দুর্গা পূজার ইতিকথা বাঙালীর প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা।
সুপ্রিয় সেনগুপ্ত, কারিগরি কবিয়াল
সারা বছর আমরা এই চার-পাঁচ দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। বাইরে থেকে লোকজন বাড়িতে ফেরে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সবার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখাসাক্ষাৎ হয়। সব মিলিয়ে যেন এক মিলনমেলা ।কবে, কখন, কোথায় প্রথম দুর্গাপূজো শুরু হয়েছিল–তা সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।। কিন্তু, বাঙালীর এই শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠানের সূচনা উৎসের সন্ধানে , আমরা যদি আলোকপাত করি, তাহলে দেখব, এর মূলত: দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত: পৌরাণিক তথ্য এবং দ্বিতীয়ত: ঐতিহাসিক তথ্য। এবারে, পৌরাণিক উৎসের সন্ধান করলে দেখব …………এই শরৎকাল শাস্ত্রমতে দেবদেবীদের নিদ্রা বা বিশ্রামের সময়। তাই এই সময়ে দেবপূজা উপযুক্ত নয়। কিন্তু, এই সময়েই দেবীর পূজা করতে হয়েছিল । কালিকা পুরাণ ও বৃহৎধর্ম পুরাণ অনুসারে আমরা এই কথা জানতে পারি যে রাম-রাবণের যুদ্ধের জন্য ব্রহ্মাকে দেবী দুর্গার পুজো করতে হয়।
আবার কৃত্তিবাসী রামায়ণে আমরা দেখি যে স্বয়ং রাম নিজে দেবীর পুজো করছেন।রাবণের লঙ্কাপুরী ও স্বয়ং রাবণ নিজে দেবী ভদ্রকালী দ্বারা রক্ষিত ছিলেন। তাছাড়া রাবণ যুদ্ধের আগে দেবীর উপাসনা করে দেবীর থেকে এই বর প্রাপ্ত হন যে দেবী যুদ্ধের সময়ে তাঁর রথের সম্মুখে থাকবেন। অর্থাৎ রাবণকে পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তাই রামকেও দেবীর আরাধনা করতে বলা হয়। রাম পুজো করলেও দেবীর দর্শন পেলেন না। তাই বিভীষণের পরামর্শে তিনি ১০৮ পদ্ম দিয়ে দেবীর পুজো করবেন বলে সঙ্কল্প নেন। তাঁর নির্দেশে হনুমান যান দেবীদহে ১০৮ নীলপদ্ম আনতে। ফুল আনার পর রাম পুজো করতে করতে দেখেন যে ১ টি পদ্ম নেই। আসলে দেবী নিজেই রামের পরীক্ষা নেবার জন্য একটি ফুল লুকিয়ে রাখেন। তখন তিনি তাঁর পদ্মসদৃশ চোখ দেবীকে অর্পণ করবেন বলে স্থির করেন। যখনই তিনি এই কাজ করতে যান তখনই দেবী আবির্ভূত হন ও রামকে যুদ্ধ জয়ের আশীর্বাদ দিয়ে তাঁর অস্ত্রে প্রবেশ করেন। অবশেষে রাম যুদ্ধে জয়ীও হন। এই হল শরৎকালে দেবীর অকালবোধনের কাহিনী।
তবে বাল্মিকী রামায়ণে রামের দুর্গা পুজোর এই কাহিনী নেই।আবার যখন শ্রী শ্রী চন্ডীর পাতায় চোখ রাখি, তখন দেখি, রাজা সুরথের কাহিনী।রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাজিত হলে তাঁর মন্ত্রী ও কিছু সভাসদ বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর রাজত্ব ও সেনাবাহিনী সব নিয়ে নেন। তখন তিনি রাজ্য থেকে চলে এসে বনে বনে ঘুরে বেড়ান। তখন তাঁর মেধা নামে এক মুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। মেধা মুনি রাজাকে তার আশ্রমে নিয়ে যান। এরপর রাজার সঙ্গে একদিন দেখা হয় সমাধি নামে এক বৈশ্যর। তাঁর থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পুত্ররা তাকে বিতাড়িত করেন। সুরথ ও সমাধি দুজনেই মেধা মুনির কাছে তাঁদের মনঃকষ্টের কারন জানতে চাইলে তিনি দেবী মহামায়ার কথা বলেন ও তাদের দেবীর পূজা করতে বলেন।তখন দুজনেই দেবী দুর্গার আরাধনা করেন ও দেবী সুরথকে তাঁর রাজ্য এবং সমাধিকে বোধি দান করেন। এই হল দুর্গা পূজা শুরুর মূল দুই কাহিনী।
