ধীরে ধীরে দেশবাসী ভুলে যাচ্ছে রাধানাথ সিকদারের নাম
এম রাজশেখর (২৪ সেপ্টেম্বর ‘২০):- গৌতম বুদ্ধ তাঁর বাণীতে বলে গেছেন, ‘… মৃত্যুর পরেও মানুষের মনে বেঁচে থাকা কর্মের ব্যাপার।’ তাই যদি হয়, তাহলে কোলকাতায় জন্ম আদ্যপান্ত বাঙালি গণিতজ্ঞ, এভারেস্ট পর্বতের উচ্চতা নির্ণায়ক রাধানাথ সিকদার-কে মৃত্যুর মাত্র ১৫০ বছরের মধ্যে দেশ ও বাঙালি ভুলে যাচ্ছে কীভাবে!
আজকের পড়ুয়ারা এটা ভালোভাবে জানে যে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ-র নাম ‘মাউন্ট এভারেস্ট’, এর উচ্চতা ২৯ হাজার ২ ফুট। অথচ অধিকাংশ পড়ুয়া বা দেশবাসী জানেননা বা জানলেও ভুলতে বসেছেন ‘মাউন্ট এভারেস্ট’-এর উচ্চতা নির্ণয় করেছিলেন বাঙালি গণিতজ্ঞ রাধানাথ সিকদার।
১৮১৩ সালের অক্টোবর মাসে কোলকাতা জোড়াসাঁকো অঞ্চলের সিকদার পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন রাধানাথ সিকদার।
ছাত্রজীবনে হেয়ার স্কুল, তৎকালীন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি শিক্ষা সমাপন করে কৃতবিদ্য গণিতজ্ঞ রূপে সমাদৃত হন।
১৮৩০ সালে পরাধীন ভারতে ‘সার্ভেয়ার জেনারেল অব ইণ্ডিয়া’ রূপে কর্মভার গ্রহণ করেন স্যার জর্জ এভারেস্ট।
তিনি ভারতে আসার পর পরাধীন ভারতের মানচিত্র তৈরীর কাজে জোয়ার আসে।
মানচিত্র তৈরির কাজে ত্রিকোণমিতি বিশেষজ্ঞ-র প্রয়োজন দেখা দিলে ‘এভারেস্ট’-এর জনৈক পরিচিত ব্যক্তি তাঁকে রাধানাথ সিকদার-এর কথা বলেন।
স্যার জর্জ এভারেস্ট ভারত সর্বেক্ষণের কাজে গণণ বিভাগে রাধানাথ সিকদার-কে নিয়োগ করেন।
১৮৪৩ সালে ‘সার্ভেয়ার জেনারেল অব ইণ্ডিয়া’-র পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন স্যার জর্জ এভারেস্ট।
এভারেস্ট-এর স্থলাভিষিক্ত হন কর্ণেল এণ্ড্রিউ স্কট ওয়াগ। ওয়াগ রাধানাথ সিকদার-কে ‘পিক এক্স ভি’ মাপার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
রাধানাথ সিকদার বিভিন্ন মাপজোক-এর হিসাবকে মাথায় রেখে বিশুদ্ধ গাণিতিক জ্ঞানের সাহায্য ১৮৫২ সালে ‘পিক এক্স ভি’-র উচ্চতা নির্ণয় করেন।
যদিও সেই সময় রাধানাথ সিকদার-এর নিষেধেই সরকারীভাবে ‘পিক এক্স ভি’-র উচ্চতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে কিছুই জানানো হয়নি।
পরে আরো বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে একই ফল আসার পর রাধানাথ সিকদার উচ্চতা ঘোষণার বিষয়ে ছাড়পত্র দেন।
ছাড়পত্র প্রাপ্তির পরেই ১৮৫৬ সালে সরকারীভাবে জানানো হয় ‘পিক এক্স ভি’-র উচ্চতা ২৯ হাজার ২ ফুট।
এই বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য, ‘পিক এক্স ভি’-র উচ্চতা নির্ণয়ের পূর্বে বিশ্ববাসী কাঞ্চনজঙ্ঘা-কেই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শিখর বলে ভেবে এসেছিল।
