Read Time:7 Minute, 22 Second
চেনা ছকের বাইরে…
অশোক মজুমদার
সফল রাজনীতিবিদ তিনিই যিনি সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, কোন কাজটা কীভাবে করতে হবে তা নিমেষে বুঝে ফেলতে পারেন। এটা সংযোগশাস্ত্রেরও আসল কথা। এর ওপরই নির্ভর করে জনসংযোগের সাফল্য। সফল হয় মানুষের সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াস। কথাটা যত সহজে বলে ফেলা গেল কাজটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। সারা পৃথিবীর বড় বড় সংযোগ বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারটা বুঝতে প্রাণপাত করে ফেলছেন। অথচ আমাদের দিদি এ কাজটা কত সহজেই না করে ফেলেন! পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী হয়ে উত্তরবঙ্গে এসেছি আমি। উত্তরকন্যায় একটি প্রশাসনিক বৈঠকে কথা উঠল ক্রমেই বেড়ে চলা পথ দুর্ঘটনা নিয়ে। সেখানেই যান দুর্ঘটনা কমাতে নিজের মত করে একটা সমাধান সূত্র তুলে ধরলেন দিদি।
তিনি বললেন, যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন তার আসনের সামনের কাঁচের গায়ে যদি বাধ্যতামূলক ভাবে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ লেখা স্টিকার, চালক যে ভাষা জানেন, সে ভাষায় লাগিয়ে দেওয়া হয় তাহলে পথ দুর্ঘটনা অনেক কমবে। বাস, লরি, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি, টেম্পো, অটো, বাইক, স্কুটার রাজ্যের সব যানবাহনেই বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাতেও� বাধ্যতামূলক ভাবে এই স্টিকার লাগাতেই হবে। দিদির মতে, চালকের সামনে যদি এই সতর্ক বার্তাটা তাকালেই চোখে পড়ার মত জায়গায় লেখা থাকে তাহলে তিনি অনেকটাই সতর্ক থাকবেন। খারাপ রাস্তায় দিয়ে চলার সময়ে তিনি শুরু থেকেই সতর্ক হবেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই কথাটাই যারা কোন ক্যাম্পেনের জন্য বিজ্ঞাপন করেন তাদের বক্তব্যেরও আসল কথা। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সমালোচনা বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থার ঘোষণা কোন কাজের কথা নয়। আসল কথা দুর্ঘটনাটা আটকানো। আর এই আটকানোর কাজকে সফল করার জন্যই আজকের সংযোগ বিজ্ঞান বলছে, তুমি যে কাজটি মানুষকে করতে বলছো তা যেন তাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বারবার ধাক্কা দেয়, তাহলেই সেটা তার মাথায় থাকবে। বিজ্ঞাপন বা সামাজিক, রাজনৈতিক কোন আহ্বানের সাফল্য বাড়ে এই কারণে। দিদির বৈঠকের পর এই বিষয়টা নিয়ে আমি আমার এক মনোবিজ্ঞানী বন্ধুর সঙ্গেও কথা বললাম। তিনি শুনেই বললেন, একথা তো আমরাও বলি। একটা জিনিস সঠিকভাবে বারবার বললে বা দেখালে তা মানুষের মনে গেঁথে যায়। মানুষ সতর্ক হয়। ট্র্যাফিক সিগন্যালে গাড়ি বা মানুষ সতর্ক হয় তার সামনে লাল আলো দেখলেই। কারণ, ওটা আমাদের অভ্যাসে এসে গেছে।
দুর্ঘটনা এড়াতে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে বা কোন বিশেষ জায়গায় কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ নয় সেটা মানুষের মনে গেঁথে দিতে হলে এমন ব্যাপক প্রচার সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে বলেই দিদির বিশ্বাস। আমার মনে পড়ছে, নবান্নে একটা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, এমারজেন্সি ওয়ার্ড, আউটডোর কিংবা হাসপাতালের প্রবেশ পথে ‘ডাক্তাররা আমাদের বন্ধু, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন’ জাতীয় স্টিকার, বোর্ড, হোর্ডিং দেওয়া দরকার। তাহলে যে কোন অভিযোগ তুলে ডাক্তারদের নিগ্রহ করার ঘটনা কমবে। অন্যদিকে ডাক্তাররাও মনে রাখবেন রোগী এবং তার বাড়ির লোকেদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এমন স্টিকার, হোর্ডিং, বোর্ড, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক এবং নানা দরকারে মানুষজন যেখানে নিয়মিত যান সেখানেও দেওয়ার দরকার আছে। তাহলে আর কিছু না হোক, মানুষ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব বাড়বে।
দিদির মতে, একাজটা শুধুমাত্র ড্রাইভার, পুলিশ, ডাক্তার বা রোগীর বাড়ির লোকের নয়। এটা সাধারণ মানুষেরও কাজ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা না বাড়লে কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থাই সফল হয় না। এমনকি সাংবাদিকদের তিনি নিজের নিজের মত করে ট্রাফিক আইন ভেঙে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, হাসপাতালে ডাক্তার নিগ্রহ, কলেজে উপাচার্য কিংবা অধ্যাপক নিগ্রহের মত ঘটনা বন্ধ করতে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বলেছেন। তার মতে, ঘটনা ঘটার পর রিপোর্ট করলেই সাংবাদিকদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ, তিনিও এই সমাজেরই একটা অংশ। এটা বন্ধ করা তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
ভাবনার এই অন্যন্যতাই দিদিকে আর পাঁচটা রাজনীতিবিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। প্রশাসন, দল, রাজনীতি কোনকিছুই তার এই দরদী মনটাকে মুছে ফেলতে পারেনি। তার চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে থাকে মানুষ। দলীয় স্বার্থ নয়, যে কোন সমস্যার ইতিবাচক সমাধানই তার লক্ষ্য। উত্তরবঙ্গ সফরে এসে আবার তার সেই জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেলাম আমি। নারী, পুরুষ, পরিবার, দল সবকিছু বাদ দিয়ে তিনি শুধু মানুষকেই দেখেন। এভাবে দেখেন বলেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক আবরণের বাইরে বেড়িয়ে এসে যে কোন সমস্যাকে একেবারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারেন। যার থেকেই বেরিয়ে আসে একেবারে ‘আউট অব দা বক্স’ মানে চেনা গৎ এর বাইরে কোন সমাধান সূত্র।
অশোক মজুমদার
Collected by Faruque ahamed
Advertisements