আধুনিক প্রাণদায়ী চিকিৎসা হলেও অনেকক্ষেত্রেই কেনো সাপে কামড়ানো রোগীরা মারা যান ?
এম রাজশেখর (৪ নভেম্বর ‘১৯):- সম্প্রতি অনুপ ঘোষ-এর মৃত্যু বাঙালী তথা ভারতীয় জনগণের মধ্যে একটা আলোড়ন তুলেছে। তাঁদের একটাই কৌতূহল, ওঝা-গুণীন বা হাতুড়ে চিকিৎসক নয় বরং প্রথম থেকেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে আনা হলেও সাপে কামড়ানো রোগী রূপে অনুপবাবু মারা গেলেন কীভাবে!
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, গত ৩১ সেপ্টেম্বর ব্যারাকপুর নাপিতপাড়া নিবাসী অনুপ ঘোষ হালিশহরের হাজিনগর অঞ্চলের এক বাড়ি থেকে চন্দ্রবোড়া সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে সেই সাপের কামড়েই আহত হন ও পরে মারা যান।
এখন রাজ্যের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ কৌতূহল বশতঃ একযোগে জানতে চাইছেন-
অনুপবাবুকে তো কোনো সাপের ওঝা দেখেননি, যে তিনি সময় মতো আধুনিক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন; তাহলে তাঁর মৃত্যুর পেছনে আসল রহস্য কী !
এই আসল রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে যে তথ্য সামনে উঠে আসছে সেটাও বাঙালীদের মাথাব্যথা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।
বিভিন্ন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, “এই মুহুর্তে কাউকে সাপে কামড়ালে ওষুধ রূপে পশ্চিমবঙ্গে যে এন্টি ভেনম সিরাম (এভিএস) দেওয়া হয় তা আসে দক্ষিণ ভারত থেকে।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পর্যবক্ষেণে জানা গেছে, অঞ্চল ভিত্তিতে একই প্রজাতি বা গোত্র সম্পন্ন সাপের আকার-আয়তন ও বর্ণের যেমন তারতম্য ঘটে তেমনই তার বিষের রাসায়নিক গঠনেরও বিস্তর তারতম্য ঘটে।
আর এই কারণে দক্ষিণ ভারতে জন্মানো ও বিচরণরত এক চন্দ্রবোড়া সাপের বিষের সাথে পশ্চিমবঙ্গের বুকে জন্মানো ও বিচরণরত সাপের বিষের মধ্যে যথেষ্ট রাসায়নিক পার্থক্য দেখা যায়।
এই মুহুর্তে দক্ষিণ ভারতে জন্মানো ও বিচরণরত কোনো সাপের বিষ সংগ্রহ করে সেই বিষ থেকে যখন কোনো এভিএস তৈরী হচ্ছে, তখন সেই এভিএস দক্ষিণ ভারতে সাপের বিষের প্রতিষেধক রূপে যতটা সফল হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে এসে বৈজ্ঞানিক কারণে ঠিক ততটাই অসফল বা ব্যর্থ হচ্ছে।”
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক সমাজের একাংশের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারক সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী যে কোনো ধরণের বিষাক্ত সাপে কামড়ানো রোগীকে সুস্থ করার জন্য ১০ ভায়াল এভিএস সব সময়ের জন্যই যথেষ্ট।’
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ সাপে কামড়ানো রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে তাঁদের উপর ১০ ভায়াল এভিএস কোনো কাজই করছেনা, তাই সীমা বাড়িয়ে বেশিরভাগ সময়ই তা ৩০ থেকে ৪০ ভায়াল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে, কিন্তু তার পরেও ক্ষেত্রবিশেষে রোগীকে বাঁচাতে ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষিত চিকিৎসককুল।
যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘এভিএস বানাতে হবে সব সময় স্থানীয় অঞ্চলে বসবাস বা বিচরণরত সাপের বিষ দিয়ে, নাহলে সেই প্রতিষেধক হয় কম কাজ করবে বা মোটেও কাজ করবে না,’ তাই বৈজ্ঞানিক কারণেই দক্ষিণ ভারতে তৈরী সাপের বিষের প্রতিষেধক ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সেভাবে সফলতার মুখ দেখতে পারছেনা বা বলা যেতে পারে মুখ থুবড়ে পড়ছে।
আর ঠিক এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক সমাজ আবারো আওয়াজ তুলেছেন, “সাপে কামড়ানো পশ্চিমবঙ্গের রোগীদের তাড়াতাড়ি সুস্থ করতে হলে বা প্রাণদান করতে হলে অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গের বুকেই সাপে কামড়ানো রোগীদের জন্য প্রতিষেধক বানাতে হবে।”
আর এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আলোকে বলা যেতেই পারে দক্ষিণ ভারতে যেমন সাপের বিষের প্রতিষেধক বানাবার সংস্থা বানানো হয়েছে ঠিক তেমনই সংস্থা ভারতে উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তেও তৈরী হওয়াটা খুবই জরুরী, অন্যথায় মৃত্যু মিছিল বাড়তেই থাকবে।
মজার বিষয়ে, ২০১২ সালে দেশের ভেতর পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম সাপের কামড়ের আদর্শ চিকিৎসা বিধি তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেটাই ২০১৭ সালে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় আদর্শ চিকিৎসা বিধি হিসেবে গৃহীত হয়।
কিন্তু তার পরেও গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলা সরকার ও ততোধিক নির্বোধ সরকারী আমলাদের অপদার্থতায় আজও সাপে কামড়ানো রোগী সরকার তথা দেশবাসীর কাছে মাথা ব্যথার এক কারণ হয়েই রয়ে গেলো।