আমার কাছে যা আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন –
by ড: ধীরেশ চৌধুরী
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে গেলে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক ভালো থাকাও ভীষণ রকমের জরুরি। বর্তমানে ওষুধের থেকেও বেশি করে জোর দেওয়া হচ্ছে অন্য উপায় অবলম্বন করে ভালো থাকার প্রচেষ্টা। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় Non Pharmacological Interventions। এই ভালো থাকার ক্ষেত্রে বর্তমানে আরও একটি বিষয়কেও খুব গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে। যাকে বলা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন অর্থাৎ Spiritual Practice। আমরা বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। মনে করি যে ধর্মীয় আচার সর্বস্ব রীতি নীতি অনুসরণ করলেই বোধহয় ঈশ্বর সাধনা হয়। আর সেটা করতে গিয়ে নিয়মের কঠোরতায় অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়, অনেক ক্ষেত্রেই আবার কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে মানসিক সংকীর্ণতা গেড়ে বসে। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন জীবনে আনে উদারতা, নিষ্কলুষতা, স্বচ্ছতা আর সর্বোপরি মানুষের সাথে একাত্মতা।
ব্যক্তিগত ভাবে আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি আমার কাছে খুব আবছা। কি উপায়ে তাকে অনুশীলন করা যায় সেটার বিষয়ে খুব যে স্বচ্ছ ধারণা আছে সেটা একেবারেই নয়। ধ্যান, যোগা এসব এই অনুশীলনের উপায় সেটা শুনেছি। আমার সে সব কিছু করা হয়ে ওঠেনি। তবে এটুকু অনুভব করি যে এসবের বাইরেও কিছু বিশেষ স্থান, কিছু বিশেষ মানুষ, কিছু বিশেষ সঙ্গীত, কৃষ্টি, সৃষ্টি আর কিছু বিশেষ মুহূর্তের বা বলা ভালো কিছু উদ্যোগ বা অনুষ্ঠানের সান্নিধ্য হৃদয় ও মানসিকতাকে উত্তরণ বা উৎসারিত করে এক মহৎ বা ভালোর দিকে। আর সেটাই আমার কাছে আধ্যাত্মিকতা।
এরকমই এক বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী থাকলাম গত রবিবার। যাঁর রূপকার তিনিও আমার কাছে এক আধ্যাত্মিক মানুষ, বিশিষ্ট নৃত্য শিল্পী ও সমাজ সংস্কারক বা Social Reformer শ্রীমতি অলকানন্দা রায়। যাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় বেশ কিছু বছরের। ৭৪ বছর বয়সে তাঁর পরিচালনায় এবং অভিনয়ে গত ১৭ তারিখে রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠিত হলো ১০০ তম গীতিনাট্য”বাল্মীকি প্রতিভা” র পরিবেশন। অনেকেই নিশ্চিত জানেন এই প্রোডাকশনটি আলিপুর সহ রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারের বন্দীদের দিয়ে। ওনার থেকেই জানা গেল প্রথম দিকে অভিনয় করা অনেকেই এখন মুক্ত। তাই বেশিরভাগ নতুনদের নিয়ে এবারের পরিবেশন। পুরুষ ও মহিলা উভয় বন্দীদের যে কি অসাধারণ পরিবেশন সেটা চাক্ষুষ না দেখলে বলে বোঝানো অসম্ভব। আনকোরা এই সব বন্দীদের দিয়ে বাল্মীকি প্রতিভা র মতন পরিবেশন কতটা অধ্যাবসায়, ধৈর্য্য লাগে সেটা বোধহয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখেনা। এমনিতেই রবি ঠাকুর বাল্মীকি চরিত্রের মধ্যে যে উত্তরণ দেখিয়েছেন সেটাই আধ্যাত্মিকতা, আর তাকে সুনিপুণ আর সুচারু ভাবে পরিবেশন সেটাও আমার কাছে আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন। আমি নিশ্চিত এই পরিবেশন করতে গিয়ে কিছু কারণে কোনো ভুল করে বসা ওই বন্দীদের মনে অনুশোচনা জাগরিত হয়েছে, উত্তরণ ঘটেছে মানসিকতায়। তাঁরা এখন সত্যিকারের সংশোধিত। আর যে ব্যতিক্রমী উপায়ে তাঁদের এই সংশোধন করার প্রচেষ্টা সেটাকে কোন মূল্যায়ন করা আমার কাছে ধৃষ্টতা। আর সেই ব্যতিক্রমী কাজের জন্যই সততই সমাজ সংস্কারক অলকানন্দা ম্যাডাম। যিনি আমাদের কাছে অনুপ্রেরণাদাত্রী, পথ প্রদর্শক, জীবনকে উপভোগ করার দিশারী। আর সেই কারণেই তিনি আর তাঁর ব্যতিক্রমী পুরো প্রয়াসটাই আমার কাছে আধ্যাত্মিকতা আর তাঁদের সান্নিধ্য হলো আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন। তাঁর মতন মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় নিশ্চিত জীবনের পরম প্রাপ্তি গুলোর একটি। আর এরকম মানুষ যখন এই অধমের লেখা গুলো পড়েন আর অনুপ্রাণিত করেন সেটাকে মহার্ঘ্য প্রাপ্তি ছাড়া কিই বা বলা চলে!
সেদিন পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে দেখা করতে পারিনি। ফোন করেছিলাম কৃতজ্ঞতা জানাতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। সেই সময় ধরতে পারেননি। কিন্তু পরের দিনই ফোন ব্যাক করেছেন। এটাই শেখার। মানুষকে সম্মান জানানো। একটা উচ্চতায় পৌঁছনোর পরেও অতি সাধারণ।
ভালো থাকবেন ম্যাডাম আর ভালো রাখবেন। আপনাদের সান্নিধ্যে আরও আধ্যাত্মিক অনুশীলন করতে চাই, একটু ভালো থাকতে…
লিঙ্কটি শেয়ার করলাম কিছু মুহূর্তকে অনুভব করার জন্য…https://www.facebook.com/share/v/yXKdV2S6dxnzh9NQ/
© ডাঃ ধীরেশ চৌধুরী প্রথিতযশা জেরিয়েটিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং বাঁচবো সামাজিক সংস্থার প্রাণপুরুষ। অসংখ্য শিশু অসহায় বৃদ্ধ মানুষের প্রয়োজনে পাশে থাকা ডাক্তার বাবু কবি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি।