ইন্দ্রাণী র স্কুলের গেটে নজর রেখে রাস্তার ওপারের একটি দোকানের বেঞ্চে চা নিয়ে বসলাম। ছুটির পনেরো মিনিট পরে আশুতোষ চৌধুরী র মেয়ে ইন্দ্রাণী স্কুল থেকে বেড়িয়ে অলকা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়ালো। আজকে নিয়ে তিনদিন মেয়েটির ওপর ওর বাবার কথামতো লক্ষ্য রাখছি। গত দুদিন তেমন কিছু আমার নজরে আসেনি। ১৫ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন যেমনটা হওয়া উচিত তেমনই। তবে অন্যান্য দিনের সাথে আজকের দিনের পার্থক্য হলো আজ ইন্দ্রাণী র সাথে তার কোনো বান্ধবী নেই। স্কুল ড্রেস পরে মেয়েটি তার মোবাইল ফোন বের করলো। স্কুলে মোবাইল আনা নিষেধ। তারমানে মেয়েটি লুকিয়ে নিজের ফোন স্কুলে এনেছে। ফোনে দুই থেকে তিন মিনিট কথা বলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলো রাস্তার ওপরে। চা শেষ করে আমি ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়েছি। চায়ের বিল মিটিয়েছি আগেই। কারন কখন আর কতো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তা জানা নেই। আরও দশ মিনিট পরে একটি বাইক এসে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। আরোহীর মাথায় হেলমেট, পরনে টি -শার্ট, ট্রাউজার, পায়ে সাদা জুতো। চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ কুড়ি -বাইশ।ছেলেটি একটা কালো রঙের হেলমেট এগিয়ে দিলো।কোনো কথা না বলে ইন্দ্রাণী
হেলমেটটি পরে বাইকে উঠলো। আমিও ততক্ষণে আমার বাইকে স্টার্ট দিয়েছি। বারো ভুতের মাঠের পাশ দিয়ে ইন্দ্রাণীদের বাইক ছুটে চললো রানিকুঠির দিকে,পেছনে একটু দুরত্বে আমি। রানিকুঠির মোরের বাম দিক দিয়ে বাইক ঢুকলো কুদঘাটের দিকে। মেট্রো স্টেশনের পেছন দিকে রেলিং এর পাশে বাইকটা দাঁড়ালো।প্রথমে ইন্দ্রাণী তারপর আরোহী দুজনেই নামলো। হেলমেট দুটো বাইকের সাথে আটকে পাশের একটা চাউমিনের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো। আমিও বাইক রেখে সেই দোকানের দিকে এগোলাম।
- চিকেন চাউ আছে?
ছেলেটি দোকানদারকে প্রশ্ন করলো। - আছে। ক প্লেট?
-চিকেন হালাল তো?
এই প্রশ্নটা শুনে আমি একটু চমকে গেলাম।মানে ছেলেটি মুসলিম। এবারে ভালোভাবে ছেলেটিকে দেখলাম। চেহারার মধ্যে একটি উগ্রভাব প্রথম থেকেই দেখছি এবারে চাপ দাড়ি আর অতিরিক্ত ফর্সা রঙের মুখটা ভালো করে দেখলাম। কিছু একটা ছিলো যা আমার ভালো লাগলো না।
- সব জায়গায় এই প্রশ্ন করতেই হবে? – ইন্দ্রাণী একটু বিরক্ত।
- কেনো, তোমার সমস্যা কি সোনা?
