বিদ্রোহীর বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম
ফারুক আহমেদ
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তারুণ্যের শক্তি। তরুণ প্রজন্মের কাছে কাজী নজরুল ইসলাম আজও আর্দশের কবি হিসেবে প্রাসঙ্গিক। আমরা কবির লেখা পড়ে অনুপ্রেরণা পাই। জেগে ওঠি। জুলুম বন্ধ করতে প্রতিবাদের ভাষা পাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখায়। সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কবির কলম আশা জাগিয়েছিল মানুষের মনে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে কবির গান ও লেখা আজও সমান তালে মনের আকাশ জুড়ে বিশেষ বার্তা দিয়ে যায়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সপরিবার কৃষ্ণনগরে বসবাস করতে আসেন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি। স্ত্রী প্রমিলাদেবী এবং শাশুড়ি গিরিবালা দেবীসহ প্রথমে কয়েক মাস কবি কৃষ্ণনগরে হেমন্তকুমার সরকারের প্রায় পারিবারিক আশ্রয়ে গোয়াড়ি বাজার এলাকায় গোলাপট্টিতে বসবাস করেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলায় সভা সমিতিতে যোগদান এবং কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন সম্মেলনের কাজে কবি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৬ সালের ২২ ও ২৩ মে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভার সম্মেলন। দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণ, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশে এই সম্মেলনের জন্য কবি উদ্বোধনী সংগীত বিখ্যাত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ রচনা করে তা পরিবেশন করেন। চরম বিশৃঙ্খলা ও হৈ-হট্টগোলের মধ্যে স্মমেলন শেষ হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে দেশবন্ধুর গৃহীত প্রস্তাব ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল হয়ে যায়। কৃষ্ণনগরের রাজনৈতিক পরিবেশও বিশৃংখল হয়ে পড়ে। এরকম সময়ে গোয়াড়ির বাজার এলাকা ছেড়ে কবি শহরের প্রান্তে চাঁদসড়ক এলাকায় ‘গ্রেস কটেজ’ নামে একটি বাগানবাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন।
আমের বাগানে ঘেরা প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপরে বাংলো টাইপের এই ‘গ্রেস কটেজ’ ছিল কলকাতায় বসবাসকারী এক সম্ভ্রান্ত খ্রিস্টান মহিলার বাগানবাড়ি।প্রায় নির্জন এই বাড়িতে কবি আড়াই বছর সপরিবার বসবাস করেন। এই বাড়িতেই কবির প্রিয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়, রচিত হয় ‘দারিদ্র্যব’, ‘খালেদ’ প্রভৃতি বিখ্যাতট কবিতা ও‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস। এই বাড়িতেই ঘটে বাংলা সংগীত জগতে যুগান্তকারী ঘটনা—‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’— বাংলায় গজল গানের সৃষ্টি হয় এই বাড়িতেই। চূড়ান্ত অভাব, অনটন ও দারিদ্র্যেবর মধ্যে কবির পারিবারিক জীবন অতিবাহিত হয় এই সময়কালে। অবশেষে ১৯২৮ সালের শেষ দিকে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।
উল্লেখ্য যে ‘গ্রেস কটেজ’ বাড়িটি এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে। ১৯২৮ সালের পরে ‘গ্রেস কটেজ’সহ পুরো এলাকাটি একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থার হাতে চলে যায়, পরবর্তীকালে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অধীনে আসে। এখনো সেই বাড়িটি রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির অফিস এলাকার মধ্যেই অবস্থিত। দীর্ঘকাল এই বাড়িটি বিদ্যুৎ দপ্তরের অফিস হিসাবে ব্যবহৃত। ২০০৫ সাল নাগাদ ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হয়। ২০১০ সাল নাগাদ কৃষ্ণনগরে ‘সুজন বাসর’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন কর্তৃক হেরিটেজ ভবন হিসাবে ঘোষিত হয়। প্রথমে বিদ্যুৎ দপ্তরের সহায়তায় এবং পরে হেরিটেজ কমিশনের উদ্যোগে অতি সম্প্রতি ভবনটির সংস্কার করা হয়েছে। সারাজীবনে প্রায় চল্লিশবার বাসাবদল করা বিদ্রোহী কবির বলতে গেলে এটিই একমাত্র অক্ষত স্মৃতিধন্য বাসভবন। সুজন বাসর সাংস্কৃতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বর্তমানে এই ভবনটি নজরুল চর্চাসহ একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
