শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি পাওয়া সত্ত্বেও ড. আশীষ পানীগ্ৰাহী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হলেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, বর্ধমান: গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি পাওয়া সত্ত্বেও ড. আশীষ পানীগ্ৰাহীকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদে মনোনীত করে নিয়োগ করেছে উচ্চশিক্ষা দপ্তর। তাছাড়া বিষয়টা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় কম হয়নি। রাজ্যপাল থেকে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বিষয়টি গড়িয়েছে। সূত্রমতে খবর, আশীষ পানীগ্ৰাহীর এই দুর্নীতির কথা উচ্চশিক্ষা দপ্তর, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর এবং রাজ্যপালের দপ্তরে পৌঁছেছে। তার পরেও এই গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন দুর্নীতিপরায়ন লোককে নিয়োগ করা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে শিক্ষা মহলে। একজনের বিরুদ্ধে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুসারে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে শাস্তি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে তাকে সহ-উপাচার্য পদে নিয়োগ করা হলো এ নিয়ে উঠছে বিস্তর প্রশ্ন।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আশীষ পানিগ্রাহী ও তাঁর এক গবেষকের বিরুদ্ধে তদন্তে
অভিযোগের সত্যতা উঠে আসে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের এক অভিযোগের ভিত্তিতে এঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। সেই তদন্তে প্রমাণিত হয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের দায়ের করা অভিযোগটি সত্য। তারপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী সমিতি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আশিষ পানিগ্রাহী ও ওই গবেষকের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা যায় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের থিসিসের লেখা হুবুহ নকল করেন আশীষ পানীগ্ৰাহী ও তাঁর ওই গবেষক। তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অধ্যাপক পানিগ্রাহীও এই অভিযোগকে স্বীকার করে নেন। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় সেই অভিযোগের সারবত্তা খুঁজে পেলে শাস্তিস্বরূপ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের (EC) সিদ্ধান্ত মতো আশীষ পানিগ্রাহী নতুন করে এক বছর কাউকে গবেষণা করাতে পারবে না। সেই সঙ্গে তাঁর অধীনে কর্মরত গবেষকের পিএইচডি ডিগ্রি ও তাঁর পিএইচডি রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এছাড়া আরেকটি গুরুতর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে, ২০১৮ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির সঙ্গে আশীষ পানীগ্ৰাহী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যথাযথ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও প্রাণীবিদ্যা বিভাগে এস.টি পদে এক জনকে নিয়োগ করে, যার প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি কোনটিই নেই। বিজ্ঞাপনে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল তার কোনোটিই ওই প্রার্থীর নেই।
অভিযোগ, কেবলমাত্র টাকার লেনদেন ও ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জেরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীট-পতঙ্গ বিভাগের (Entomology) ছাত্রকে নিয়োগ করা হয় প্রাণীবিদ্যা বিভাগে যথাযথ নিয়োগবিধি না মেনে। সেই সময়ে তিনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ অফিসার (ডাইরেক্টর অফ রিক্রুটমেন্ট অফ টিচার্স এণ্ড অফিসার্স) এবং প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। সুতরাং তাঁর তত্ত্বাবধানেই যে এই দুর্নীতি ঘটেছে এমনটাই অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে। উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুজনেই বহু দূর্নীতি করেছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের ইচ্ছে মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মীয় স্বজনদের নিয়োগ করেছেন। উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষ, আশীষ পানীগ্রাহী ও দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত পরীক্ষা সমূহের নিয়ামক বিমলেন্দু বিশ্বাস, দূরশিক্ষার ডিরেক্টর মানস মোহন অধিকারী ও বিজেপির ঘনিষ্ঠ ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অলোক ঘোষেরা আর্থিক দূর্নীতির পাহাড় প্রমাণ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও তাঁরা বুক চিতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরছেন। উচ্চশিক্ষা ও মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর অভিযোগ পেয়েছে কি সাজা হয় এখন সেটাই দেখার।
অন্যদিকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হিসেবে আচার্য মনোনীত প্রার্থী হলেন গৌতম চন্দ্র। যোগ্যতার বিচারে গৌতম চন্দ্র অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া সত্বেও আশিষ পানিগ্রাহী নিয়োগ নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্দরে। বিশেষ সূত্রের খবর, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য নিমাইচন্দ্র সাহার সহপাঠী হবার দরুন আশিষ পানিগ্রাহীই ছিল তাঁর সুপারিশকৃত প্রার্থী। আচার্য মনোনীত প্রার্থী গৌতম চন্দ্রের ডিএসসি ডিগ্রীও রয়েছে। সু খ্যাতিও রয়েছে রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে। পাশাপাশি তিনি স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী। তাঁর বিরুদ্ধে কোন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ নেই। অন্যদিকে আশিষ পানীগ্ৰাহীর মতো এহেন একজন ব্যক্তিকে সহ-উপাচার্য পদে নিয়োগ করায় রাজ্যের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়েছে বলে শিক্ষামহলের ধারণা।
যদিও আচার্য তথা রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের কথা অনুযায়ী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য নিয়োগ বিষয়টি এখনও পর্যন্ত মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর বিচারাধীন রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রাজ্যবাসী তিনি কি সিদ্ধান্ত নেন সেটাই দেখার। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের দূর্নীতির অবসান ঘটিয়ে একটু স্বচ্ছতা আনা নীতিনৈতিকতার মূল্য দেওয়াই উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।