দোকানদার এবং আরও দু চারজন লোকের সামনে এই সোনা ডাকটা যেমন আমার কানে লাগলো তেমনি একটি পনেরো বছরের কিশোরীর কাছেও মনে হলো বিরক্তির কারন হলো। কোনো কথা না বলে ইন্দ্রাণী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করছিলাম ছেলেটি অহেতুক বিনা কারনে মেয়েটিকে স্পর্শ করছিলো এবং ইন্দ্রাণী র কাছে সেটাও বিরক্তির কারন হচ্ছে।
চাউ এর প্লেট দুটো নিয়ে তারা মেট্রোর সিড়ির কাছে গেলো।আর আমি আমার চিকেন পকোড়া র বিল মিটিয়ে বাইকে স্টার্ট দিলাম অবশ্য তার আগে ছেলেটির বাইকের নং নোট করে নিয়েছি আর আমার স্পাই ক্যামেরা তুলে নিয়েছে ছেলেটির ফটো।
যাদবপুর থানার ভেতরে একটি চায়ের দোকানে আমি, ইন্দ্রাণী র বাবা আশুতোষ চৌধুরী মা নীলিমা দেবী আর সাব ইনস্পেকটর রথীন বাবু।
- আপনার সন্দেহটা কবে থেকে হলো আশুতোষ বাবু? প্রশ্নটা করলেন পোড় খাওয়া পুলিশ অফিসার রথীন চ্যাটার্জি। ইন্দ্রাণী তখনও মায়ের কাধে মাথা রেখে ফোপাঁচ্ছে।
- গতো মাস থেকে মেয়ের চালচলন, আবভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি। একটা হাসিখুশি সহজ সরল মেয়ে হঠাৎ করে চুপচাপ গোমড়া মুখ। চট করে মেজাজ হারিয়ে ফেলে মায়ের মুখে কথা, সবসময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, বাথরুমে গেলেও মোবাইল নিয়ে যাচ্ছে, রিং বাজলে দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরে ঘরে ঢুকে পরছে। এসব আমার আর ইন্দ্রাণী র মায়ের কাছে বেশ সন্দেহজনক মনে হয়। তখন আমারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি কি করা যায়। “জীবক থার্ড আই” নামটা আমি আগেও শুনেছি। ইন্টারনেটে সার্চ করে ফোন নং জোগাড় করি। কথা বলে বেশ ভালো লাগে। তারপর চক্রবর্তী বাবু ( মানে আমার কথা) আসেন। ওনার সাথে আলোচনা করে ওনাকে মেয়ের ওপর লক্ষ্য রাখার জন্যে নিয়োগ করি। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম এই ভেবে যে এই ব্যক্তিগত তদন্ত মুলক কাজ বৈধ কিনা। পরে আমার উকিলবাবুর সাথে কথা বলে আর IBG News এর “জীবক থার্ড আই ” থেকে জানতে পারি ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে অনুসন্ধানের কাজে নিয়োগ করা বৈধ। বিশেষ করে আরও ভরসা পাই যখন জানতে পারি “জীবক থার্ড আই” এর অনুসন্ধানী টিমের প্রত্যেকে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট। ব্যাস আমার আর কোনো সংশয় থাকলো না।
এই বলে আশুতোষ বাবু চায়ের ভাড় হতে তুলে নিলেন।
- তারপর কি হলো মিস্টার চক্রবর্তী? চ্যাটার্জি বাবুর প্রশ্ন এবার আমার দিকে।
-তদন্তের কাজ শেষ করে সাকিবের মানে ছেলেটির নাম ফোন নং গাড়ির নং আশুতোষ বাবু র হাতে তুলে দেই। বাইকের নং থেকে ছেলেটির ঠিকানা তার বাবার নাম পেয়েছিলাম। কপাল ভালো নিজের বাবার বাইক নিয়েই এসেছিলো। সব শুনে আশুতোষ বাবু আর নিলীমা দেবী দুজনেই খুব হতাশ হয়ে যান। বুঝতে পারছিলাম আজ ইন্দ্রাণী আসার পরে শাসনের মাত্রা অতিরিক্ত হতে পারে। তাই সাজেশনটা আমিই দেই।
আমি এনাদের বলি আপনারা খুব ভালোভাবে বলবেন যে আপনারা সব জানতে পেরেছেন এবং ছেলেটির সাথে কালকে ওনারা কথা বলতে চান।আমার খুব ধারণা ছিলো ছেলেটি আসবে না কারন তার মধ্যে আমি ধূর্ততা দেখেছি। ওনারা আমার পরামর্শ মতো তাই করেন। ইন্দ্রাণী প্রথমে স্বীকার করেনি তারপর চেলেটির ফটো,বাইক এর নং, তারা আজ কোথায় গেছে সব বলার পর স্বীকার করে।আশুতোষ বাবু সাথে সাথে আমাকে ফোন করে পরেরদিন তাদের বাড়িতে বিকেলে ডাকেন। ছেলেটি যখন আসবে তখন যেন আমিও সেখানে উপস্থিত থাকি।কিন্তু তখনও আমি জানতাম ছেলেটি আসবে না। কিন্তু যেটা আমরা জানতে পারিনি তা হলো বিষয় কতটা গম্ভীর।
আশুতোষ বাবুর বাড়ি যখন ঢুকলাম ঘড়িতে তখন বিকেল সারে চারটে। ইন্দ্রাণী র স্কুল ছুটি হয় বিকেল চারটে। ছেলেটিকে নিয়ে নিশ্চয় এতক্ষণে সে বাড়ি এসেছে। বাড়ির কলিং বেল বাজানোর একটু পরেই কাজের লোক দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকে আমি বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পরলাম। আশুতোষ বাবু কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন আর নিলীমা দেবী পাথরের মূর্তির মতো বিছানায় বসে।
- কি ব্যপার চৌধুরী বাবু anything wrong?
