপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হত। কিন্তু আদৌ তা হল না। উল্টে সেই রিপোর্ট আর বের-ই করা হল না! সেই রিপোর্ট অবশেষে প্রকাশিত হল। প্রকাশ করলেন জগদ্বন্ধু বিশ্বাস, নিজের ৮৮ বছর বয়সে। তিনি সেই রিপোর্ট পেয়েছিলেন নব্বই দশকেই। কিন্তু শাসকের ভয়ে তখন তা প্রকাশ করতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, “সিপিএম তখন মধ্য গগনে। কে কথা বলবে তার বিরুদ্ধে! তাই চুপ করে ছিলাম। প্রকাশ করলেই তখন আমার জীবন সংশয় হতো।”

লেখককে ধন্যবাদ ইতিহাসের এই মূল্যবান আকর উপাদানকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার জন্য। এই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায় চুনী কিভাবে একই সঙ্গে জাতিগত এবং লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। তাঁকে ক্লাস করতে দেওয়া হয়নি। ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর জাত তুলে কথা বলা হয়েছে। তাঁর হাজিরা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে পার্সেন্টেজ দেওয়া হয়নি। চুনীর কোনও অভিযোগকেই কিন্তু তদন্ত কমিটির তিন সদস্য উড়িয়ে দেন নি। বরং অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গে তাঁরা তাঁর অভিযোগ শুনেছেন, অন্য ছাত্র এবং সংশ্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সারবত্তা বুঝেছেন এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছেন। ফলে কমিটির তিন সদস্য, মেদিনীপুরের নরেন্দ্রলাল খান উইমেন্স কলেজ, মেদিনীপুর কলেজ এবং গড়বেতা কলেজের তিন অধ্যক্ষের ধন্যবাদ প্রাপ্য। (গড়বেতা কলেজের অধ্যক্ষ এই কমিটির সদস্য হয়েছিলেন প্রথমে গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য খড়গপুর কলেজের অধ্যক্ষ প্রয়াত হলে।)
কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। যে সুবিচার না পেয়ে চুনী মৃত্যুর পথ বেছে নিলেন তা তিনি মৃত্যুর পরেও পেলেন না। বরং তাঁর এই স্বেচ্ছামৃত্যুকে ‘দাম্পত্যকলহের ফল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হল। ১৯৮৯এর সিডিউলড কাস্ট অ্যান্ড ট্রাইব (প্রিভেনশন অব আট্রসিটিজ) অ্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও চুনী বিচার পান নি। উল্টে ১৯৯৫এ রাজ্য সরকার নিযুক্ত এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তদন্ত কমিটি রায় দেয়, ফাল্গুনী চক্রবর্তীর ব্যবহার চুনীর জীবন শেষ করে দেওয়ার মত ‘যথেষ্ট প্ররোচনামূলক’ ছিল না!
চুনীর মৃত্যুর পর প্রতিবাদীরা সরব হয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী প্রবন্ধ লিখেছিলেন ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-তে। দেশ ১৯৯২এর ৩১ অক্টোবরের সংখ্যার প্রচ্ছদ-বিষয় করেছিল চুনী কোটালকে। এরপরে তিন দশক কেটে গেছে। সবাই যে তাঁকে ভুলে গেছে তা নয়; চুনী কোটাল স্মরণে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু চুনীর ওপর ঘটা এই অত্যাচারের সম্পূর্ণ ইতিহাস ক’জন জানেন? আর তাই এই বই পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত আর লিঙ্গবৈষম্যের স্বরূপ বুঝতে চাওয়া মানুষের অবশ্যপাঠ্য। ক্ষমতা কিভাবে দুর্বলের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে সেই নির্মম ইতিহাস তো ভুলে যাওয়ার নয়। উদার আকাশ প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী প্রকাশক ফারুক আহমেদ গ্রন্থটি প্রকাশ করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। স্নেহভাজন ইতিহাস বিভাগের গবেষক ফারুক আহমেদ ও প্রয়াত অধ্যাপক জগদ্বন্ধু বিশ্বাসকে কুর্নিশ চুনী কোটালের আত্মহত্যার উপর আলোকপাত করার জন্য।

চুনী কোটালের আত্মহত্যা
জগদ্বন্ধু বিশ্বাস
উদার আকাশ,
ঘটকপুকুর, ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পিন-৭৪৩৫০২, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
প্রথম প্রকাশ: মে ২০২২।
মূল্য: ১৫০ টাকা।
কথা: +৯১ ৭০০৩৮২১২৯৮

About Post Author

Suman Munshi

Founder Editor of IBG NEWS (15/Mar/2012- 09/Aug/2018). Recipient of Udar Akash Rokeya Shakhawat Hossain Award 2018. National Geographic & Canon Wild Clicks 2011 jury and public poll winner. Studied Post Graduate Advance Dip in Computer Sc., MBA IT,LIMS (USA & Australia), GxP(USA & UK),BA (Sociology) Dip in Journalism (Ireland), Diploma in Vedic Astrology, Numerology, Palmistry, Vastu Shastra & Feng Sui 25 years in the digital & IT industry with Global MNCs' worked & traveled in USA, UK, Europe, Singapore, Australia, Bangladesh & many other countries. Education and Training advance management and R&D Technology from India, USA, UK, Australia. Over 30 Certification from Global leaders in R&D and Education. Computer Science Teacher, IT & LIMS expert with a wide fan following in his community. General Secretary West Bengal State Committee of All Indian Reporter’s Association
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here