আমাদের রাজ্যের বর্তমান সরকারী শিক্ষা ও বাঙালির ভবিষ্যৎ
সুপ্রিয় সেনগুপ্ত (কারিগরি কবিয়াল)
কবি, বাচিক শিল্পী ও নাট্যকর্মী
কবিগুরুর ভাষায় “শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধের সমান।” দুশো বছরের পরাধীনতার পর, ভারতবাসী হিসেবে আমরা যখন স্বাধীনতার রসাস্বাদন করলাম, তখন থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সুর ই অনুরণিত হত। কারণ : প্রথমে চিন্তন, তারপর মনন এবং তারপর শিক্ষণ। তাই একজন বাঙ্গালী যখন চিন্তন , মননের ক্ষেত্রে বাংলাকে সহজাত মাধ্যম করে নেয়, তখন তার শিক্ষণ ও সঠিক রূপরেখা খুঁজে পায় তার মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমে ই। ……এ তো গেল গোঁড়ার কথা। এরপর সংবিধান, আইন প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন, একাধিক সরকার বদল…..এই সমস্ত কিছু পেরিয়ে আজ আমরা বিংশ শতাব্দীর ও দুটি দশক পার করে ফেলেছি।
আমাদের শৈশবের পড়াশোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হলেও, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ের পথ ভুলে ও মারাতে চায় না। এটা কিন্তু রাতারাতি বা অকারণে হয়নি, বরং বলা ভালো একাধিক কারণসমূহ রয়েছে এই পরিণতির পেছনে।
আধুনিক পৃথিবীতে, পেশাগত প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির ইঁদুর দৌড়ে, নিজের সন্তান কে ইউসেন বোল্ট বা আসাফা পাওয়েল বা নিদেনপক্ষে ভারতের উড়ন্ত শিখ মিলখা সিং বানানোর স্বপ্ন নিয়ে চলা অভিভাবক রা অবশ্যই খুঁজতে থাকবেন, ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , কিন্তু আমাদের শৈশব, বেড়ে ওঠা বা মনন এই বিশ্বাস অবশ্যই রাখে যে, আমাদের সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্তের মানসিকতায় কোনো অভিভাবক যদি বোঝেন যে, সরকারী বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান গত অবস্থান, উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে অন্তত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতন, তাহলে, নির্দ্বিধায় তিনি তাঁর সন্তান কে সরকারী বিদ্যালয়েই পাঠাতে চাইবেন।
কিন্তু বিগত কয়েক দশকের রঙ নির্বিশেষে সকল সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত গুলো কে আমরা যদি একটু সহজ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে দেখব ক্রমাগত সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো কে একটু একটু করে, অভিভাবক দের চোখে “ভরসাহীন” করে তোলবার একটি সুনিপুণ এবং নিরলস প্রচেষ্টা চলে এসেছে।
কোনো সরকার রামধাক্কা (প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া…) দিয়ে আবার প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে, আবার কোনো সরকার ,লাখ লাখ দুর্নীতির মায়াজালে ভুয়ো এবং অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারী শিক্ষা দপ্তর টি কে ই কোমায় পাঠিয়ে দেয় । এরফল যা হবার তাই হয়েছে……নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘরে, দুবেলা ঠিক মতো খাওয়ার সংস্থান না থাকলে ও অভিভাবকরা সন্তানের জন্য একপ্রকার বাধ্য হন বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোয় ফর্ম তুলতে।
বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিগত দশ বছরে ৭০১৮ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। এটা কে কী বলবো? ঘটনা নাকি দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত অসভ্যতা ? আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, আমরা মানে ভোট ব্যাঙ্কের সবচেয়ে দামী সম্পদ, আম জনতা, আমরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত নীরব দর্শক হয়ে, রবি ঠাকুরের সহজপাঠের প্রথম পাতা র কথা টা কে আজ ও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি…..”ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া ।”
এবার সংকট মহামান্য আদালতের নির্দেশে ৩৬০০০ প্রাথমিক শিক্ষক কে বিদায়, যদিও যোগ্যতায় হয়তো কেউ শিক্ষক শব্দের অপমান ছাড়া কিছু নয়। অনৈতিক ভাবে যারা শিক্ষক হতে চায় তাদের দিয়ে, আর যাই হো সমাজ গড়া যায় না। দয়া আর মায়া এক জিনিস নয়, গরিব কে দয়া করুন কিন্তু চোর কে মায়া নয়, চোর কে মায়া করলে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎই চুরি যাবে ।

সুপ্রিয় সেনগুপ্ত প্রযুক্তিবিদ, অধিক পরিচিত কারিগরি কবিয়াল নাম তাঁর ইউটুব চ্যানেলের জন্য যেখানে অনন্য সাহিত্যের সেরা নিদর্শন গুলি নিয়ে কাজ করা ছাড়াও সারা বিশ্বের মধ্যে বাঙালির গর্বের মহিষাসুরমর্দিনী বাণীকুমার ও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই ঐতিহাসিক “মহালয়ার” রেডিও অনুষ্টান কে ইংলিশ ভাষায় উপস্থাপন করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও বাচিক শিল্পী হিসাবে নানা সামাজিক বিষয়ে ও ক্ল্যাসিক পদ্যের পদ্যকার ।