কালজয়ী সাহিত্যসৃষ্টি নিয়েবাঙালির প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদ্যাপন চলছে। গবেষণালব্ধট সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, কবিতা, সংগীত, গল্প, নাটক, শিশুসাহিত্য ও উপন্যাস রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।বাংলা সাহিত্যে সামাজিকওসাংস্কৃতিক জাগরণের বাণীবাহক কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.) ছিলেন বিদ্রোহী চেতনার ধারক, বাহক এবং রূপকার।তাঁর সংগ্রামশীল বর্ণাঢ্য জীবনে রচিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ওসংগীতশাস্ত্রসহ সৃষ্টিশীল মৌলিক প্রতিভার রূপস্বরূপ সাধনার অনুশীলন এবং চর্চা আবহমান বাংলার বাঙালি সমাজে আজও বিরাজমান।এনিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানী গবেষণার ধারা শতাব্দী পেরিয়ে এখনো সমানভাবে গুরুত্ব বহন করছে।যাসাহিত্য ক্ষেত্রে এমন সাফল্য, স্বাতন্ত্র্য, সাযুজ্য পাঠক ও সমালোচকের নিকট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।বিশেষত পরাধীনতা, শোষণ-বঞ্চনা, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি. এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী প্রত্যয় ব্যক্তকরার ক্ষেত্রে তিনি আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অধুনা নজরুল প্রতিভার স্বরূপ সন্ধান, অনুধাবন এবং তাঁর সাহিত্যের নবমূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন সৃষ্টিশীল লেখকগণ। যা নজরুল চর্চা ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এক মূল্যবান ও অপরিহার্য সংযোজনা।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগ প্রবর্তক ও মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড়ো প্রতিভার অন্যতম বিস্ময় হলো বারংবার তাঁর মূল্যায়ন চিন্তার গুরুত্ব পুনর্বিচার করা। নজরুলের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নিয়ে পাঠকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পিপাসা অপূরণীয়। তাই নতুন করে তাঁকে জানতে চাওয়ার বাসনা অমূলক নয়। এমন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান প্রেক্ষিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে চলমান রয়েছে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা-পর্যালোচনা এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থের প্রকাশ। তাঁর সাহিত্যকীর্তি ও মাঙ্গলিক চিন্তাধারার বিদ্রোহী ভাবাবেদন সার্বিক পরিচয়ে বিভিন্ন গ্রন্থের ফ্রেমে তুলে ধরার একটি প্রচেষ্টা দুই বাংলা জুড়ে অব্যাহত রয়েছে। চৈতন্যের উপলব্ধি থেকেই প্রাবন্ধিকগণ কাজী নজরুল ইসলামকে মূল্যায়নের নিজস্ব প্রয়াস গ্রহণ করেছেন।বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় ‘বিস্তীর্ণআকাশজুড়েকাজীনজরুল ইসলাম’ নামক সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে স্থান পাওয়া প্রবন্ধ সমূহ আঙ্গিক গত নিরীক্ষায় অনন্য সংযোজনা।
বাঙালির জাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কবিতা ও গান ছিল প্রেরণার উৎস।তাঁর সৃষ্টিকর্মে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিসুলভ ভক্তির প্রাবল্য, আবেগের আতিশয্য ও প্রাণপ্রাচুর্যে বিদ্যমান থাকতো বিচিত্র মনোনিবেশ। যেখানে ব্যক্তিগত ভালোলাগা বা মন্দলাগার মতো কোনো বিষয় মুখ্য হিসেবে কখনোই দেখা দিতো না। বাঙালির জাতীয় জীবনে মুক্তির অবগাহনই ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল প্রেরণার অন্যতম উপাদান। ধনবাদী যুগের শোষণযন্ত্রের কবলে পড়ে মানুষ যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তা তীব্রভাবে উপলব্ধি করে বিপ্লবের প্রেরণায় বাঙালি জাতিকে বরাবরই উদ্বুদ্ধকরেছেন। প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আশায় লেখনির মাধ্যমে তাঁর এমন সংগ্রাম ছিল ক্লান্তিহীন।
