আমারও আছে দায়!
ডাক্তার ধীরেশ চৌধুরী
লিখতে যাচ্ছি
বারবার হাতটা টেনে ধরছে,
কানের কাছে কে যেন বলছে
আবার আঁতলামি দাদাভাই?
কিছু শব্দ চয়ন করে
গুছিয়ে লিখে তোমার দায়িত্ব শেষ!
আর তাতে মন্তব্য করে আরও কিছু
মানুষ লিখবে বেশ বেশ,
কিন্তু আদৌ হবে কি এখানেই এসবের শেষ…
রাষ্ট্র পড়তে দিয়েছে তাই না কতো!
দোষটা তো আমারই,
বসতে দিলে চেয়েছি শুতে।
ডিউটিতে বিশ্রাম!
শিখিনি কেন?
প্রকৃতির ডাক এলে বলতে এখন থাম,
খালি সেমিনার রুম মানেই
কেন ভেবেছি ফাঁকা?
অদৃশ্য কিছু পোষা জানোয়ার ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র
সেটা না জেনে বনেছি বড্ড বোকা,
তাইতো খেয়েছি আমি ধোঁকা!
এখানে রাষ্ট্রের কোথায় দোষ?
আমিই দোষী,
এসব হতেই পারে, আমারই হয়নি সে হোশ…
আবার কলমের ঢাকনিটা খুলেছি মাত্র,
ফিসফিস করে কে যেন বললো আবার,
প্লীজ দাদাভাই তুমি হয়োনা সেই বুদ্ধিজীবীর গোত্র
পারলে মোমবাতির মিছিল গুলোকে আটকাও।
এবারে একটু শান্তিতে আমাকে ঘুমাতে দাও,
সেই উচ্চ মাধ্যমিকের পর থেকে
অনেকদিন ঘুমাইনি এত আরামে,
পারলে মিডিয়া গুলোকে এবার থামাও,
আমার শেষ মুহূর্ত গুলোর অবিরাম ব্রেকিং নিউজের চিলচিৎকার বিবরণে।
ঘুমটা এখানেও ভেঙে যাচ্ছে আমার বারবার,
যন্ত্রণা, বন্ধ হয়ে যাওয়া দম আর অব্যক্ত এক কোঁকড়ানো শরমে…
শুনছি উঠেছে প্রস্তাব,
আর জি করের কোনো একটা ব্লকের
নামকরণ হবে নাকি আমার নামে!
প্লীজ দাদাভাই আটকাও এইসব ন্যাকামো,
বরং দাবি তোলো
যাতে বাধ্য হয় ওরা ভাবতে,
কি করে আটকাবে এসব অসভ্য ব্যামো।
দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ গুলোতে
লিঙ্গ নির্বিশেষে যতদিন না
গড়ে উঠবে নুন্যতম শিক্ষার পরিবেশ ও সুরক্ষা বলয়,
ততদিন জেনো আমারও চলতে থাকবে রক্তক্ষয়…
কলম থামিয়ে দিয়েছি আমি,
বয়সে অনেক বড় হয়েও
তোর কাছে ক্ষমা চাইছি বোন,
এই পরিণতিতে আমারও যে আছে দায়!
গড়তে পারিনি একটা সুস্থ সমাজ আর বাতাবরণ,
যেখানে আমার সব ভাই বোনেরা পড়তে আসতে পারে
এক সুনিশ্চিত ভরসায়…
© ডাঃ ধীরেশ।
২৫শে শ্রাবণ, ১৪৩১।
অগ্রিম মাপ করবেন একটি কথা বলার জন্য, এই ঘটনা ঘটতে পারতো আরও বহুবার। ঘটেনি সেটা সবার জন্যই সৌভাগ্য বলতে হবে। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে আমরাও যখন ডাক্তারির ছাত্র ছিলাম তখন বা বলা চলে তার আগে থেকেই একই অবস্থা। রাত্রিকালীন সে অর্থে কোন নিরাপত্তা ছিল না। বিশেষ করে মহিলা সহপাঠিনীদের জন্য। ইন্টার্ন, হাউজ স্টাফ বা পিজিটিদের ছিলো না কোনো সঠিক শৌচাগার, এত টুকু বিশ্রামের জায়গা। টানা ৩৬/৪৮ ঘণ্টা একটানা ডিউটি টাইমে একটু বিশ্রাম, এটা কি অন্যায় চাওয়া? আমাদের ভেগাবন্ডদের মতন ঘুরতে হতো, যদি কোথাও এতটুকু জায়গা মেলে!!!, মহিলাদের প্রকৃতিগত কত অসুবিধা থাকে, সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। হোস্টেল গুলোর ও তথৈবচ অবস্থা, বিশেষ করে পুরুষদের। ভাঙ্গাচোরা, শৌচাগারের দরজাও ভাঙ্গা। সরকারী হোস্টেল হাতে গোনা, প্রাইভেট হোস্টেল গুলোও একই, অনেক জায়গায় আরও খারাপ। খাবারের কথা না বলাই ভালো। ভাগ্যিস ডে স্কলার ছিলাম, তাই ভুগতে হয়নি অন্তত হোস্টেলে থাকার এই চরম কষ্ট। হাসপাতাল, কলেজ বেড়েছে অনেক, কিন্তু এসবের দিকে নজর দেননি কেউই। অবস্থা যে করুণ থেকে করুণতর হয়েছে বর্তমানে ঘটনা সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরাও আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি। নিজেদের পড়া শেষ হয়ে গেছে, তারপর আর ভেবেছি কোথায়!!! পরের কথা ভাববার অবকাশই বা কোথায়? আমি নিজেও এর দায় এড়াতে পারিনা। যদি সবাই ভাবতাম আজ এই পরিণতি হতো না। সরকার বা কর্তৃপক্ষেরও এত সাহস হতো না এতটা উন্নাসিক থাকার বা অবহেলা করার। ভাববেন না এই ঘটনা শুধুমাত্র আর জি করের, এটা প্রায় সব জায়গার ই। এমনকি দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান এইমস এর মতন জায়গাতেও বহু ছাত্রছাত্রীকে হোস্টেলে জায়গা দিতে পারেনা। ফলে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেও বাইরে পিজি তে থাকতে হয়। এমনকি মেয়েদেরকেও। আমার নিকট আত্মীয়ের ক্ষেত্রেই হয়েছে। ব্যাঙ্গালোরের আই আই এস সি র মতন প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীরা হোস্টেল পাচ্ছে না। অর্থাৎ রাজ্য হোক আর দেশ হোক একই অবস্থা। শাসকদের ভাবখানা এমন পড়তে দিচ্ছি এই না যথেষ্ট! এসবের আবার দাবি বা চাহিদা কেন? নিজেদেরটা নিজেরা ব্যবস্থা করে নাও। পারলে থাকো, না হলে ফোটো…অশিক্ষিত এমপি, এম এল এ দের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য রাষ্ট্রের সর্ব প্রথম দায়িত্ব। তোমরা হলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাই এই ঘটনা কি খুব অস্বাভাবিক!!!, না বোধহয়…
নিবন্ধহকার বিষিত চিকিৎসক ও সমাজ কর্মী। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী থেকে বহিবকবিতা, চিকিৎসা বিষয়ক লেখা ও অভিমত ভারত তথা বিশ্বে সমাদৃত। বার্ধক্য জনিত রোগের বিশেষজ্ঞদের এসোসিয়েশনের সম্মানিত পরিচালক মন্ডলীর সদস্য।