অপ্রীতিকর প্রবণতা…
ড: ধীরেশ চৌধুরী, সমাজ সেবক, বার্ধক্য জনিত রোগ বিশেষজ্ঞ
আমি কোনো বুদ্ধিজীবী নই, না আমি কোনো সমাজের তথাকথিত মাথা। অতীব সাধারণ একজন নাগরিক। কিন্তু দেশ ও রাজ্যকে নিজের সামান্য ক্ষমতার মতন সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসি। তাই তার জন্য একটা আবেগ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এর মতন মানুষ আমার কাছে ঈশ্বরতুল্য। আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই, খুব সামান্য ই পড়েছি, জেনেছি তাঁকে। তাতেই মনে হয়েছে তিনি মহামানব। যদিও আমার সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা, ধৃষ্টতা মাত্র। ফলে একটা আবেগ তাঁর জন্য ও রয়েছে।
আর এই আবেগ আমার অধিকার। সেটা কোনো অবস্থাতেই কারোর কাছে বিলিয়ে দেবো না। সহজ কথায় বিক্রি যোগ্য নয়, ক্ষমতার কাছে ও নয়…
ভক্ত আর অন্ধ ভক্তর মধ্যে একটা সুক্ষতর পার্থক্য আছে, ব্যক্তিগত স্বার্থে সেটা অনেকেই ভুলে যান। আর অন্ধভক্ত আসলে সবচেয়ে বড় শত্রু, যদিও এটা বোঝেন কম মানুষ, আর যখন বোঝেন তখন অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।
এবার আসি যে প্রসঙ্গে এটা লেখা। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দিবস পালন নিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। হবারই কথা। শুনেছি দেশের অনেক রাজ্যের নাকি আলাদা দিবস রয়েছে। জানিনা এর তাৎপর্য কি? না থাকলেই বা কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়!, আমরা তো বর্তমানে একটা সার্বভৌম দেশের অংশ। প্রশাসনিক, ভাষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কারণের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত। তাহলে আলাদা করে প্রত্যেকটি রাজ্যের দিবস পালন কি সূক্ষ্ম ভাবে হলেও বিচ্ছিন্নতা বোধের জাগরণ ঘটায় না? এটা আমার প্রশ্ন মাত্র। প্রকৃত বিদ্বাজনরা এর সদুত্তর দিতে পারবেন। তাবেদাররা নন। মহামান্য রাজ্যপাল অবশ্যই সাংবিধানিক প্রধান, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ক্ষমতা বলে একটা রাজ্যের বিষয়ে কোনো রূপ আলোচনা ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন, যেখানে পুরো রাজ্যবাসীর আবেগ জড়িয়ে আছে। এমনকি তিনি নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। খুবই অপ্রীতিকর প্রবণতা। একেবারেই কাম্য নয়। তাছাড়া এত কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় থাকা সত্ত্বেও কেন হঠাৎ আপদকালীন ভাবে এবং হটকারী ভাবে এই মুহূর্তে সেভাবে অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে তৎপর হলেন সেটাও প্রশ্ন। যখন এটা নিয়ে একটা বিতর্ক বা দ্বন্দ সৃষ্টি হবে সেটা তাঁর জ্ঞাত।
আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বহু বিতর্কের ইন্ধন জোগাল। সেটাও কোনোভাবেই কাম্য ছিলো না। তবে হ্যাঁ তিনি অন্ততঃ আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেটা অবশ্যই সাধুবাদ যোগ্য। কিন্তু সেখানেও যে অনেক প্রকৃত বিদ্বজন মানুষ অনুপস্থিত। যাঁরা একটা নিরপেক্ষ আলোকপাত করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা হয় কোনো রাজনীতি করেন না, করলেও হয়তো মতাদর্শের বিরোধী বা চাটুক বা তাবেদার নন। এই সভায় বেশিরভাগ উপস্থিত মানুষ রাজ্য গীতি হিসেবে কবিগুরুর “বাংলার মাটি, বাংলার জল…” গানটিকে বেছে নিলেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু তারপরে মাননীয়া যে প্রস্তাব রাখলেন আশ্চর্যজনক ভাবে উপস্থিত বিদ্বজনেরা কি ভাবে সায় দিলেন সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। আগে পিছে সেভাবে কিছু না ভেবে মাননীয়া প্রস্তাব দিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটো শব্দ পরিবর্তনের!!!, ‘বাঙালি’ র পরিবর্তে ‘বাংলা’ করা। কারণ তাঁর যুক্তি কবির সময় বাংলা য় এত অন্য জাতির মানুষ ছিলেন না। জানিনা এই তথ্য উনি কোথায় পেলেন? স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আছি বলে একটা ছোট তথ্য দিতে পারি আমাদের গর্বের পিজি হাসপাতাল ও অন্যতম বাঙ্গুর হাসপাতাল দুটোই কিন্তু তথাকথিত অবাঙালিদের অবদান। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই মাননীয়ার যুক্তি, তবুও কি কোনো কবি বা লেখকের ব্যবহৃত কোনো শব্দকে তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে পাল্টানো যায়??? আর যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুমতি পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে তো কোনোদিন দাবি উঠবে জাতীয় সংগীতে সিন্ধু শব্দটাকে পাল্টে দেওয়ার। কিছু উগ্র গৈরিকবাদী মানুষজন তো শুনেছি সেই দাবি উঠিয়েছেন ইতিমধ্যে, এমনকি জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের!!! সেভাবে দেখলে তো অতুল প্রসাদ সেনের লেখা বিখ্যাত গান ‘হও ধরমেতে ধীর’ গানেও তেত্রিশ কোটি শব্দটাকেও পরিবর্তন করতে হয়। কিংবা ধরুন কবিরই সেই বিখ্যাত উক্তি বিশ্বকবি ‘বঙ্গমাতা’র শেষ দুই পঙ্ক্তিতে যা লিখে গেছিলেন – “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।”। অথবা শেখ মুজিবুর রহমানের সেই রক্ত গরম করা উক্তি তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, “…সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না…।”, এতেও তো পরিবর্তন আনতে হয় কারণ এখন তো বাঙালির সংখ্যা অনেক বেড়েছে তাই না?…এই প্রশ্নটা করছি তাঁদেরকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণী মানুষজনেরা যাঁরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। দু একজন মুষ্টিমেয় বাদ দিয়ে যার মধ্যে এস ইউ সি আই এর একজন প্রতিনিধি ছিলেন কেউ প্রতিবাদ করলেন না, নাকি করার সাহস পেলেন না!!! এরই মধ্যে তো একজন রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী কিছু অকাট্য যুক্তি ও দিয়ে দিলেন এর সপক্ষে…যাই হোক পরিশেষে মাননীয়া বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন বিষয়টি সর্বজন গ্রাহ্য হয়নি বলে স্থগিত রেখেছেন। ভালো লাগলো।
কিন্তু সেদিনের সেই বুদ্ধিজীবীরা অপ্রত্যক্ষ ভাবে যে বিষয়টিকে প্রায় স্বীকৃতি দিয়ে বসেছিলেন সেটা কিন্তু সাংঘাতিক। ভবিষ্যতে এর ফলাফল ও কিন্তু বিপদজনক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাকে পরিবর্তন করার ভাবনা যদি মাথায় আসে তাহলে ভাবতে পারছেন আমাদের মতন চুনোপুটিরও অধমদের লেখার কি গতি হতে পারে আগামীতে!!! কি বলবো একে? অপ্রীতিকর প্রবণতাতো বটেই। অপছন্দের, বিরোধের কোনো লেখা বা মন্তব্য হলেই সেটা যেকোনো মুহূর্তে বাদ বা এডিট হয়ে যেতে পারে এবং সেটাও আপনার অজ্ঞাতসারে। আমার মতন অত্যন্ত নিম্নমেধার একজন অতীব সাধারণ মানুষের এটা প্রশ্ন। ভুল হলে জানাবেন, সদর্থক সমালোচনার প্রত্যাশায় রইলাম।

যদি খুব প্রয়োজনই হয় কোনো রাজ্যগীতি তাহলে কবির উক্ত গানটি আমাদের নিজস্বতার জন্য খুবই গ্রহণযোগ্য, অবশ্যই কোনো পরিবর্তন ব্যতিরেকে। আরও একটি গান খুব প্রাসঙ্গিক শ্রদ্ধেয় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লেখা “আমি বাংলা য় গান গাই…”। শুনেছি প্রতুলবাবু মাননীয়ারও পছন্দের😊… দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, মনে করিয়ে দিলাম যেহেতু সভায় বিনা প্রতিবাদে এই ভুল উচ্চারিত হচ্ছিলো) “ধন ধান্য…” গানটি খুবই সুন্দর, আমার নিজেরও খুব প্রিয়, কিন্তু গানটি দেশের প্রেক্ষিতে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অগ্রিম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি এই সব উচ্চতর বিষয়ে মতামত জানবার জন্য। কিন্তু আবেগ তো আর এসব মানেনা…
©ডাঃ ধীরেশ।
১৬ই ভাদ্র, ১৪২৩। ২রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