‘পিক এক্স ভি’-র উচ্চতা নির্ণয়ের পর পরাধীন ভারতের প্রাক্তন ‘সার্ভেয়ার জেনারেল অব ইণ্ডিয়া’ স্যার জর্জ এভারেস্ট-এর নামানুসারে এই পর্বতশৃঙ্গের নামকরণ করা হয় ‘মাউন্ট এভারেস্ট’।
যদিও পরিতাপের বিষয় স্যার জর্জ এভারেস্ট তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন ‘পিক এক্স ভি’ আবিষ্কার করেননি, এর ধারেকাছেও জাননি বা উচ্চতাও মাপেননি , অথচ তাঁর নামেই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্তশৃঙ্গের নাম হয়ে গেলো ‘মাউন্ট এভারেস্ট’।
শুরু করেছিলাম বুদ্ধের বাণী দিয়ে, কিন্তু এই লেখাটা শেষ করার সময় বলতে ইচ্ছে করছে; মরা মানুষও জীবন্ত থাকতে পারে যদি তাঁকে নিয়ে অনবরত চর্চা করা হয়, নাহলে এই ক্ষণভঙ্গুর দুনিয়াতে সব কিছুই একসময় তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে।
যখন বিশ্বের কোথাও লিপির আবিষ্কার হয়নি তখন ছিল শ্রুতির যুগ, মানুষ তখন শুনে শুনে মনে রাখত। গুটেনবার্গের হাত ধরে ছাপাখানার যুগে পদার্পণ করার পর আমরা পড়ে পড়ে বা ছবি দেখে মনে রাখি। অর্থাৎ সেই চর্চার বিষয়। নিয়মিত চর্চা ছাড়া এই দুনিয়া থেকে ভালোমন্দ সব বিষয়ই অচিরে মুছে যেতে পারে।
তাই যদি না হতো তাহলে রাধানাথ সিকদার-এর মৃত্যুর (১৭ মে ১৮৭০) মাত্র ১৫০ বছরের মধ্যেই কী তাঁর মহান কীর্তিকে ভারতবাসী বা বাঙালি এত সহজে ভুলতে পারত।
এইটুকু পড়ে অনেকেই হয়তো বলবেন, কে বলেছে দেশ তাঁকে ভুলেছে! তাঁর নামে তো ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যটা ওখানেই, শুধু নাম-কা-ওয়াস্তে একটা ডাকটিকিট প্রকাশ করে হাত ধুয়ে ফেলা আজ ভারতের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরাধীন ভারতের কথা বাদ দিলাম, স্বাধীন ভারতেও আজও গণিতশাস্ত্রে পারদর্শিতার জন্য রাধানাথ সিকদারের নামে নেই কোনো স্কলারশিপের বন্দোবস্ত, নেই কোনো পুরস্কার, সম্মান জানাতে নেই কোনো মূর্তি। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে গণিতজ্ঞ রাধানাথ সিকদার-এর অবদানের কাহিনী।
স্বীকৃতি: সিকদারের গাণিতিক প্রতিভা হিসাবে স্বীকৃতি হিসাবে, জার্মান দার্শনিক সোসাইটি তাকে খুব বিরল সম্মান, 1864 সালে তাকে সংশ্লিষ্ট সদস্য করে তুলেছিল। ভারত বিভাগের ডাক বিভাগ, ২৪ শে জুন ২০০৪ তারিখে ভারতের চেন্নাইয়ে গ্রেট ট্রাইগোনমিত্রিক জরিপ প্রতিষ্ঠার স্মরণে একটি ডাকটিকিট চালু করে। স্ট্যাম্পগুলিতে সমাজের দু'জন গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী রাধানাথ সিকদার এবং নাইন সিংহ উপস্থিত ছিলেন। গ্রেট আর্ক বলতে বোঝায় ভারতীয় উপমহাদেশের পুরো টোগোগ্রাফির নিয়মিত অনুসন্ধান এবং রেকর্ডিং যা গ্রেট ট্রাইগনোমেট্রিক জরিপের নেতৃত্বে ছিল রাধানাথ সিকদার।