তবে অন্যান্য দেবদেবীরাও নানা সময়ে দেবীর পূজা করেন, তাঁর বিবরণ পাই ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণে। সেখান থেকে জানতে পারি যে প্রথম নাকি দুর্গার পূজা করেন কৃষ্ণ। দ্বিতীয়বার পূজা করেন ব্রহ্মা মধু ও কৈটভ নিধনের সময়। তৃতীয়বার দেবীর পূজা করেন শিব , ত্রিপুর নামে অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে। আর চতুর্থবার দেবী পূজা করেন ইন্দ্র দুর্বাশা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে। তবে যেহেতু পুরাণ কাহিনী তাই এই নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। আবার মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবলোক যখন ব্রহ্মার স্মরণে এসে জানতে পারলেন যে , ব্রহ্মার বরেই মহিষাসুর অপরাজেয় , ত্রিভুবনে কোনও পুরুষ তাকে বধ করতে পারবেন না, তখন সর্বদেবশরীরজ তেজ পুঞ্জ একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হলেন দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা । সকল দেবতার অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে দেবী দশভুজা রূপে অবতীর্ণা হলেন ।
এই হল, দেবীর মহিষাসুর মর্দিনী রূপের প্রকাশ কাহিনী। এবার যদি ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব , কখন, কোথায় প্রথম দুর্গাপূজো শুরু হয়েছিল–তা সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। এ বিষয়েও কিন্তু নানা মত প্রচলিত ।। তবে ইতিহাসের পাতা বলছে, ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল।।সিন্ধু সভ্যতায় দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা এবং পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। সেই প্রেক্ষিতে, দুর্গা, শিবের অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজিতা হতে পারেন। তবে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে দূর্গাপুজোর উল্লেখ আছে।।একাদশ শতকে মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’তে দুর্গা-বন্দনার সুত্র পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে, ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায়চৌধুরী পরিবারের হাত ধরেই প্রথম দূর্গাপুজার আয়োজন হয়েছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।।এরপর পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভা বাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দূর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আযোজন করেছিলেন বলেজানা যায়।বৃটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ও দূর্গাপুজো বিশেষ জনজোয়ার সৃষ্টি করেছিল বলে মনে করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা বাংলা এবং বাংলার সীমা ছাড়িয়ে সংস্কৃতি প্রিয় এবং প্রবাসীদের হাত ধরেই ভারতে এবং ভারতের বাইরের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।এরপর, ২০২২ সালে, UNESCO র “FESTIVAL WITH CULTURAL HERITAGE” তকমা পেয়ে, আমাদের “দূর্গাপুজো” আজ প্রকৃত অর্থেই “সার্বজনীন” ।।
SUPRIYO SENGUPTA (KARIGORI KOBIYAL)

দুর্গোৎসবের অন্যতম অংশ মহালয়ার দিন মহিষাসুরমর্দিনী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই চণ্ডী পাঠ, যা সম্পূর্ণ ইংলিশে অনুবাদ সহ বাচিক শিল্পীদের নিয়ে ইংলিশ মহালয়া আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য তৈরি করেছেন।
ইউটিউবe দেখুন।
www.karigorikobiyal.com
https://www.youtube.com/@KarigoriKobiyal
https://www.facebook.com/karigorikobiyal