প্রশাসনিক উদাসীনতায় পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে শাকসব্জী
এম রাজশেখর (১৫ নভেম্বর ‘১৯):- রাজ্য প্রশাসনের মাত্রাতিরিক্ত উদাসীনতা তথা নিষ্ক্রিয়তায় রাজ্যে শাকসব্জীর বিক্রয় মূল্য কয়েক মাসের মধ্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেল।
শীতের প্রাক্কালে যেখানে রাজ্যের সব্জীবাজারগুলো তাজা আনাজে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, বাজারে যোগান বৃদ্ধির কারণে যেখানে আনাজের দাম সহনশীল মাত্রার থেকেও কম থাকার কথা, সেখানে এখন বাজারে গিয়ে যে কোনো সব্জীর দাম শুনলেই হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছে।
আলু ২০-২২ টাকার নীচে নেই, মূলো তাও নাকি ৩৫ টাকা কেজি.. না বাজারের দাম জানানোর জন্য এই লেখা নয়, এই লেখার মূল কারণ জনগণের সামনে কতগুলো তথ্য তুলে ধরা।
যে কোনো লোকই জানেন, গরমকালে কালবৈশাখী হলে পরের কয়েকদিন বাজারে অন্ততঃ কাঁচা আম জলের দরে বিক্রি হয়, বর্ষাকালে পুকুর ভেসে গেলে মাছ বেশ সস্তা হয়ে ওঠে।
এই একই সূত্র অনুসরণ করলে, ‘বুলবুল’-এর পর বাজারে অন্ততঃ থোঁড়, মোচা তো সস্তা হওয়া উচিত ছিল (মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাপক বিপর্যয় হয়েছে ধ্বংস হয়েছে কলাবাগান, কচুবন, ধানজমি, ফুলের বাগিচা..)।
কিন্তু দেখা গেছে কোলকাতার বাজার তো অনেক পরের কথা- পাথরপ্রতিমা, সাগর, বকখালি এমনকি পূর্ব মেদিনীপুরের স্থানীয় বাজারগুলোতেও ‘বুলবুল’-এর পরের কয়েকদিন অন্ততঃ থোঁড়, মোচা, ডুমুর-এর দাম এক টাকাও কমেনি।
প্রশ্ন, তাহলে কাদের অনুপ্রেরণা ও প্ররোচনায় সব্জীবিক্রেতারা অন্ততঃ এই সব্জীগুলো সুলভ মূল্যে বিক্রি করতে পারলেননা।
দুর্গাপুজোর সময় সাধারণ কৃষকেরা বলছিলেন, “পুজোর মুখে অনেকেই বেশি লাভের জন্য অপরিপুষ্ট ফুলকপি বিক্রি করেন কিছু বেশি লাভের আশায়।
কিন্তু পুজোর আগে আচমকা এসে যাওয়া বর্ষা আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। অনেক কপি মাঠেই নষ্ট হয়েছে।”
ভালো কথা, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, যেখানে কচি কচি ফুলকপি তখন বাজারে অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে, তখন কোনো কৃষকই কী জেনেবুঝে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত ওই ফুলকপি বাজারে না নিয়ে এসে মাঠে পচাতে চাইবেন ?
সরল উত্তর, কখনোই নয়। আর এই বৃষ্টিস্নাত কচি ফুলকপিগুলো একযোগে বাজারে এসে গেলে পুজোর সময় বাজারে কী একেকটা কচি ফুলকপি ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হতে পারতো, না দাম কমে ১০ থেকে ১৫ টাকায় চলে আসত !
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সরকারী তথ্য ও কৃষকদের দেওয়া তথ্যের মধ্যে যথেষ্ট তঞ্চকতা রয়েছে।
এর পরেও আরো কিছু জটিল প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কথা বাদও দিই, তার পরেও থেকে যায় ‘শস্য বর্ষ’ ও আবহাওয়ার কথা।
আবহাওয়ার অতীত ইতিহাস বলছে পুজোর মুখে এরকম বৃষ্টি হওয়াটাই একসময় স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
যাঁরা এইসময় আবহাওয়া দফতর বা নবান্ন-র উচ্চপদে কর্মরত তাঁরাও স্মৃতিচারণ করে বলছেন, “আমাদের ছোটোবেলায় পুজোর আগে ফি বছরই এরকম বর্ষা হতো। আর এটাই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বর্ষার কারণে কখনোই বাজারে এরকম আগুন লাগত না।”
আলুর দাম কেজিপ্রতি ২২ টাকা হওয়ার পর যদি কৃষক কেজিপ্রতি ১৮ টাকা দাম পেতেন, তাহলে বলার কিছুই থাকত না।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আলুচাষি তো কেজিপ্রতি ৮ টাকাও পাচ্ছেননা। তাহলে বাজার এভাবে নাগালের বাইরে যাচ্ছে কেনো ?
কেন্দ্রীয় সরকার হোক বা প্রাদেশিক সরকার সবারই এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ইডি) বলে একটা দফতর থাকে, এই ধরণের প্রতারণার বিরুদ্ধে আইনী কার্যকলাপ করাই তাদের একমাত্র কাজ। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জনগণের করের টাকায় বেতন পাওয়া এই বিভাগের আধিকারিক ও কর্মীরা এখন কী করছেন ?
এর পরেও মজার বিষয় এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যা ৮ কোটির আশেপাশে। অর্থাৎ এই ৮ কোটি জনগণই শাকসব্জী বাজারের আগুনে রোজ দগ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের এই জ্বলন্ত সমস্যার উপর কোনোরকম বিক্ষোভ প্রদর্শন না করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ‘ডেঙ্গু’, ‘সমকাজে সমবেতন’, ‘কর্মে স্থায়ীকরণ’, ‘রাজনৈতিক হানাহানি’-র মতো বিষয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়ে জনগণের নজরকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন।
স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা আসে, তবে কি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের সময় ব্যবসায়ীদের ঘাড় মটকে অধিক অর্থ লাভের আশায় এখন সব্জী ব্যবসায়ীদের অনৈতিকভাবে লাভের সুযোগ করে দিচ্ছে রাজ্যের সবকটা রাজনৈতিক দল!