- আমাদের সর্বনাশ হয়েছে চক্রবর্তী বাবু।
গলা যথেষ্ট কাপছে আশুতোষ বাবুর। নিলীমা দেবী পাথর। - ইন্দ্রাণী কোথায়?
- ঘরে।
যাক ইন্দ্রাণী সুস্থভাবে ফিরে এসেছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।
আশুতোষ বাবু তারপর ধীরে ধীরে যা বললেন তার মানে দাঁড়ায় এরকম-
ফেসবুক থেকে ইন্দ্রাণী র সাথে ছেলেটির পরিচয়।নিজের নাম শুধু রাজু বলে পরিচয় দিয়েছিলো।ইন্দ্রাণী বুঝতে পারেনি যে, ছেলেটি মুসলিম ।তারপর যখন জানতে পারে ততদিনে ফোনে চ্যাটিং, কিছু ব্যক্তিগত ছবি এসব দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছে। ইন্দ্রাণী ছেড়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং। একা অনেকবার স্কুল থেকে বেড়িয়ে কোথাও একটা নিয়ে যেতেও চেয়েছিলো কিন্তু ইন্দ্রাণী যাইনি। বহুবার ইন্দ্রাণী র কাছ থেকে টাকাও নিয়েছে এমনকি ইন্দ্রাণী কে কয়েকবার বাবার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরিও করতে হয়েছে কিন্তু আশুতোষ বাবু টাকা গুনে না রাখার জন্যে বুঝতে পারেনি। তারপর আজ তার বাড়িতে আসার কথা যখন ইন্দ্রাণী বলে তখন ছেলেটি ইন্দ্রাণী কে বাইক থেকে নামতে বলে বাঘা যতীন বাজারের মধ্যে দিয়ে ফুল স্পীডে ছুটে বেড়িয়ে যায়।
- তা এতে আপনারা এতো ভেংগে পরছেন কেনো? এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। বরং বলুন খুব অল্পের জন্যে আমরা আমাদের মেয়েটিকে বড়ো ক্ষতির হাত থেকে বাচিয়েছি। তাই না?
- বলছেন?
- হ্যা বলছি তবে আমাদের আরেকটা কর্তব্য করতে হবে।
- কি বলুন?
- একবার থানায় গিয়ে একটা এফ আই আর করতে হবে। গাড়ির নং আর ছেলেটির ঠিকানা দিয়ে।
-এটা করা কি ঠিক হবে চক্রবর্তী বাবু? - অবশ্যই হবে। ছেলেটিকে ধরতে হবে। ইন্দ্রাণী র জন্যে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ের যাতে ক্ষতি করতে না পারে তারজন্যে আমাদের এই স্টেপ নিতেই হবে আশুতোষ বাবু।
সব শুনে চ্যাটার্জি বাবু বললেন,
- হুম বুঝলাম। ঠিক আছে আপনারা আপনাদের কাজ করেছেন এবারে পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আর হ্যা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আর আপনাদের মিডিয়ার টিম কে। একটা কার্ড দিনতো। কি যেন নাম?
একটা কার্ড বের করে দিয়ে বললাম, Jeebak ThirdEye IBG News…….