কাজী নজরুল ইসলাম-এর প্রতিভার যথাসাধ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়াস অন্বিষ্ট হয়েছে মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিকগণের লেখনির সাহচার্যে। যার মধ্য দিয়ে সুনিবিড় মহিমার প্রত্যয়ে বিদ্রোহের বার্তা ও সাম্যবাদের রূপান্তর সূচিত হয়েছে। যেখানে তারুণ্যের উদ্দীপনায় গৌরবময় চিন্তাচেতনা ভিন্নমাত্রা অর্জনেসক্ষম। আন্তরিক তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতা চিত্তে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুক্তি নির্ভর স্বাধীন অভিমত ব্যক্ত করেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। তাই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে অনুশীলন ও চর্চা করা জরুরি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে। ভারতের অশুভ শক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ফ্যাসিট শক্তি তাদের তুঘলকি কাজকর্মের ফলে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর আঘাত হানছে অশুভ শক্তি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে রাজশক্তির অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আওয়াজ তুলেছিলেন।
আবেগের পরিবর্তে যুক্তির আলোকে ও রস বিচারে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকৃত সাহিত্যে বিশ্লেষণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। হৃদয়ে যদি নতুন করে জীবনপ্রীতির দর্শনে হৃদয় ও বুদ্ধিমুক্তির তাগিদে কাজী নজরুল ইসলামকে জনমানসে আবিষ্কারের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হই তবেই অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রয়াস সার্থক হবে।
যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নবজাগরণের অন্যতম রূপকার। আর এই রূপকের অনন্য সাধারণ ভাবনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যথাযথ আবেদনে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন। মূলত শক্তি ও মুক্তির চেতনায় মানব প্রত্যয় নিয়ে যুগযন্ত্রণায় তিনি যে দ্রোহের ভূমিকা পালন করেন তারই রূপান্তর বিদ্রোহী কবিতার নির্যাস। জাগতিক অন্যায়, অবিচার, শোষণ, দুঃশাসন ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বিদ্রোহ। পরাধীন ভারতবর্ষে যখন মানবতা শৃঙ্খলিত, সমাজকাঠামোয় তমসাচ্ছন্ন, তখন তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির মুক্তির কামনায় হয়ে ওঠেন অসনিসংকেত। ব্যক্তিনিরপেক্ষ, মুক্তিকামী ও স্বাধীনচেতা মানুষটি দেশ ও জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে শক্তি ও প্রত্যয় নিয়ে গেয়েছেন জাগরণী গান।
কাব্যগ্রন্থ, ধর্মদর্শন, ইতিহাস, লোকসাহিত্য, সংগীত, নাটক, ছোটোগল্প, সমাজভাবনা ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক বৈচিত্র্যময় বিষয়ে সহজলভ্য উপায়ে কাজী নজরুল ইসলাম-এর কলম প্রথম স্বাধীনতার সুর জাগিয়ে তোলে পরাধীন ভারত জুড়ে। যা আজও সেই ভাব-সৌন্দর্যের অমিয়সুধা উপভোগ করছেন পাঠক বাঙালি ও জাতি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখায় বরাবরই জাগরণ ও দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ ও উদ্দীপনামূলক ভাবাবেদন তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা বাঙালিদের জীবনাচার ও তাঁদের অতীত, বর্তমান এবং ভূত-ভবিষৎ সম্পর্কিত কর্মপন্থা বিষয়ক লেখায় তিনিছিলেনঅধীক যত্নবান।
ক্রিসমাসের রাত ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩/৪ সি, কলকাতারতালতলা লেনের বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিল হাতে নিয়ে লিখেছেন কালজয়ী ও বাংলা ভাষার অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। শতবর্ষ পেরিয়ে আজও সমান আবেদন নিয়ে অমর হয়ে আছে এই কবিতাটি ভাবাবেদন। হয়তো অনাগত সময় ধরে কবিতাটির আবেদন বাঙালি জীবন ও সমাজে অটুট থাকবে।
